নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
লিন্ক সহ পোষ্টের বাহবা/দায়, মূল লেখকের।
বিএনপি-জামায়াত জোট আবার হরতাল ডেকেছে। ৩৬ ঘণ্টার হরতাল, কিন্তু গাড়ি পোড়ানো শুরু হয়ে যায় অন্তত ২০ ঘণ্টা আগে থেকে। তাহলে হরতালের তারিখ ঘোষণার দরকার কী? যখন-তখন গাড়ি পোড়াবে, পেট্রলবোমা মারবে, মানুষ হত্যা করবে। এই যদি বিএনপির দেশরক্ষার আন্দোলন হয়, তাহলে দেশ ধ্বংসের আন্দোলন কাকে বলব? বিগত হরতাল শুরুর আগের রাতে হাতিরঝিল প্রকল্পের রাস্তায় গাড়িতে পেট্রলবোমা মেরে যে তিনজনের শরীর ঝলসে দেওয়া হয়, তাঁরা বিএনপির সমর্থক ডাক্তার বলে একটি পত্রিকায় খবর ছাপা হয়েছিল। খুবই দুঃখজনক। নিজেরাই নিজেদের মারছে! অবশ্য তাঁরা কোন দলের, সেটা বড় কথা নয়, তাঁরা মানুষ, তাঁদের হত্যার উদ্দেশ্যে পেট্রলবোমা মারা হয়েছিল, সেটাই মূল কথা। এই হলো বিএনপি-জামায়াতের হরতালের চেহারা। মানুষ বাঁচানোর জন্য কথা বলে মানুষ মারে! বিএনপির রাজনীতি এই স্ববিরোধিতায় ঘুরপাক খাচ্ছে।
এর আগে গত রোববার বগুড়ায় সমাবেশে বিএনপির চেয়ারপারসন হুমকির সুরে বলেছেন, সেনাবাহিনী সময়মতোই দায়িত্ব পালন করবে। এটাও এক বড় স্ববিরোধিতা। যাঁরা প্রধান বিরোধী দল বিএনপির ঘোর বিরোধী, তাঁরা হয়তো বলবেন, স্ববিরোধিতা কোথায়, বিএনপির জন্মই তো ক্যান্টনমেন্টে। তাই সেনাছাউনির প্রতি তাদের অতিরিক্ত আকর্ষণ স্বাভাবিক ব্যাপার। এখানে আবার বৈপরীত্য দেখলেন কোথায়?
কিন্তু এ ধরনের বিচার ঠিক নয়। জেনারেল জিয়া সেনাশক্তি ব্যবহার করে বিএনপি গঠন করলেও গত ৩৫ বছরের রাজনৈতিক ঘটনাপ্রবাহে তাদের মৌলিক রূপান্তর ঘটেছে। বিশেষভাবে আশির দশকে এরশাদের সামরিক স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন ও পরবর্তীকালে চারটি নির্বাচনের মধ্য দিয়ে তাদের দলের যথেষ্ট গণতন্ত্রায়ণ ঘটেছে। দুইবার সরকার গঠন করেছে। বিএনপির চেয়ারপারসন দুইবার প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। এ প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে তাদের দলের সেনাসম্পৃক্তির জন্মদাগটি মুছে গেছে। সুতরাং সেনা জুজুর ভয় দেখানো তাদের রাজনীতির সঙ্গে এখন আর যায় না।
‘সেনাবাহিনী সময়মতোই তাদের দায়িত্ব পালন করবে’ বলে খালেদা জিয়া হুমকি দেওয়ায় মানুষ অবাক হয়েছে এ কারণে যে, মাত্র কয়েক দিন আগেই ১৫ মার্চ মুন্সিগঞ্জের লৌহজংয়ে এক সমাবেশে তিনি পুলিশ বাহিনীর উদ্দেশে বলেছিলেন, আন্দোলন দমনের জন্য নির্বিচারে গুলি চালালে জাতিসংঘ শান্তিরক্ষী বাহিনীতে তাদের আর যাওয়া হবে না। যদি তাই হয়, তাহলে সেনাবাহিনীকে তিনি রাজনৈতিক হস্তক্ষেপের উসকানি দিচ্ছেন কেন? এটা তো তাঁর স্ববিরোধিতা। তিনি কি চান যে তাঁর আগের বক্তৃতার কথা অনুযায়ী, পুলিশের মতো সেনাসদস্যরাও জাতিসংঘ শান্তিরক্ষী বাহিনীতে যাওয়ার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হোক? খালেদা জিয়া বলেছেন, ‘যে দেশের সেনাবাহিনী বিদেশে শান্তি রক্ষার জন্য কাজ করছে, সে দেশে যদি শান্তি না থাকে, তাহলে বিদেশিরা বলবে, তারা কীভাবে শান্তি রক্ষার জন্য কাজ করবে? কাজেই চিন্তার বিষয় আছে। আপনাদের সবাইকে এটা চিন্তা করতে হবে।’ তিনি কার্যত সেনাবাহিনীকে তাঁর ভাষায় বিতর্কিত পুলিশের ভূমিকায় নামার আমন্ত্রণ জানাচ্ছেন। যে ভূমিকার জন্য পুলিশের কপালে দুর্ভোগ নেমে আসার কথা বলছেন, সেই একই ভূমিকায় তিনি সেনাবাহিনীকে নামতে বলছেন! এটা কি কোনো দায়িত্বশীল রাজনৈতিক দল চাইতে পারে?
অবশ্য খালেদা জিয়ার বক্তব্য পত্রিকায় ‘ভিন্নভাবে’ এসেছে বলে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব দাবি করেছেন। কিন্তু তাঁর কথা বাস্তবতার সঙ্গে সংগতিপূর্ণ নয়।
সম্প্রতি বিএনপি এমন কতগুলো পদক্ষেপ নিচ্ছে, যা তাদের রাজনৈতিক স্থিরতা সম্পর্কে সন্দিহান করে তোলে। বিএনপি বলছে তারা মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষের দল, কিন্তু তারা একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতাকারী জামায়াতে ইসলামীকে তাদের জোটের অন্যতম শরিক হিসেবে রেখেছে। তারা বিভিন্ন সময় বলছে, যুদ্ধাপরাধ ও মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার তারা চায়, কিন্তু সেই বিচার হতে হবে ‘আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন ও নিরপেক্ষ’। কিন্তু এই আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন বিচার যে কী জিনিস, তা বোঝা মুশকিল। কারণ, জামায়াতে ইসলামী যখন বলে, বিচারে সাজা দেওয়া হলে দেশে গৃহযুদ্ধ শুরু হবে, তখন বিএনপি কিছু বলে না। কিন্তু শাহবাগে প্রজন্ম চত্বর থেকে যুদ্ধাপরাধের সর্বোচ্চ শাস্তির কথা উচ্চারিত হলেই বলে, বিচার প্রভাবিত করা হচ্ছে, আন্তর্জাতিক মান আর থাকল না। বিএনপি-জামায়াতের বিবেচনায় অভিযুক্তরা বেকসুর খালাস হলেই হয়তো তাদের ভাষায় বলা হবে যে বিচার আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন হয়েছে! এটা না হলেই মান আর থাকবে না।
এর আগে বিএনপি বলেছে যে ওরা সব যুদ্ধাপরাধের বিচার করবে। এখানে ‘সব’ কথাটি তাৎপর্যপূর্ণ। তাদের অভিযোগ হলো, যুদ্ধাপরাধ ও মানবতাবিরোধী অপরাধের অনেক নায়ক আওয়ামী লীগের ভেতরেই রয়েছে, তাদেরও বিচার করা হবে। এটা ভালো কথা। এতে অন্তত কিছু লাভ হয়েছে। আওয়ামী লীগের সাবেক একজন নেতাকে সম্প্রতি ধরে মানবতাবিরোধী অপরাধে অভিযুক্ত করা হয়েছে। আওয়ামী লীগ তাঁকে দল থেকে অনেক আগেই বহিষ্কার করেছিল।
কিন্তু সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীসহ বিএনপির দুজন নেতার বিরুদ্ধে যে মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার চলছে, তাঁদের ব্যাপারে দল হিসেবে বিএনপি কী করছে? তারা হয়তো বলবে অপরাধ প্রমাণিত না হলে কেন ব্যবস্থা নেব? তা তো ঠিকই। মামলা হলেই তো কেউ অপরাধী হয়ে যান না। কিন্তু বিএনপি যদি বলত, বিচারের রায় না হওয়া পর্যন্ত তাঁদের সদস্যপদ স্থগিত থাকবে, তাহলেও বোঝা যেত বিএনপি আন্তরিকভাবেই যুদ্ধাপরাধের বিচার চায়।
একদিকে বলছে যুদ্ধাপরাধের বিচার চাই, আরেক দিকে বিভিন্ন সময় ট্রাইব্যুনাল বাতিলের দাবিও বিএনপি করেছে। আবার ১৩ মার্চ বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয় থেকে নেতা-কর্মীদের উদ্দেশে খালেদা জিয়া বলেছেন, সরকারের নির্দেশে পুলিশ গুলি করে মানুষ মেরেছে, তাই সরকারপ্রধানের বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে বিচার করা হবে। ট্রাইব্যুনালই যদি তাঁরা বাতিল করবেন, তাহলে সেই ট্রাইব্যুনালে আবার সরকারের বিচার করবেন কীভাবে? এ তো স্ববিরোধিতার চূড়ান্ত!
যুদ্ধাপরাধ ও মানবতাবিরোধী অপরাধ বলতে বিএনপি যে কী বোঝে, তা বলা মুশকিল। বিভিন্ন সময় তারা বলেছে, সরকারই গণহত্যা চালাচ্ছে। এই যে মাস খানেকের মধ্যে রাজনৈতিক সহিংসতায় ৭০-৮০ জনের মৃত্যু হলো, এর চেয়ে দুঃখজনক ঘটনা আর কী হতে পারে। কত মায়ের কোল খালি হয়েছে, স্ত্রী হারিয়েছেন স্বামীকে, সন্তান হারিয়েছে তার মা-বাবাকে। এই বেদনা অন্তহীন। এই সব হত্যার যথাযথ বিচার ও দোষী ব্যক্তিদের শাস্তি নিশ্চিত করতেই হবে। এর কোনো বিকল্প নেই।
কিন্তু যুদ্ধাপরাধের সঙ্গে একে গুলিয়ে ফেলার কোনো অবকাশ নেই। দুই অপরাধ একই পরিমাপে তুলনীয় নয়। রাজনৈতিক সহিংসতায় এত মৃত্যুকে কেউ যদি শব্দগত অর্থে মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ বলে অভিহিত করতে চান, কিছু বলার নেই। কিন্তু একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের সময় যে গণহত্যা চালানো হয়েছিল, যে ধরনের মানবতাবিরোধী অপরাধ পরিচালিত হয়েছিল, তার সঙ্গে এই সব রাজনৈতিক হানাহানিকে যে একই কাতারে দাঁড় করানো চলে না, সেটা বোঝার জন্য কি খুব বেশি বুদ্ধি খরচ করতে হয়? অথচ বিএনপি অনেক সময় সবগুলোকেই গণহত্যা বলে চালিয়ে দিতে চায়। তারা গণহত্যার সংজ্ঞাও কি জানে না? নাকি জামায়াতকে খুশি রাখার জন্য মৃত্যুর সংখ্যার বিচারে গণহত্যার সংজ্ঞা নির্ধারণ করতে চায়? তাই যদি হয়, তাহলে জেনারেল জিয়ার আমলে বিভিন্ন ব্যর্থ অভ্যুত্থানের দায়ে সামরিক ট্রাইব্যুনালের বিচারে যে শত শত সৈনিককে ফাঁসিতে ঝোলানো হয়েছিল, তাকে কী বলবে তারা? সেগুলোও কি গণহত্যা? মানবতাবিরোধী অপরাধ? তারও বিচার কি তারা আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে করবে?
জোটে থাকার কারণে জামায়াতের অনেক অন্যায় ও অপরাধমূলক কার্যক্রম বিএনপির মাথায় বোঝা হয়ে চেপে বসছে। যেমন, এযাবৎ হরতাল তো কম হয়নি। কিন্তু এর আগে কোনো হরতালে কি রেললাইন উপড়ে ফেলা হয়েছে? রেলে আগুন দিয়েছে কেউ? এটা তো ভয়ংকর নাশকতামূলক কাজ। দেশের মানুষের জন্য বিন্দুমাত্র দরদ থাকলে কেউ রেললাইন উপড়ে ফেলে নিরীহ যাত্রীদের জীবন নিয়ে ছিনিমিনি খেলতে পারে না। জামায়াত-শিবির এ ধরনের নাশকতামূলক কাজ করছে বলে অভিযোগ উঠেছে।
আরেকটি বড় অপরাধ হলো গাছ উপড়ে ফেলা। জলবায়ু পরিবর্তনের এই দুঃসময়ে যখন সবাই গাছ লাগানোর সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলেছে, তখন হরতাল করার জন্য রাতের অন্ধকারে একদল গাছঘাতক গাছ কেটে রাস্তা বন্ধ করছে। জামায়াত-শিবিরের লোকজন এসব অপরাধে অভিযুক্ত।
বিএনপি এই সব ঘোরতর অন্যায়ের দায় এড়াতে পারে না। ওরা গণতন্ত্রের আন্দোলন করছে বলে দাবি করে, আর জামায়াতের নাশকতামূলক অপতৎপরতার দায় নির্বিবাদে মেনে নিচ্ছে। একবারও কি তারা বলেছে যে, তোমরা রেললাইন উপড়ে ফেলো না, গাছ ধ্বংস কোরো না? না, সে রকম কোনো মনোভাব তাদের নেই। বরং তারা হয়তো মনে করে, গাছ কেটেছে বেশ করেছে, আরও কাটুক! এটা বিএনপির বড় স্ববিরোধিতা।
বিএনপির রাজনৈতিক স্ববিরোধিতা দূর করার প্রথম ও প্রধান শর্ত হলো জামায়াতকে তাদের জোট থেকে বাদ দেওয়া। তাহলে হয়তো তাদের সামনে সম্ভাবনার এক নতুন দরজা খুলে যাবে।
©somewhere in net ltd.