নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
লিন্ক সহ পোষ্টের বাহবা/দায়, মূল লেখকের।
আমার তখন ১৭ বছর বয়স। আমার নাম ছিল মীরা বণিক। যুদ্ধের আগুনে পুড়ে আমি এখন কেয়া বিশ্বাস। আমার বাবার নাম ছিল রূপলাল বণিক। মায়ের নাম শৈলবালা বণিক। যুদ্ধের ঝড়ে তারা হারিয়ে গেছে!
একাত্তরের একদিনের কথা বলছি। পাকিস্তান সেনাবাহিনীসহ এ দেশীয় দোসরদের একটি দল গোপালগঞ্জের বণিকপাড়ায় এসে পৌঁছে। পাড়ায় ঢুকেই তারা নির্বিচারে ঘরবাড়ি পোড়াতে থাকে। আমাদের বাড়িও এর থেকে রেহাই পেল না। আমার মা-বাবা আমার ছোট ছোট ভাই-বোনদের নিয়ে আত্মরক্ষার জন্য এদিক সেদিক ছুটছিল। আমি ভয়ে ঠাকুরদাকে (গোপাল বণিক) জড়িয়ে ধরি। এক পাকিস্তানি সৈন্য এসে আমাকে একটা টান দিয়ে ঠাকুরদার কাছ থেকে ছাড়িয়ে নিল। ঠাকুরদা আমাকে ছেড়ে দেয়ার জন্য অনুনয় করতে থাকলে তাকে সঙ্গে সঙ্গে গুলি করল। চোখের সামনে দাদু আমার ছটফট করতে করতে মারা গেলেন। তারপর ওরা আমাকে টেনেহিঁচড়ে আমাদের গ্রাম থেকে আধা মাইল দূরে পাকিস্তানি বাহিনীর দিগনগর ক্যাম্পে নিয়ে গেল। যাওয়ার আগে আমাদের বাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেয়। একাত্তরে নির্যাতনের কথা জানতে চাইলে ভোরের কাগজের কাছে এভাবেই কষ্টগাঁথা মেলে ধরলেন সর্বস্ব হারানো কেয়া বিশ্বাস। ছলছল চোখে এই মা বলেন, বাঁচার জন্য অনেক চিৎকার করে মাফ চাইলাম, ছাইড়া দিতে কইলাম। ওদের দয়া হলো না। উল্টো মজা করতেছিল মালাউনের বাচ্চা বলে বলে। ক্যাম্পে আমার ওপর চললো পাশবিক নির্যাতন।
মাঝে মাঝে ভাবতাম, আত্মহত্যা করে জীবনটা শেষ করে দেই। কিন্তু সেই সুযোগ পাইনি। মাসখানেক পর মুক্তিবাহিনী ক্যাম্পটি দখল করে উদ্ধার করে আমাদের। তখন আমি গুরুতর অসুস্থ, বলতে গেলে মরা মানুষ। উদ্ধার হওয়ার পর মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্পে নানা ধরনের সেবা করেছি।
১৬ ডিসেম্বর দেশ স্বাধীন হয়। এরপর বাড়ি গিয়ে দেখি বিরানভূমি হয়ে গেছে! কোথাও কেউ নেই! শুনেছি সবাই ভারতে চলে গেছে। বুকটা তখন কান্নায় হু হু করে উঠেছে। চারদিক যেন অন্ধকার লাগছিল। আমার কোনো আশ্রয় নেই! কিন্তু দয়া হয় একজনের। তিনি মুক্তিযোদ্ধা রোকনুদ্দিন মোল্লা। নিজের মেয়ের মতো তার বাড়িতে আশ্রয় দেন।
তখন আমার মুক্তিযোদ্ধা ভাইদের অনুরোধে তিনি স্বাধীনতার মাসখানেক পরে আমাকে বিয়ে দেন মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল আলী বিশ্বাসের সঙ্গে। সেও ৮ নম্বর সেক্টরে হেমায়েত বাহিনীর হয়ে যুদ্ধ করেছিলেন। তিনি গত ৬ বছর আগে মৃত্যুবরণ করেন।
মুক্তিযুদ্ধ করলেও যার নাম মুক্তিযোদ্ধার তালিকায় নেই। আর মানইজ্জত সব হারিয়েও আমার নামও কোথাও কোনো তালিকায় নেই। তিনি বেঁচে থাকতে জীবন দুঃখ কষ্টে কেটে গেছে। কিন্তু এখন আমার জীবন বিপন্ন হয়ে পড়েছে।
স্বাধীনতার জন্য ইজ্জত হারাইলাম, স্বজন হারাইলাম। কিন্তু অপমান ছাড়া কিছুই পাইনি। একটু সাহায্যের জন্য যে যেখানে বলেছে, দৌড়াই গেছি। হতাশা নিয়ে ফিরে এসেছি।
দেশের জন্য স্বজন ও ভিটেমাটি হারালাম, মান গেল, ইজ্জত গেল। বলতে গেলে জীবন লণ্ডভণ্ড হয়ে গেল। নিঃস্বতা নিয়ে অনেকের দ্বারে দ্বারে ঘুরেছি, এখনো ঘুরছি। কিন্তু কেউ পাশে দাঁড়াচ্ছে না। সাহায্য করছে না। এমনকি বীরাঙ্গনার তালিকাতেও আমার নাম নেই, মুক্তিযোদ্ধা তালিকাতেও নেই। এতো হারানোর পরও কোথাও তালিকাভুক্ত হলাম না! এটা কি আমার প্রতি অন্যায় নয়?
আমার শেষ ইচ্ছা মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয় আমার নাম তালিকাভুক্ত করুক। আমাকে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে সম্মান দিক। এই সম্মান না পেলে মরেও শান্তি পাব না।
কেয়া বিশ্বাস বলেন, এক কন্যাসহ ৩ ছেলে নিয়ে ৪৪ বছর ধরে খেয়ে-না খেয়ে জীবনযাপন করতেছি। নানা রকম রোগবালাই বাসা বেঁধেছে শরীরে। দেখার কেউ নেই!
একটু ভালো করে বাঁচার আশায় কতদিকে দৌঁড়াচ্ছি, কোনো লাভ হচ্ছে না। শুনেছি, বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা অনেক দয়ালু। মানুষের দুঃখে পাশে দাঁড়ান। তিনি কি একবার এ অভাগাদের পাশে দাঁড়াবেন?
শুনেছি, তিনি আমাদের মুক্তিযোদ্ধার সম্মান দিয়েছেন। কথাটা শুনে সীমাহীন কষ্টের মাঝেও খুশি লাগছে। তারপরও মনের কষ্টে মাঝে মাঝে ভাবি, দেশ স্বাধীন হইয়া লাভ কী হইল? আমরা কি এমন দেশের স্বপ্ন দেখেছিলাম? আমি আজ পথে পথে ঘুরতাছি। এইডা তো উচিত বিচার হইতাছে না?
যুদ্ধাপরাধী রাজাকাররাই তো আমাদের পাকিস্তানিদের হাতে তুলে দিছে। তারা কি আমাদের চিনত? ওই জানোয়ার যুদ্ধাপরাধীর বিচার হইতাছে এতে অনেক খুশি লাগতাছে। যা বলে বুঝাইতে পারব না।
কিন্তু দুয়েকজনকে নয়, সবগুলারে ধরে ধরে ফাঁসি দিতে হবে। তবেই শান্তি পাব।
সূত্র
২| ০৮ ই ডিসেম্বর, ২০১৫ সকাল ৮:৫৩
০১৭৫৯০৮৭৫১৫ বলেছেন: সত্যিকারের মুক্তিযোদ্ধাদের মূল্যায়ন আজো হয়নি, আগামীতে হবে কিনা জানি না, খুবই কষ্ট পেলাম লেখাটি পড়ে।
৩| ০৮ ই ডিসেম্বর, ২০১৫ সকাল ৯:৪০
মাকড়সাঁ বলেছেন: আবার ইতিহাস মনে করিয়ে দিলেন।
৪| ০৮ ই ডিসেম্বর, ২০১৫ সকাল ১০:০১
প্রামানিক বলেছেন: রাজাকারদের ফাঁসির পাশাপাশি এই মহিলারও একটা ব্যবস্থা হওয়া দরকার।
©somewhere in net ltd.
১| ০৮ ই ডিসেম্বর, ২০১৫ সকাল ৭:২৪
চাঁদগাজী বলেছেন:
সঠিক শাস্তি দেয়া হয়নি রাজাকরদের ও পাকীদের, এই কস্ট রয়ে যাবে মনে।