![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
কারা বেশি মেধাবী, কাদের বেশি সম্মান পাওয়া উচিৎ, কারা বেশি ফাঁকিবাজ, কারা বেশি দূর্ণীতিবাজ এই বিষয়গুলো নিয়ে ইদানীং খুব আলোচনা হচ্ছে। বিশেষ করে শিক্ষকসমাজ এবং আমলাদের মধ্যে। এক পক্ষ থেকে শুনলে মনে হবে বিপরীত পক্ষের সব সমস্যা। হয়ত খুব গভীরে না গিয়ে এই সমস্যার রায় দেওয়া সম্ভব না। সেই চেষ্টা করার দায়ও আমাদের নেই। কিন্তু দেশের সাধারণ নাগরিক হিসেবে একটা মৌলিক বিষয় নিয়ে চিন্তা করতে পারি আমরা--আগামি ২০ বছর পরে যদি আমাদের দেশকে একটা মোটামুটি মানের দেশে বা সত্যিকারের মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত করতে চাই, তাহলে কোন বিষয়গুলোকে গুরুত্ব দিব বা কোন বিষয়কে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিব।
একটা দেশের উন্নয়নের জন্য এবং গুনগত মানের জীবন যাত্রার জন্য যেসব সংস্থা বা খাত বিশেষ ভুমিকা রাখতে পারে তার মধ্যে অন্যতম হল চিকিৎসা, শিক্ষা, প্রশাসন এবং প্রতিরক্ষা। এই সবগুলো খাতের আলাদা আলাদা প্রয়োজনীয়তা রয়েছে, সুতরাং সবগুলোকেই সমান গুরুত্ব দেওয়া যেতে পারে। কিন্তু রাস্ট্রের সীমিত সম্পদের কারণে যদি শুধু একটিকে বেছে নিতে হয়, তখন আমাদের সিদ্ধান্ত নিতে হবে কোনটাকে বেছে নিলে আমরা সবচেয়ে বেশি লাভবান হব।
যদি বাস্তবিক বিচারে মনে হয় প্রশাসণ আমাদেরকে সবচেয়ে বেশি লাভবান করবে, তাহলে আমলাদের পূর্বে প্রাপ্ত অধিক সুবিধা পরেও আরো দুই গ্রেড পদমর্যাদা বাড়িয়ে দিয়ে, এবং শিক্ষকদের পূর্বের থেকে এক গ্রেড এবং মোট তিন গ্রেড পদমর্যাদা নামিয়ে দিয়ে সরকার যে নতুন বেতন কাঠামো পাশ করেছে তা সাধুবাদ পাওয়ার যোগ্যতা রাখে। সরকারকে সে জন্য অভিনন্দন।
কিন্তু বাস্তবিক বিচারে যদি মনে হয় শিক্ষা বেশি গুরুত্ব পাওয়া উচিৎ, তাহলে সরকারের নতুন বেতন কাঠামো নিয়ে আমাদের সাধারণ নাগরিকদের দূঃশ্চিনার গুরুত্বপূর্ণ কারণ আছে—
অধিক গুরত্বপূর্ণ খাতকে অবনমন করে, কম গুরত্বপূর্ণ খাতকে প্রোমোট করে সরকার দৃশ্যত দেশের ভবিষ্যৎকে ঝুঁকিতে ফেলে দিয়েছে। কিন্তু, সরকার ইচ্ছে করে কেন এই ভুল সিদ্ধান্ত নিল? এই প্রশ্নের উত্তরে হয়তো প্রথমেই আমাদের মনে আসবে সরকারের ক্ষমতা সুরক্ষিত করার জন্য আমলাদের প্রয়োজন, সে কারনে তাদেরকে বাড়তি এই প্রোমোট করা। হয়ত এটা একটা কারণ। কিন্তু আর কোন কারণ আছে কি?
এই বাড়তি-কারণ খুজতে গেলে, বিশ্বব্যাংকের একটি সুপারিশ এবং নিকট অতীতে ঘটে যাওয়া দুটি ঘটনার উপর আমাদের নজর দিতে হবে। বিশ্বব্যাংক সরকারকে ঋণ দেওয়ার সময় সুপারিশ করেছে--তাদের দৃষ্টিতে অলাভজনক শিক্ষা খাতকে প্রাইভেটাইজেশনের মাধ্যমে লাভজনক খাতে পরিণত করতে হবে। তারই ধারাবাহিকতায় সরকার জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়সহ তিনটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়কে নিজেদের আয়ে চলতে চাপ দেয়। অর্থাৎ, ছাত্রছাত্রীদের টিউশন ফি বা বেতন বাড়িয়ে দিতে হবে। কিন্তু জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীরা সেটা মেনে নেয়নি। তাদের তীব্র আন্দোলনের মুখে সরকার সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসে। কয়দিন আগে সরকার প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীর উপর করারোপ করে, কিন্তু ছাত্রছাত্রীদের তীব্র আন্দোলনের মুখে সেটাও আর কার্যকর করতে পারেনি। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় এবং প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের এই দুটি ঘটনা প্রমান করে, সরকার বিশ্বব্যাংকের সুপারিশ পালন করার জন্য কতটা মরীয়া। এই মরীয়াভাব স্বাভাবিকভাবে আমাদের চিন্তিত করে--সরকার আর কোনো উপায়ে শিক্ষা খাতকে প্রাইভেটাইজেশনের চেষ্টা করছে কি?
শিক্ষার বাণিজ্যিকিকরনের বা প্রাইভেটাইজেশনের উর্বর ভূমি হচ্ছে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়গুলো। সুতরাং সরকারের চেষ্টা থাকবে এই উর্বর ভূমিকে আরো উর্বর করে তোলা।
প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিযোগী কারা? যেসব ছাত্রাছাত্রী প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে চায় না বা পড়ার আর্থিক সঙ্গতি রাখে না, তারা কোথায় যায়? এই দুটি প্রশ্নের মোটামুটি উত্তর হচ্ছে, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে। অনেক সমস্যা থাকার পরেও পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের মান যেহেতে এখনো যথেষ্ট ভাল, তাই প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার আর্থিক সঙ্গতি যে ছেলেটা/মেয়েটা রাখে না সেও পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে জীবনের প্রতযোগীতায় টিকে যাচ্ছে, বা আর্থিক সঙ্গতি থাকার পরেও অনেক ছাত্রাছাত্রী পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে। আর এতে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের উর্বরতা বাড়ানোর প্রক্রিয়া ব্যহত হয়। সরকার বাহাদুর সেটা চান না কারণ বিশ্বব্যাংক তাতে নারাজ হয়, আর সরকার বাহাদুরের উজির-নাজির-আমলারা সেটা চান না কারণ তাঁরা এসব উর্বর ভূমির ভূস্বামী। সুতরাং কি করা যায়? (নতুন বেতন কমিশনের প্রধান ফরাস উদ্দিন তার প্রমান। তিনি যেথেষ্ট উর্বর একখান ভূমির--প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের--মালিক।)
পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীদের বেতন বাড়িয়ে সরকারের বাণিজ্য, এবং পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন সমস্যার সাথে সেই বাড়তি বেতনের ভয় দেখিয়ে ছাত্রছাত্রীদের প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়মুখী করার চেষ্টা পুরটাই মাঠে মারা গেল জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীদের তীব্র আন্দোলনের কারণে। সরকার বাহাদুর এবং তাঁর উজির-নাজিররা বুঝে গেল এই পথে এগিয়ে সফল হওয়া যাবে না। কিন্তু তাই বলে তাঁরাতো হাত গুটিয়ে বসে থাকতে পারেন না। এর একটা বিহীত করা চাই।
সরকার বাহাদুর আর তাঁর উজির-নাজির-আমলাদের মনে পড়ে গেল তান্ত্রীকমশাইয়ের সেই বিড়ালের কথাঃ ভারি দুষ্টু বিড়াল। অনেক চেষ্টা করেও তাকে ঝাল মরিছ খাওয়ানো যাচ্ছিল না। প্রথমে দুধের সাথে মিশিয়ে দেল, বিড়াল খেল না। তারপর জোর করে মুখে ঢুকিয়ে দিতে গেল, কামড়ে আঁচড়ে নাজেহাল করে ছাড়লো তান্ত্রীকমশাইকে। তখন তিনি তাঁর তান্ত্রীক গুণে বুঝতে পারলেন, এইভাবে কাজ হবে না, কৌশলের আশ্রয় নিতে হবে। কৌশল করে বিড়ালের পাছায় লাগিয়ে দিলেন সেই ঝাল মরিচ। প্রথামে বিড়াল কিছুক্ষন লাফালাফি করল। তারপর জ্বালা কমানোর জন্য মুখ ঘুরিয়ে সেই মরিচ চেঠে খেতে লাগল।
যেই মনে পড়া, সেই কাজ। সরকার বাহাদুর আর তাঁর উজির-নাজিররা কৌশলের আশ্রয় নিলেন। নতুন বেতন স্কেলে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের তিন গ্রেড নামিয়ে দিলেন। কয়দিন এই শিক্ষকরা আর তাদের স্টুডেন্টরা হইচই করবে। তারপর যেহেতু কম বেতন, মর্যাদা কম, তাই জ্বালা নিভাতে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাবী শিক্ষকরা ছুটবে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে। তাদের জায়গায় আসবে কম মেধাবীরা শিক্ষক হয়ে। পাবলীক বিশ্ববিদ্যালয়ে কমে যাবে মেধার চর্চা। মেধাহীন এই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে জ্বালা নেভাতে স্টুডেন্টরাও ছুটবে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে। আর এটাইতো চায় সরকার বাহাদুর আর তাঁর উজির-নাজির-আমলারা। তাঁদের ব্যাবসা ঠেকায় কে? জয়, সরকার বাহাদুরের জয়। জয়, উজির-নাজির-আমলাদের জয়। জয় তান্ত্রীকমশাইয়ের জয়।
কিন্তু এতেকরে সাধারণ জনগনের কি জয় হল? বিশেষ করে মধ্যবিত্য আর নিম্ন মধ্যবিত্যের? যে ছেলেটা/মেয়েটা আর্থিক সঙ্গতি না থাকায়, প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে না গিয়ে, সে সময়ের মেধাহীন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে থাকবে সে কি পারবে জীবনের প্রতিযোগীতায় টিকে থাকতে? আর কি দরিদ্র-পরিবারের গ্রামের ছেলে আতিউর রহমান বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্ণর হয়ে উঠবে? শহীদ বুদ্ধিজীবি পরিবারের ছেলে, অর্থের অভাবে একই শার্ট দুই ভাইয়ে শেয়ার করে পরা হুমায়ূন আহমেদ-জাফর ইকবাল তৈরি হবে আমাদের সমাজে? এমন শতশত উদাহরণ, যারা দারিদ্রতার কাছে হার মানে নি, শত বাধার কাছে নত হয় নি, তাদের আমরা হেরে যেতে দিব শিক্ষার এই বাণিজ্যিকিকরণের কাছে?
©somewhere in net ltd.