নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
লিন্ক সহ পোষ্টের বাহবা/দায়, মূল লেখকের।
২০১৩ সালে কয়েক মাস ধরে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারকে কেন্দ্র করে দেশ সংকট ও সম্ভাবনার দোলাচলে আবর্তিত হচ্ছে। দেশে দুটি সম্পূর্ণ বিপরীতধর্মী দৃশ্যপট লক্ষ্য করা যাচ্ছে। বাচ্চু রাজাকারের বিরুদ্ধে প্রথম রায়ে কোনো অঘটন ঘটেনি; কারণ তিনি পুলিশের অমার্জনীয় অবহেলার কারণে দেশত্যাগে সমর্থ হয়েছেন, আদালতে আত্মপক্ষ সমর্থন করেননি এবং জামায়াত-শিবির তার দায় স্বীকার করেনি। ৫ ফেব্রুয়ারি, ২০১৩ কাদের মোল্লা সম্পর্কিত দ্বিতীয় রায়ে তরুণ প্রজন্ম তাদের প্রত্যাশিত শাস্তি ঘোষিত না হওয়ায় শাহবাগ চত্বরে জমায়েত হয়েছে। ৫ ফেব্রুয়ারি গভীর রাতে শাহবাগে লক্ষ্য করেছি, প্রতিবাদীদের সংখ্যা কয়েকশ', সে সংখ্যা প্রতিদিন বেড়েছে এবং পরবর্তী তিনটি সমাবেশ লক্ষজনের জমায়েতের রূপ নিয়েছে; প্রতিটি জেলা ও বেশ কিছু উপজেলায় শাহবাগের আদলে গণজাগরণ মঞ্চের জন্ম হয়েছে। তাদের মূল দাবি, যুদ্ধাপরাধীদের দেশের প্রচলিত আইনে সর্বোচ্চ শাস্তি, জামায়াত-শিবিরের রাজনীতি নিষিদ্ধকরণ ও তাদের বিপুল অর্থের উৎস রোধ করা। পঁচাত্তরের পর প্রায় দুই দশক ধরে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃত হয়েছে, পাঠ্যপুস্তকে কার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে দেশ স্বাধীন হয়েছে সেটি বোঝা প্রায় অসম্ভব ছিল। তা সত্ত্বেও তরুণ প্রজন্মের এ জাগরণ ষাটের দশকের ছাত্র আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধের প্রজন্মের কাছে অভাবনীয়। নতুন প্রজন্ম গত চার দশকের রাজনৈতিক সমাবেশের সংস্কৃতি পাল্টে দিয়েছে। শাহবাগসহ সারাদেশে মানুষ যোগ দিয়েছে স্বতঃস্ফূর্তভাবে, তাদের অর্থের বিনিময়ে কিংবা ভাড়া করা যানবাহনে আনতে হয়নি, মহাসমাবেশে অগুনতি মানুষ এসেছে কাঁধে শিশুসন্তান নিয়ে, দিবারাত্রি সবাই খাবার ভাগ করে নিচ্ছে; মোবাইল কিংবা মানিব্যাগ নিয়ে দুশ্চিন্তা নেই।
তাদের দাবি মৌলিকভাবে রাজনৈতিক কিন্তু একটি নির্দলীয় প্লাটফর্ম দ্বারা পরিচালিত এবং আয়োজন যতটা রাজনৈতিক তার চেয়ে বেশি সাংস্কৃতিক। ফলে দাবির সঙ্গে সহমতপোষণকারী অথচ প্রচলিত রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে বীতশ্রদ্ধ এই মঞ্চ সর্বজনের মিলনকেন্দ্রে পরিণত হতে পেরেছে। সাধারণভাবে এ উদ্যোগ শান্তিপূর্ণ ও অহিংস এবং কর্মসূচির লক্ষ্য সারাদেশে তৃণমূল পর্যায়ে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবি ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে বিস্তৃত করা। আমার আশঙ্কা কোনো ধরনের রাজনৈতিক প্রভাব অতিরিক্ত দৃশ্যমান হলে এ মঞ্চ তার বৈশিষ্ট্য হারাতে পারে।
অন্যদিকে ২৮ ফেব্রুয়ারি দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর ক্ষেত্রে তৃতীয় রায় প্রকাশের পর এ রায় জামায়াত-শিবিরের মনঃপূত না হওয়ায়, তাদের প্রতিবাদী আচরণ সম্পূর্ণ সহিংস ও সন্ত্রাসীরূপে পরিচালিত হয়েছে ও হচ্ছে। গত নভেম্বর মাস থেকে তারা সারাদেশে তাণ্ডব চালাচ্ছে। তাদের প্রথম কাজের ধারা ছিল কিছু ক্যাডারের ঝটিকা মিছিল করে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীকে আক্রমণ করে ভীত-সন্ত্রস্ত করা, পুলিশ-র্যাব-বিজিবি সদস্য থেকে শুরু করে সর্বশেষে পুলিশ ফাঁড়ি ও সরকারি দফতর আক্রমণ করা, এমনকি পল্লী বিদ্যুৎকেন্দ্র ধ্বংস করে হাজার হাজার মানুষকে বিদ্যুৎহীন রাখা। গাড়ি ভাংচুর বাংলাদেশে সাধারণ ঘটনা, তাদের দ্বিতীয় অপকর্ম হচ্ছে যাতায়াত ব্যবস্থা বিপর্যস্ত করে রাজধানীকে সারাদেশ থেকে বিচ্ছিন্ন করা; এ জন্য রেললাইনে ফিশপ্লেট সরানো থেকে বগিতে আগুন জ্বালাতে তাদের দ্বিধা নেই। ফেব্রুয়ারি-মার্চে ১৯৭১-এর মতো তাদের লক্ষ্যবস্তু অমুসলিম জনগণের সম্পত্তি ও উপাসনালয়। ইতিমধ্যে সংখ্যালঘুদের জনসংখ্যা ১৯৭২ থেকে ২০১১ সালের প্রতিবেদন অনুযায়ী, শতকরা হিসাবে অর্ধেকে নেমেছে। এ ক্ষেত্রে অবশ্য অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক যে, জনপ্রতিনিধিরা সম্ভবত প্রাণভয়ে কিংবা মুসলিম ভোট হারানোর আশঙ্কায় ঘটনার দু'সপ্তাহ অতিক্রান্ত হওয়ার পরও তাদের পাশে এসে দাঁড়ায়নি। সমগ্র সমাজ যদি শঙ্কাহীন চিত্তে এই নিরাপত্তাহীন অসহায় মানুষের পাশে না দাঁড়ায়, তবে এ ধরনের ঘটনা অব্যাহত থাকার আশঙ্কা রয়েছে।
মুক্তিযুদ্ধের ভাবাদর্শের দিক থেকে সবচেয়ে শঙ্কার বিষয়, এ ধরনের সন্ত্রাসী কাজে ধর্মের অপব্যবহার। স্বাধীনতার পর দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী তার ওয়াজ ও সিডির মাধ্যমে ধর্মপ্রচারক হিসেবে অনেক ধর্মপ্রাণ নিম্নবিত্ত এমনকি উচ্চবিত্ত শিক্ষিত মানুষের কাছে বিশেষ পরিচয়ে পরিচিত হয়েছেন। ফলে ধর্ম ও ফটোশপের সাহায্য নিয়ে সাধারণ মানুষকে ধর্মের নামে বিভ্রান্তি সৃষ্টি জামায়াত-শিবিরসহ উগ্রপন্থিদের জন্য সহজ হয়েছে। প্রকৃত ধর্ম বিষয়ে জ্ঞানী মানুষরা এ বিভ্রান্তি দূর করতে অগ্রসর হয়েছেন, তার কিছু সুফল আমরা পাব, তবে কাজটি সহজ নয়।
এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে দুর্ভাগ্যজনক প্রধান বিরোধী দলের নেত্রীর সাম্প্রতিক তিনটি বক্তব্য ও বিবৃতি। তিনি এ ধরনের সন্ত্রাসী কাজের দলকে নিয়ে কেবল জোটবদ্ধ কর্মসূচি প্রদান করছেন না, পাকিস্তান আমলের মতো ধর্মকে অপব্যবহার করছেন। এমনকি পাকিস্তানি শাসকরাও ষাটের দশকের ছাত্রনেতাদের নাস্তিক কিংবা আওয়ামী লীগকে বিধর্মদের দল বলে অভিহিত করেনি। স্বভাবত এ ধরনের রাজনীতিতে নির্বাচনী কৌশলের কাছে নীতি প্রতিনিয়ত পরাস্ত হয়ে সংকট ঘনীভূত হচ্ছে। আর সম্ভাবনার রূপালিরেখার মতো জেগে রয়েছে শাহবাগ, তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে নানা ধারার নাগরিক উদ্যোগ।
২.
এ পর্যায়ে বাংলাদেশে যুদ্ধাপরাধের বিচার বিষয়ে কিছু 'মিথ' বা সমালোচনা ও বাস্তবতা তথা যথাযথ তথ্যাদি নিয়ে আলোচনা করা যেতে পারে। জাতীয়ভাবে এবং আন্তর্জাতিক অঙ্গনে কোটি কোটি ডলারে ক্রয়কৃত লবিস্টদের প্রধান সমালোচনা হচ্ছে, এ বিচার স্বচ্ছ, নিরপেক্ষ ও আন্তর্জাতিক মানের নয় এবং সম্প্রতি কিছু কিছু আন্তর্জাতিক তথ্যমাধ্যম যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের রায়কে বাংলাদেশে ইসলামিক ধর্মগুরুদের বিচার ও শাস্তি আখ্যা দিয়ে ধারাবাহিক অপপ্রচার অব্যাহত রেখেছে।
বর্তমানে বাংলাদেশসহ বেশ কয়েকটি দেশে যুদ্ধাপরাধের বিচার চলছে, যার মধ্যে রয়েছে কম্বোডিয়া, রুয়ান্ডা, সিয়েরালিওন ও সাবেক যুগোস্লাভিয়া। আন্তর্জাতিক আইনে যুদ্ধাপরাধ মানবতাবিরোধী অপরাধের অন্যতম। আন্তর্জাতিক আইনে এ বিচারকাজ শুরু হয়েছে বিশ্বযুদ্ধের পর ১৯৪৫ সালে আন্তর্জাতিক সামরিক আদালতে, যা ন্যুরেমবার্গ বিচার নামে খ্যাতি লাভ করেছে এবং তার পাশাপাশি শুরু হয় টোকিও বিচার। ১৯৪৮ সালে জেনেভায় জাতিসংঘের উদ্যোগে সর্বজনীন মানবাধিকার সনদ গ্রহণের পরদিন জেনোসাইড কনভেনশনে যুদ্ধাপরাধ তথা মানবতাবিরোধী অপরাধের সর্বজনীন সংজ্ঞা ও প্রয়োগ-সংক্রান্ত সনদ গৃহীত হয় এবং নানা দেশের অভিজ্ঞতার আলোকে সেটি বারবার পরিবর্তিত হয়েছে, তার সর্বশেষ সংস্করণ ১৯৯৮ সালের ইন্টারন্যাশনাল ক্রিমিনাল কোর্টের অধ্যাদেশ যা রোম স্ট্যাউট নামে পরিচিত। অবশ্য এই আন্তর্জাতিক আইনে প্রবর্তনের পূর্বের কোনো অপরাধের বিচার করা যায় না। সুতরাং এ ক্ষেত্রে নিখুঁত কোনো আইন নেই। উদাহরণস্বরূপ জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে সাবেক যুগোস্লাভের যে আইনে বিচার হচ্ছে, তা গত ১৮ বছরে ৪৬ বার সংশোধিত হয়েছে। বাংলাদেশে ১৯৭৩ সালের যে অধ্যাদেশের অধীনে বিচারকাজ চলছে, সেটি ২০০৯ ও ২০১৩ সালের সংশোধনীর মাধ্যমে যুগোপযোগী করা হয়েছে। একমাত্র প্রেসিডেন্ট ওবামার যুদ্ধাপরাধ বিষয়ক রাষ্ট্রদূত স্টিভেন র্যাপ ছাড়া আমার জানামতে, অন্য কেউ আইনটি আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন করার বিষয়ে কোনো সুপারিশ প্রদান করেননি এবং সেসব সুপারিশ মূলত চৎড়পবফঁৎধষ বা প্রায়োগিক ক্ষেত্রে, যার অধিকাংশ আইনের প্রায়োগিক ক্ষেত্রে সংযোজিত হয়েছে। তাই বিরোধী দলের জন্য আইনের স্বচ্ছতা, নিরপেক্ষতা ও মান বিষয়ে বক্তব্য না রেখে জাতির কলঙ্ক মুক্তির স্বার্থে সুনির্দিষ্ট প্রস্তাব রাখা বাঞ্ছনীয়। বস্তুতপক্ষে একুশ শতকের বিশ্বে যুদ্ধাপরাধের বিচারের বিরুদ্ধতা করা অসম্ভব জেনেই জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন এই আইনের মান নিয়ে প্রশ্ন তোলা হচ্ছে।
দ্বিতীয়ত, বাংলাদেশে ইসলামিক ধর্মগুরুদের বিচার করে শাস্তি দেওয়া হচ্ছে। এ বিষয়ে দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর যুদ্ধাপরাধ বিষয়ে রায়ের সূচনায় বিজ্ঞ ট্রাইব্যুনাল প্রধানের সূচনা বক্তব্যটিই যথেষ্ট। বিচারপতি বলেছেন, আমরা বর্তমানের আল্লামা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর বিচার করছি না, আমরা বিচার করছি ১৯৭১ সালের ৩০ বছরের যুবকের, যার বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগ উত্থাপিত হয়েছে। সুতরাং এটি স্পষ্ট যে, ধর্মের নামে বিভ্রান্তি সৃষ্টির উদ্দেশ্যেই জাতীয় ও আন্তর্জাতিক অঙ্গনে অপপ্রচার চলছে।
তৃতীয়ত, অভিযোগ উঠেছে ৫ ফেব্রুয়ারি শুরু হওয়া শাহবাগের গণজাগরণ মঞ্চ বিচারের রায়কে প্রভাবিত করার জন্য চাপ সৃষ্টি করছে। বস্তুতপক্ষে রায় প্রদানের আগের দিন হরতাল ডেকে ও শাপলা চত্বরে গৃহযুদ্ধের হুমকি দিয়ে চাপ সৃষ্টি করেছে জামায়াত-শিবিরচক্র এবং গত এক মাসের ওপর সময়কাল ধরে সারাদেশে নাশকতামূলক সন্ত্রাসী কার্যকলাপের মধ্য দিয়ে তারা বিচারের রায়কে প্রভাবিত করার অপপ্রয়াসে লিপ্ত রয়েছে; আন্তর্জাতিক অঙ্গনে তাদের লবিস্টরা প্রায় দু'বছর ধরে এ অপকর্মে যুক্ত রয়েছে। আর রাজীব ও মিরাজ হত্যার মধ্য দিয়ে তাদের সঙ্গে আন্তর্জাতিক জঙ্গি সংগঠনগুলোর সরাসরি যোগাযোগ প্রকাশ পেয়েছে।
যুদ্ধাপরাধের বিচারকে কেন্দ্র করে মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশ তার জন্মলগ্নের মৌলিক দ্বন্দ্বে ফিরে গেছে_ এ দ্বন্দ্ব বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের ভাবাদর্শের। রাজনৈতিক দলের নির্বাচনী বছরের কৌশলাদি সংকটকে ঘনীভূত করছে। ফলে শান্তি-শৃঙ্খলা কেবল বিনষ্ট হচ্ছে না, মতাদর্শগত কারণে সমাজের গভীর ও বিস্তীর্ণ বিভাজন সত্ত্বেও দেশবাসীর বিপুল অর্জন সমস্যার সম্মুখীন হবে। বাংলাদেশের সমগ্র শুভবুদ্ধিসম্পন্ন সমাজের শঙ্কামুক্ত মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশের সপক্ষে উজ্জীবন এ সংকট উত্তরণে বিশেষ ভূমিকা রাখতে পারে।
সুত্র
©somewhere in net ltd.
১| ৩১ শে মার্চ, ২০১৩ সকাল ১০:২৪
চিররঞ্জন সরকার বলেছেন: ভাল তথ্য। এগুলো বার বার বলতে হবে, লিখতে হবে।অভিনন্দন।