নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

যাহা বলিব সত্য বলিব

আল্লাহ মহান, যাহা বলিব সত্য বলিব।

তালপাতারসেপাই

লিন্ক সহ পোষ্টের বাহবা/দায়, মূল লেখকের।

তালপাতারসেপাই › বিস্তারিত পোস্টঃ

বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করেছে জামায়াতি দুর্বৃত্তরাই

১৫ ই ডিসেম্বর, ২০১৫ ভোর ৬:৩১


মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের অবমুক্ত করা গোপন দলিলপত্রে একাত্তরের ডিসেম্বরের বুদ্ধিজীবী হত্যা সম্পর্কে তিনটি নতুন বিষয় উদ্ঘাটিত হয়েছে। প্রথমত, ভারতীয়দের কাছে পাকিস্তানি সেনাদের আত্মসমর্পণের শর্ত যাতে ‘ন্যায্য’ হয়, সেটা নিশ্চিত করতে প্রায় ৩০০ বুদ্ধিজীবীকে জিম্মি করার পরিকল্পনা করা হয়েছিল। দ্বিতীয়ত, কিছুসংখ্যক বুদ্ধিজীবীকে বিহারি ক্যাম্পে অন্তরীণ রাখা হয়েছিল এবং তাঁদের জানুয়ারির শেষ সপ্তাহে হত্যা করা হয়। তৃতীয়ত, পাকিস্তানিরা ওয়াশিংটনের কাছে অভিযোগ করেছিল যে, মুক্তিযোদ্ধারাই প্রতিহিংসাপরায়ণ হয়ে বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করেছে।

এ সব অভিযোগ খতিয়ে দেখার নির্দেশ পাওয়ার পর ঢাকার তৎকালীন মার্কিন কনসাল হার্বাট ডি স্পিভাক এক তারবার্তায় নির্দিষ্টভাবে মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরকে জানান, ‘জামায়াতি দুর্বৃত্তরাই’ বাঙালি বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করেছে। এ-সংক্রান্ত বাক্যে স্পিভাক ‘জামায়াত থাগস’ বা জামায়াতি দুর্বৃত্ত শব্দটি ব্যবহার করেন। আর একই সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের বিরুদ্ধে বুদ্ধিজীবী হত্যার অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করে স্পিভাক বলেন, বুদ্ধিজীবীদের গ্রেপ্তার ও হত্যার সময় ঢাকা সম্পূর্ণভাবে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর নিয়ন্ত্রণে ছিল।

স্পিভাক বাংলাদেশে মার্কিন দূতাবাসের প্রথম ভারপ্রাপ্ত চার্জ দ্য অ্যাফেয়ার্স। মুক্তিযুদ্ধের বেশির ভাগ সময় তিনি মার্কিন কনসাল জেনারেল হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। জেনারেল নিয়াজি ও জেনারেল ফরমান আলী স্পিভাকের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেই প্রথম আত্মসমর্পণের আগ্রহ ব্যক্ত করেছিলেন।

পাকিস্তানি সেনাদের নিয়ন্ত্রণে: স্পিভাক মুক্তিযোদ্ধাদের বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ সম্পর্কে তারবার্তা পাঠিয়েছিলেন যে, ‘নিচের কারণগুলোই বলে দেয় যে, মুক্তিযোদ্ধাদের ওপর দোষ চাপানোটা সন্দেহজনক। প্রথমত, ১৪-১৫ ডিসেম্বর বুদ্ধিজীবী হত্যা ঘটে। এ সময়টায় পুরো ঢাকা শহরে কারফিউ বলবৎ ছিল এবং শহর ছিল পাকিস্তানি সেনাদের নিয়ন্ত্রণে। দ্বিতীয়ত, এই সময়ে শহরে যে মুক্তিবাহিনী ছিলেন, তেমন কোনো প্রমাণ নেই। তৃতীয়ত, যাঁরা নিহত হয়েছেন, তাঁদের কয়েকজনের নাম আমরা শনাক্ত করেত পেরেছি। তাঁরা কেউ রাজাকার ছিলেন না। তাঁদের বেশির ভাগই সুপরিচিত বাঙালি জাতীয়তাবাদী। যদিও তাঁরা মুক্তিযুদ্ধকালে শহরে ছিলেন, কিন্তু তাঁরা তাঁদের রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গির বহিঃপ্রকাশ ঘটাননি।’ স্পিভাক এই বার্তায় তাঁর বক্তব্যের সপক্ষে প্রমাণ হিসেবে মুনীর চৌধুরী, ফজলে রাব্বি, শহীদুল্লা কায়সার, সিরাজুদ্দীন হোসেন, এ এস মান্নান (অবজারভার-এর সহসম্পাদক), নিজামুদ্দীন আহমেদ, অধ্যাপক এ খায়ের ও ড. আলীম চৌধুরীর নাম উল্লেখ করেন।

১৯৭২ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি স্পিভাক অপর এক বার্তায় লেখেন, ‘গত নয় মাসে বুদ্ধিজীবীদের ভাগ্যে কী ঘটেছে, তা জানতে ওয়াশিংটন এবং অন্যত্র অব্যাহতভাবে আগ্রহ লক্ষ করার প্রেক্ষাপটে সংবাদপত্রে প্রকাশিত এ-সংক্রান্ত একটি নিবন্ধের ক্লিপিং পাঠানো হলো।’ এটি ছিল মর্নিং নিউজ পত্রিকায় ২১ ফেব্রুয়ারি ১৯৭২ প্রকাশিত একটি নিবন্ধ। তবে সংশ্লিষ্ট ফাইলে ওই ক্লিপিংটি পাওয়া যায়নি। স্পিভাক লিখেছেন, ‘বিশেষ সংবাদদাতা পরিবেশিত ওই খবরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কেন্দ্রিক বুদ্ধিজীবী নিধনের ওপর আলোকপাত করা হয়।’

স্পিভাক ১৯৭২ সালের ১৭ জানুয়ারির এক তারবার্তায় উল্লেখ করেছিলেন যে, শেখ মুজিব গণপরিষদে দেওয়া বক্তৃতায় আগামী ৩১ জানুয়ারির মধ্যে মুক্তিযুদ্ধকালে সংঘটিত নিষ্ঠুরতা বিষয়ে প্রতিবেদন জমা দিতে নির্দেশ দিয়েছেন।

নৃশংসতা ও রাজাকার: ১৯৭২ সালের ২ ফেব্রুয়ারি স্পিভাকের একটি তারবার্তার শিরোনাম ছিল: ‘নৃশংসতা ও রাজাকার’। এটা পাঠানো হয়েছিল মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তর থেকে ঢাকায় পৌঁছানো একটি তারবার্তার বরাতে। স্টেট নামের বার্তাটিতে কী আছে, জানা যায়নি। স্পিভাক লিখেছেন, ‘যুদ্ধ শেষ হওয়ার দিকে ২০০ থেকে ৩০০ বুদ্ধিজীবীকে হত্যা করা হয়। অন্যান্য শহর থেকেও এ রকম খবর পাওয়া যাচ্ছে, তবে নিশ্চিত হওয়া যাচ্ছে না। এ তালিকার সবাই বাঙালি। কিন্তু সাধারণভাবে তাঁরা রাজনৈতিকভাবে নিষ্ক্রিয় ছিলেন। তাঁদের মৃত্যুর প্রেক্ষাপট সম্পর্কে আমরা বিস্তারিত জানাতে অপরাগ। তবে তাঁদের অধিকাংশকে ১১ থেকে ১৫ ডিসেম্বরের মধ্যবর্তী সময়ে তাঁদের বাড়ি থেকে গ্রেপ্তার করা হয়।’

কারা গ্রেপ্তার করেছিল, সে সম্পর্কে স্পিভাক ওই তারবার্তায় বলেন, ‘সশস্ত্র ব্যক্তিরা। এদের সঙ্গে উর্দিধারী সশস্ত্র সৈনিকেরা ছিলেন।’ স্পিভাকের বিবরণ অনুযায়ী, সংবাদপত্র, মার্কিন কনসাল জেনারেল অফিসের কর্মী ও মার্কিন সংবাদদাতারা ঢাকায় প্রায় ২০টি মরদেহ দেখেছেন এবং তাঁরা নিশ্চিত করেছেন যে, হত্যা করার আগে তাঁদের প্রতি নির্যাতন চালানো হয়েছিল।

মার্কিন কনসাল স্পিভাক তাঁর ওই তারবার্তায় উল্লেখ করেন যে, মার্কিন তথ্যকেন্দ্র ইউসিস-এর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা রিপোর্ট করেছেন যে, বেশ কিছু নিখোঁজ বুদ্ধিজীবীকে মোহাম্মদপুর-বিহারিশিবিরে আটকে রাখা হয়েছিল। ২৮ জানুয়ারির (১৯৭২) সাম্প্রতিক সংঘর্ষকালে তাঁদের হত্যা করা হয়।

নৃশংসতা ও রাজাকার শীর্ষক ওই তারবার্তায় স্পিভাক ১৯ শহীদ বুদ্ধিজীবীর নাম দেন। মুনীর চৌধুরী, মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী, আনোয়ার পাশা, আবুল খায়ের, সন্তোষ ভট্টাচার্য, গিয়াসউদ্দিন আহমেদ, রাশিদুল হাসান, সিরাজুল হক খান, মোহাম্মদ মর্তুজা, সিরাজুদ্দীন হোসেন, শহীদুল্লা কায়সার, নিজামুদ্দিন আহমেদ, নাজমুল হক, এ এস মান্নান, গোলাম মোস্তফা, ফজলে রাব্বি, আলীম চৌধুরী, আবুল কালাম আজাদ ও আমিনুদ্দিন।

এই তারবার্তায় স্পিভাক তথ্য দেন যে, ‘আমরা মৌলভি ফরিদ আহমেদ ও অন্যান্য দক্ষিণপন্থী রাজনীতিককে গ্রেপ্তারের খবর পেয়েছি। মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে সম্পর্কিত কনসাল জেনারেলের অফিসের স্থানীয় কর্মীদের দ্বারা এ বিষয়ে নিশ্চিতও হয়েছি। তবে আমরা জানতে পেরেছি যে, রাজাকারির দায়ে ইতিমধ্যেই অনেককে অন্তরীণ করা হয়েছে। তাঁদের শিগগিরই বিচারের মুখোমুখি করা হবে।’ এই তারবার্তার উপসংহারে স্পিভাক বলেন, ‘ঢাকার প্রেস অব্যাহতভাবে নতুন নৃশংসতার খবর ছাপছে। ১৯৭২ সালের ৩১ জানুয়ারি কুমিল্লা সেনানিবাসে গণকবর পাওয়া গেছে। তবে এটা খুবই বিরক্তিকর যে, কিছু সংবাদপত্র হত্যাকাণ্ডের নায়কদের প্রতি মার্কিন সমর্থনের অভিযোগ করেই চলেছে।’

উল্লেখ্য, স্পিভাক এ বিষয়ে ঢাকা ৩২৮ ক্রমিকে একটি তারবার্তা পাঠিয়েছিলেন। এটিও পাওয়া যায়নি।

জিম্মি: শহীদ বুদ্ধিজীবীদের ব্যাপকভিত্তিক গ্রেপ্তারের সঙ্গে যে আত্মসমর্পণের শর্তসম্পর্কিত দর-কষাকষির যেকোনো সম্পর্ক থাকতে পারে, তা সম্ভবত স্পিভাকের তারবার্তা থেকেই প্রথম জানা যাচ্ছে। জেনারেল নিয়াজি ও জেনারেল ফরমান আলী তাঁদের যৌথ স্বাক্ষরে আত্মসমর্পণের বার্তা স্পিভাকের কাছে প্রথম একাত্তরের ১৪ ডিসেম্বরেই প্রথম দিয়েছিলেন।

স্পিভাক ১৯৭১ সালের ১৮ ডিসেম্বর ঢাকা ৫৬৯৬ ক্রমিকের অপর এক তারবার্তায় লিখেছেন, আত্মসমর্পণের দুই দিন আগে ঢাকার পশ্চিমে একটি মাঠের মধ্যে ৩০টির মতো গলিত মরদেহ পাওয়া গেছে। সেখানে ইট পোড়ানো হয়। মনে করা হয় যে, এসব মরদেহের মধ্যে বুদ্ধিজীবীদের অনেকে থেকে থাকবেন। আত্মসমর্পণের শর্ত যাতে ন্যায্য হয়, সেটা নিশ্চিত করতে পশ্চিম পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর স্থানীয় সমর্থক ও রাজাকাররা প্রায় ৩০০ বুদ্ধিজীবীকে ‘জিম্মি’ করেছিল। আত্মসমর্পণের দুই দিন আগে অনেককে হত্যা করা হয়। স্থানীয় লোকজন বলছেন, ইটখোলা এলাকায় অনেককে ধরে এনে হত্যা করা হয়। কথিতমতে, রাজাকাররা এখনো ইটখোলা দখলে রেখেছেন।

প্রতিশোধ: ১৮ ডিসেম্বর ঢাকা ৫৬৯৩ তারবার্তায় স্পিভাক লেখেন, ঢাকায় সহিংসতার প্রকোপ কমে এসেছে, কিন্তু “বিহারি” এবং “কোলাবরেটরদের” বিরুদ্ধে কিছু প্রতিশোধপরায়ণতা চলছে। একই সঙ্গে রাজাকারদের বাঙালি হত্যাও অব্যাহত আছে। বেশ কিছুদিনের বিরতিতে আজ ঢাকায় পত্রিকা বেরিয়েছে।

পল্টন ময়দানে কিছুক্ষণ আগে পাঁচ-ছয় হাজার লোকের সমাবেশ শেষ হয়েছে। নুরুল আলম সিদ্দিকীসহ ঢাকা, ময়মনসিংহ ও টাঙ্গাইলের মুক্তিযোদ্ধা অধিনায়কেরা বক্তব্য দিয়েছেন। বার্তা হলো, মুক্তযোদ্ধা ও রাজাকারেরা অস্ত্র জমা দেবেন। দেশ কে যে চালাচ্ছেন, তা বোঝা যায় না। কোনো জ্যেষ্ঠ নেতাকেই দেখা যায় না।

১৯ ডিসেম্বরে স্পিভাক ‘বাংলাদেশের মুজিবকে প্রয়োজন’ শীর্ষক একটি তারবার্তা (সিক্রেট ঢাকা ৫৭০২) পাঠান। এই বার্তায় স্পিভাক উল্লেখ করেন যে, পরিস্থিতি এখনো বিস্ফোরণোন্মুখ। চরম ডানপন্থী গোষ্ঠীর দ্বারা বুদ্ধিজীবীদের হত্যার খবর প্রকাশিত হওয়ার পর নতুন এক তিক্ততার স্রোত বয়ে যায়। এ ঘটনা পুনরায় গোষ্ঠীগত গণহত্যার হুমকি বৃদ্ধি করেছে।’

মুজিবই আশা: ১৭ ডিসেম্বর কলকাতার মার্কিন কনসাল গর্ডন লেখেন, ১৪ ডিসেম্বর ঢাকা কলেরা রিসার্চ ইনস্টিটিউটের ড. জন রোড কলকাতায় মার্কিন-সমর্থিত সাহায্য সংস্থার ভোলাগ প্রতিনিধিদের নিয়ে একটি বৈঠক ডেকেছিলেন। সেখানে প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের স্বরাষ্ট্র এবং ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের পরিকল্পনা শাখার প্রধান উপস্থিত ছিলেন। কেয়ার অনুপস্থিত ছিল। এর অংশত কারণ, পূর্ব পাকিস্তানে ধারণা আছে যে, তারা সামরিক সরকারকে সহায়তা দিয়েছিল।

জন রোড বিশ্বাস করেন যে, যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি খুব তিক্ততা থাকলেও এখন পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রে এবং তার মূল্যবোধ ও নীতির ওপর একটা মৌলিক বিশ্বাস আছে। এই মুহূর্তে যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্কে একটি ভালো কথা বলা বা মার্কিন কর্মকর্তাদের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপনের মতো ঝুঁকি বাংলাদেশ সরকারের উচ্চপর্যায়ে কেউ নেবেন না। ‘এ অবস্থা থেকে কেবল মুজিবই পরিত্রাণ দিতে পারেন।’ কলহবিবাদ এমন পর্যায়ে আছে যে, প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের অনেকেই দেশে ফিরে পদত্যাগ করতে চাইছেন।

মি. রোড তখন যুক্তি দেন যে, মুজিবই শুধু স্থিতিশীলতা আনতে পারেন; অন্তত একটি বছরের জন্য হলেও। তাঁকে যদি মুক্তি দিয়ে দেশে ফিরতে দেওয়া হয়, তাহলে উপদলীয় লড়াই অন্তত সাময়িকভাবে হলেও বন্ধ হবে। বাংলাদেশ নিয়ন্ত্রিত এলাকায় বাংলাদেশ সরকার ‘ভিসা’ দিতে প্রস্তুতি নিয়েছিল। এখন সব ভিসা অবশ্যই দিল্লিতে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় দ্বারা ছাড় হওয়া উচিত হবে। তাঁর সন্দেহ, বিদেশি সংবাদদাতাদের বাংলাদেশ সরকার যে দেশে ঢুকতে দিতে অনীহা দেখাচ্ছে, তার মূলে আছে ভীতি। বিহারিবিরোধী তৎপরতার খবর যদি তাঁরা লিখতে শুরু করেন, তাহলে বিশ্বজনমত বাংলাদেশের বিরুদ্ধে চলে যাবে। বাংলাদেশের প্রতি গভীর অনুরাগী জন রোড ব্যক্তিগতভাবে বিশ্বাস করেন, ‘বিহারিরা নিপীড়নের শিকার’। স্পিভাক ১৯৭২ সালের ৮ জানুয়ারি লেখেন, ‘গেরিলা নেতা আবদুল কাদের সিদ্দিকীকে গ্রেপ্তার করা নিয়ে প্রধানমন্ত্রী ও সেনাবাহিনীর মধ্যে দ্বন্দ্ব শুরু হয়ে গেছে। আত্মসমর্পণের পরদিন ঢাকা স্টেডিয়ামে তিনি দুজন কথিত রাজাকারকে হত্যা করেন। ভারতীয় সেনারা তাঁকে দুবার গ্রেপ্তার করে। দুবারই তাজউদ্দীনের হস্তক্ষেপে তিনি ছাড়া পান।’

কলকাতার মার্কিন কনসাল গর্ডন একাত্তরের ১৪ ডিসেম্বর বার্তা পাঠান যে, ‘১২ ডিসেম্বরের স্টেটসম্যান খবর দিয়েছে যে, ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম “গণবিরোধী ও সাম্প্রদায়িক তৎপরতার” দায়ে চারটি রাজনৈতিক দলকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেন। এগুলো হলো: পাকিস্তান ডেমোক্র্যাট পার্টি (পিডিপি), মুসলিম লীগ, জামায়াত-ই-ইসলামী ও নিজাম-ই-ইসলাম। আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধ করার পর পূর্ব পাকিস্তানের নির্বাচনে এসব দল অংশ নিয়েছিল। সন্দেহ করা হচ্ছে, বিশেষ করে হিন্দুদের প্রতি রাজাকারি তৎপরতার কারণেই মূলত তাদের নিষিদ্ধ করা হয়। ঢাকার পলিটিক্যাল অফিসারের সঙ্গে কথা বলে এই বার্তা পাঠানো হলো।’

স্পিভাক একাত্তরের ২৯ ডিসেম্বরের এক বার্তায় (ঢাকা ৫৮৩৭) লিখেছেন, ‘বঙ্গভবনে ঘণ্টাব্যাপী এক সংবাদ সম্মেলনে সৈয়দ নজরুল ইসলাম বলেন, রাজাকারদের বিচার করা হবে এবং কঠোরভাবে আইনি প্রক্রিয়া অনুসরণ করা হবে।’
সুত্র: Click This Link

মন্তব্য ১ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (১) মন্তব্য লিখুন

১| ১৫ ই ডিসেম্বর, ২০১৫ দুপুর ২:১৭

কারাবন্দি বলেছেন: ১৯৭২ সালের ৩০ জানুয়ারি মিরপুর যাওয়ার পর জহির রায়হান নিখোঁজ হন। জহির রায়হানের অন্তর্ধানকে হত্যাকান্ড হিসেবে বর্ণনা করে সেই হত্যাকান্ডের দায়-দায়িত্ব (তাদের ভাষায়) ‘রাজাকার’দের ওপর চাপিয়ে দেয়ার চেষ্টা করা হয়েছে। ২০০০ সালের ডিসেম্বরের তৃতীয় সপ্তাহে মেজর জেনারেল (অব.) হেলাল মোর্শেদ, মে. জে. (অব.) মঈন, মে. জে. (অব.) ইব্রাহিম প্রমুখ অফিসার বলতে চেয়েছেন যে, মিরপুরে ৩০ জানুয়ারি বিহারীদের গুলীতে তিনি নিহত হয়েছেন। কিন্তু জহির রায়হান অন্তর্ধান রহস্য ঘাঁটতে গিয়ে এমন কিছু ব্যক্তির এমন কতগুলো চাঞ্চল্যকর তথ্যের সন্ধান পাওয়া গেল যেগুলো পড়ে শরীরের লোম খাড়া হয়ে ওঠে। এসব তথ্য পাওয়া গেছে জহির রায়হানের শালী অভিনেত্রী ববিতা, জহির রায়হানের ভাবী আওয়ামী লীগের সাবেক সংসদ সদস্য পান্না কায়সার এবং ঘাদানিক নেতা শাহরিয়ার কবির প্রমুখের কাছ থেকে। এছাড়াও এদের জবানীতে সত্যজিৎ রায় এবং শেখ মুজিবের যেসব উক্তি উদ্ধৃত করা হয়েছে সেসব পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যে, জহির রায়হান ৩০ জানুয়ারি মৃত্যুবরণ করেননি। তার পরেও বেশ কয়েকদিন তাকে বাঁচিয়ে রাখা হয়েছিল। এদের বক্তব্য থেকে বোঝা যায় যে, তিনি বাংলাদেশে এবং ভারতীয় সেনাবাহিনীর বেষ্টনীর মধ্যেই ছিলেন।
ঘটনা পরম্পরা পর্যালোচনা করলে তার মৃত্যুর দায়-দায়িত্ব তৎকালীন প্রশাসনকেই গ্রহণ করতে হয় এবং (তাদের ভাষায়) রাজাকার বা দালালদের ওপর কোনভাবেই চাপানো যায় না। এই কলামে নিজস্ব মন্তব্যের পরিবর্তে ওপরে উল্লেখিত ব্যক্তিবর্গের উদ্ধৃতি এবং মন্তব্য ব্যাপকভাবে তুলে ধরা হচ্ছে। বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিবেশ যখন অপপ্রচার এবং উস্কানিমূলক প্রচারণার বিষবাষ্পে আচ্ছন্ন তখন এসব ব্যক্তিবর্গের সেদিনের উক্তি এবং আজকের ভূমিকা মিথ্যা প্রচারণায় বিভ্রান্ত মানুষকে সত্যের আলোকবর্তিকা দেখাতে সাহায্যে করবে।


॥ দুই ॥
সেই সময়কার সরকার নিয়ন্ত্রিত সাপ্তাহিক ‘বিচিত্রায়’ বিশ্ববিখ্যাত চলচ্চিত্রকার সত্যজিৎ রায়ের একটি সাক্ষাৎকার ছাপা হয়েছিল। সংখ্যাটি ছিল ১৯৯২ সালের ১ মে। সাক্ষাৎকারটি নিয়েছিলেন আজকের আওয়ামীপন্থী বুদ্ধিজীবী ঘাদানিক সংগঠক শাহরিয়ার কবির। তাদের সংলাপের অংশবিশেষ নিচে তুলে ধরা হলো। সাক্ষাৎকারের একপর্যায়ে সত্যজিৎ রায় শাহরিয়ার কবিরকে হঠাৎ করে জিজ্ঞেস করলেন…
-“জহিরের ব্যাপারটা কিছু জেনেছো?”
শাহরিয়ার কবির, “তাকে সরিয়ে ফেলার পেছনে ষড়যন্ত্র রয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে। আমরা ব্যক্তিগতভাবে তদন্ত করে যা বুঝতে পেরেছি তাতে বলা যায়, ৩০ জানুয়ারি দুর্ঘটনায় তিনি হয়তো মারা যাননি। তারপরও দীর্ঘদিন তাকে বাঁচিয়ে রাখা হয়েছিল বলে অনেকে মনে করেন। সেটাই ষড়যন্ত্রের মূলসূত্র বলে ধরছি। মিরপুরে দুর্ঘটনায় তার মৃত্যু হলে গভীর ষড়যন্ত্র মনে করার কোনো করণ ছিল না। আমি যতদূর জানি, বুদ্ধিজীবীদের হত্যার তদন্ত করতে গিয়ে তিনি এমন কিছু তথ্য সংগ্রহ করেছিলেন যা অনেক রথী-মহারথীর জন্যই বিপজ্জনক ছিল, যে জন্য তাকে সরিয়ে ফেলার প্রয়োজন হয়েছিল।”
১৯৯২ সালেও শাহরিয়ার কবির মনে করতেন যে, জহির রায়হানকে ১৯৭২ সালের ৩০ জানুয়ারির পরেও দীর্ঘদিন বাঁচিয়ে রাখা হয়েছিল। তাহলে ঘাদানিক নেতৃবৃন্দ এবং আওয়ামী বুদ্ধিজীবীরা বলুন যে, স্বাধীন বাংলাদেশে জহির রায়হানকে আটকে রাখার ক্ষামতা ছিল কাদের? বলা হচ্ছে যে, বুদ্ধিজীবী হত্যার তদন্ত করতে গিয়ে জহির রায়হানের হাতে এমন কিছু তথ্য এসেছিল যেটা রথী-মহারথীদের জন্য ছিল বিপজ্জনক। স্বাধীন বাংলাদেশে আওয়ামী সরকারের আমলে কারা ছিলেন রথী-মহারথী? যে বিপজ্জনক তথ্যের জন্য তাকে সরিয়ে ফেলার প্রয়োজন হয়েছিল সেসব তথ্য কাদের জন্য বিপজ্জনক ছিল? তাদের ভাষায় ‘রাজাকার’ এবং ‘পাকিস্তানী দালালদের’ রাজনীতি তো নিষিদ্ধ করা হয়েছিল। কারা তাহলে জহির রায়হানকে সরিয়েছে? যুদ্ধাপরাধী বা দালালদের বিচার করতে গেলে এসব প্রশ্ন এসে পড়বে।


॥ তিন ॥
পান্না কায়সার সাবেক আওয়ামী এমপি। জহির রায়হানের বড় ভাই পরলোকগত শহীদুল্লাহ কায়সারের স্ত্রী। বাংলা ১৩৯৯, ১০ জৈষ্ঠ্য, ইং ১৯৯২ দৈনিক ‘বাংলার বাণী’তে তিনি একটি প্রবন্ধ লিখেছিলেন। প্রবন্ধের শিরোনাম ছিল ‘কবিতা মিলনকে মিথ্যা সান্ত¦না’। এই নিবন্ধে তিনি তৎকালীন প্রেসিডেন্ট আবু সাঈদ চৌধুরীর স্টাফ আফিসার লেফটেন্যান্ট সেলিম সম্পর্কে কিছু তথ্য দিয়েছেন। আলোচ্য নিবন্ধের এক স্থানে পান্না কায়সার বলেছেন, “৩০ জানুয়ারি জহির রায়হান একটি ফোন পেয়ে মিরপুরে ছুটে গিয়েছিলেন। একথা বহুবার লেখা হয়েছে, বলা হয়েছে। কিন্তু বলা হয়নি সেলিমের কথা। সেলিমও নাকি সেরকমই একটি ফোন পেয়ে প্রেসিডেন্ট আবু সাঈদকে না বলেই জহির রায়হানের সঙ্গে মিরপুরে ছুটে গিয়েছিলেন। তারপর দু’জনের ভাগ্যে একই নিষ্ঠুর পরিণতি। দু’জনই নিখোঁজ। সেলিমের মা এ সংবাদ পেয়ে প্রেসিডেন্ট আবু সাঈদ চৌধুরীর কাছে ছুটে গিয়েছিলেন। সেলিম বঙ্গভবনের যে ঘরটিতে থাকতেন ইত্যবসরে সে ঘর থেকে সমস্ত কাগজপত্র, কাপড়-চোপড় উধাও। শহীদ সেলিমের মা অনেক কষ্ট করেও কোন রহস্য উদঘাটন করতে পারেননি। রহস্য রহস্যই থেকে গেল। জহির রায়হান নিখোঁজ হবার পর বুদ্ধিজীবী হত্যার কোন কাগজপত্র খুঁজে পাওয়া যায়নি। কাগজগুলোর কোন হদিসই পাওয়া গেল না। পাওয়া গেলে হয়তো পরবর্তীতে তদন্ত কমিটির অন্য কেউ কাজে লাগাতে পারতেন। শহীদ সেলিমের মায়ের মতে, বঙ্গভবনের ওর ঘর থেকে যে প্রয়োজনীয় কাগজগুলো উধাও হয়েছিল সেগুলো সম্ভবত তদন্ত কমিটির গুরুত্বপূর্ণ কাগজপত্রই হবে। খোদ বঙ্গভবন থেকে জিনিসপত্র উধাও হয়ে যাবে তা ভাবতেও বিশ্বাস হয় না। শহীদ সেলিম বুদ্ধিজীবী হত্যা তদন্তের কাজে সরাসরি জড়িত ছিলেন একথা আমি আগে জানতাম না। আমি কেন, আর কেউ জানে কিনা তাও জানি না। জহির রায়হান ও সেলিমের নিখোঁজ রহস্য এখন আমার কাছে আরও রহস্যজনক বলে মনে হচ্ছে। বুদ্ধিজীবী হত্যা যেমন ৭১ সালে গুরুত্বের সঙ্গে উদঘাটিত হয়নি, তেমনি জহির রায়হান নিখোঁজ রহস্যও গুরুত্বের সঙ্গে উদঘাটিত করার প্রয়োজনীয়তা কেউ অনুভব করেনি। অথচ এটা একটা গভীর ষড়যন্ত্র। যে ষড়যন্ত্রের বিষবৃক্ষের বীজ রোপণ হয়েছিল সেদিন।”
পান্না কায়সার নিজেই বলেছেন যে, খোদ বঙ্গভবন থেকে গুরুত্বপূর্ণ কাগজপত্র উধাও হয়ে যাবে সেটা ভাবনারও অতীত। জহির রায়হানের সাথে লেফটেন্যান্ট সেলিমও বুদ্ধিজীবী হত্যা তদন্তে সরাসরি জড়িত ছিলেন। এ সম্পর্কিত কাগজপত্র জহির রায়হান এবং সেলিম উভয়ের কাছ থেকেই উধাও হয়ে গেছে। স্বাধীন বাংলাদেশে প্রেসিডেন্টের ভবন থেকে কাগজপত্র উধাও করতে পারে কারা? ‘রাজাকার’ বা ‘পাকিস্তানপন্থীরা’ অবশ্যই নয়। এটা করা সম্ভব একমাত্র তাদের পক্ষে, যারা ক্ষমতার আশপাশে ছিলেন।


॥ চার ॥
তদানীন্তন আওয়ামী লীগ সরকার এমন একজন বিশিষ্ট মুক্তিযোদ্ধা ও প্রতিভাবান মানুষের নিখোঁজ হওয়ার বিষয় তদন্ত না করায় এমন অবিশ্বাস্য ঘটনাটি ধামাচাপা পড়ে গেছে। অথচ বিভিন্ন মহল জহিরের হত্যাকা-ের জন্য ভারতের স্বার্থ রক্ষাকারী শক্তিকে দায়ী করে বক্তব্য দিয়েছে। এই অভিযোগকে সর্বশেষ সমর্থন করলেন জহির রায়হানের ঘনিষ্ঠ আত্মীয়, বিশিষ্ট নায়িকা ববিতা।
ববিতা বলেছেন, “যুদ্ধের নয় মাসে অনেকের কা-কীর্তি ফাঁস করে দেয়ার ঘোষণা দিয়েছিলেন বলেই জহিরকে ফাঁদে ফেলে মিরপুর নিয়ে যাওয়া হয় এবং পরিকল্পনামাফিক তাকে সরিয়ে দেয়া হয় পৃথিবী থেকে। বেক্সিমকো গ্রুপের রম্য পাক্ষিক পত্রিকা ‘আনন্দ ভুবন’ এর ১৬ মার্চ, ‘১৯৯৭ সংখ্যায় ‘কুলায় কালস্রোত’ বিভাগে ‘পুরানো সেই দিনের কথা’ শিরোনামে তিনি অতীত স্মৃতিচারণ করেছেন। তিনি মরহুম জহির রায়হানের স্ত্রী আরেক নায়িকা সুচন্দার ছোট বোন ববিতা।
জহির সম্পর্কে বলতে গিয়ে, ববিতা উল্লেখ করেছেন, “মুক্তিযুদ্ধের নয় মাস জহির ভাই কলকাতায় ছিলেন। ওপেনলি পার্টি করতেন না। তবে গোপনে করতেন। অনেক লোকজন আসতো তার কাছে। স্বাধীনতার পর দেশে ফিরে এলেন। তখন তাকে খুব অসহায় দেখেছি। বড় ভাই শহীদুল্লাহ কায়সারকে পাক সেনারা মেরে ফেলেছে। ওর জন্য জহির ভাই প্রায় পাগলের মতো হয়ে পড়েছিলেন। তখন ভাইকে খুঁজে পাওয়ার জন্য যে যা বলতেন, তাই করতেন। একবার একজন এসে বললো, আজমীর গিয়ে বাবার কাছে দোয়া চাইলে বড়দাকে পাওয়া যাবে। জহির ভাই বৌ, ভাবীকে নিয়ে আজমীর গিয়ে পড়ে থাকলেন কয়েকদিন।
কারা যেন এসে বললো, প্লানচেট করলে বড়দার খোঁজ পাওয়া যাবে। জহির ভাই তাই করলেন। যে যা বলছে, তাই বিশ্বাস করেছেন। সেয়াস (প্রেতচক্র) করলেন। আত্মা এসে বললো বড়দা মিরপুর ১১ নম্বর সেকশনে আছেন খুব অসহায় অবস্থায়, তার দুই চোখ নষ্ট হয়ে গেছে। জহির ভাই বাসায় কাউকে কিছু না বলে মিরপুর গেলেন। যাওয়ার সময় শুধু বললেন, তোমরা সবাই আজকে নামায কালাম পড়ো। আমি তোমাদের অবাক করে দেয়ার মতো একটা কাজ করবো। এই বলে বেরিয়ে গেলেন। আর ফিরলেন না। তার সাথে ছিলেন একজন ভারতীয় ব্রিগেডিয়ার। সেই ব্রিগেডিয়ারের রাতে আমাদের বাসায় ডিনার করার কথা ছিল। সন্ধ্যার সময়ে ব্রিগেডিয়ার সাহেব আমাদের গেন্ডারিয়ার বাসায় ফোন করে বললেন, ডিনার খাওয়া হবে না। কেননা জহির রায়হানকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। আমরা বললাম, কেন উনিতো আপনার সাথেই বেরিয়ে গেছেন। উনি বললেন, হ্যাঁ। কিন্তু ওখানে গিয়ে একসময়ে উনি আমাদের থেকে আলাদা হয়ে গেছেন। আর তাকে খুঁজে পাওয়া যায়নি, এই বলে ফোন রেখে দিলেন।
আমার মনে হয়, জহির ভাইকে হত্যা করা হয়েছে। ভারত থেকে ফিরে আসার পর একবার এক মিটিংয়ে উনি বলেছিলেন “যুদ্ধের নয়মাস আমি কলকাতায় ছিলাম। আমি দেখেছি সেখানে কে কি করেছে। কে দেশের জন্য করেছে, আর কে নিজের আখের গুছিয়েছে। আমার কাছে সব রেকর্ড আছে। আমি সব ফাঁস করে দেব। এটাই জহির রায়হানের জীবনে কাল হয়ে দাঁড়িয়েছিল। ওই আজমীরে যাওয়া, ওই সেয়াস করা, এগুলোর পেছনে উদ্দেশ্য ছিল তাকে মিরপুরে নিয়ে যাওয়া এবং হত্যা করা।”


॥ পাঁচ ॥
জহির রায়হানের আকস্মিক মৃত্যুর রহস্য উদঘাটনে সহায়ক হতে পারে আরেকটি তথ্য। বিশিষ্ট মুক্তিযোদ্ধা ও প্রখ্যাত লেখক রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর এবনে গোলাম সামাদের ‘বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ প্রসঙ্গে’ শীর্ষক লেখায় তিনি বলেছেন, “চলচ্চিত্র পরিচালক জহির রায়হানের সঙ্গে আমার কলকাতায় পরিচয় ঘটে। তার থাকবার কোন জায়গা ছিল না প্রথমে। আমি তাকে তিন মাসের জন্য থাকবার একটা খুব ভাল ব্যবস্থা করে দিতে পেরেছিলাম কলকাতায়। দেশে ফিরবার পর তিনি মারা যান। তাকে মেরে ফেলা হয়। কেন, কি কারণে, কারা তাকে মেরে ফেলে আমি তা জানি না।”
ড. সামাদ আরো বলেছেন, ৭ ডিসেম্বর (৭১) কলকাতায় বাংলাদেশ দূতাবাসে একটি উৎসব হয়। রায়হান সেখানে উপস্থিত ছিলেন। আমিও ছিলাম। তিনি বিশিষ্ট ব্যক্তিত্ব হিসেবে ছিলেন আমার দু’সারি আগে। হঠাৎ তাকে বলতে শুনি “দেশকে দু’বার স্বাধীন হতে দেখলাম। আবার একবার স্বাধীন হতে দেখবো কিনা জানি না।” কেন তিনি এ ধরনের মন্তব্য করেছিলেন, তা ভেবে আমার মনে পরে অনেক প্রশ্ন জেগেছে। তার মৃত্যু আজো হয়ে আছে রহস্যঘেরা।
জহির রায়হানের উপরোক্ত মন্তব্যে দেখা যায়, তিনি ৪৭ সালে ইংরেজদের বিদায় এবং ভারতবর্ষ বিভক্তির মাধ্যমে সৃষ্ট পরিবর্তন, তথা পাকিস্তানের জন্মকেও স্বাধীনতা হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছেন। তার চেয়েও বেশি তাৎপর্যম-িত ব্যাপার হলো, রাজনৈতিকভাবে মওলানা ভাসানীর অনুসারী জহির খুব সম্ভব বাংলাদেশের স্বাধীনতা ভবিষ্যতে আগ্রাসন ও আধিপত্যবাদ কবলিত হওয়া এবং তার বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে জনগণের বিজয় অর্জনের দিকেই ইঙ্গিত দিয়েছিলেন। আর এই ইঙ্গিত উপলব্ধি করে কট্টর ভারতপন্থী মহল এবং তাদের গুরুদের গা-জ্বালা ধরে যাওয়াই স্বাভাবিক। তখনকার পরিস্থিতিতে খোদ কলকাতায় বসে প্রকাশ্যে এমন উক্তি করা তাদের কাছে ‘স্পর্ধা’ বলে মনে হতে পারে। হয়তো এই দুঃসাহসের মূল্য হিসেবেই জহিরকে জীবন দিতে হয়েছে।
আমার বিশ্বাস জহির মিরপুরে মারা যায়নি। ঘাতকরা তাকে অন্য কোথাও হত্যা করেছে। এ বিশ্বাস এখনো আমার আছে, বলেছেন ড. সামাদ।


॥ ছয় ॥
জহির রায়হানের মৃত্যু সম্পর্কে কথা বলেছেন তার প্রথম স্ত্রী সুমিতা দেবী। তিনি বলেন, সেদিন বাড়ি থেকে জহির কিভাবে কেমন করে বেরিয়ে গিয়েছিল আমি দেখিনি। কারণ আমি তখন মোহাম্মদপুরে তিন ছেলে এক মেয়ে নিয়ে আলাদা থাকি। পরে আমার ননদ জহিরের ছোট বোন ডাক্তার সুরাইয়ার কাছে বিস্তারিত শুনেছি। সেদিন সকাল আটটার দিকে জহিরের কাছে একটা ফোন আসে। ফোনটা ধরেছিল সুরাইয়া নিজে। সেদিন রফিক নামে কেউ একজন ফোন করেছিল। আমরা যে রফিককে চিনতাম তিনি ইউসিসে চাকরি করতেন। তার সঙ্গে আমারই প্রথম পরিচয় ছিল। পরে আমিই তাকে জহিরের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলাম। টেলিফোনে সে জহিরকে বলেছিল, আপনার বড়দা মিরপুর ১২ নম্বরে বন্দী আছেন। যদি বড়দাকে বাঁচাতে চান তাহলে এক্ষুণি মিরপুর চলে যান। একমাত্র আপনি গেলেই তাকে বাঁচাতে পারবেন। অন্য কেউ যদি সেখানে যায় তাহলে আপনার বড়দার ডেডবডি আসবে বাড়িতে।
টেলিফোন পেয়েই জহির প্যান্ট পরে সঙ্গে সঙ্গে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যায়। আর বাড়িতে ফিরে আসেনি জহির। কোথাও ফিরে আসেনি।
একদিন বড়দি অর্থাৎ জহিরের বড় বোন নাসিমা কবিরকে ডেকে নিয়ে শেখ মুজিব বলেন, জহিরের নিখোঁজ নিয়ে এ রকম চিৎকার করলে তুমিও নিখোঁজ হয়ে যাবে। পরে নাসিমা আর কিছু বলেনি। টেলিফোন করেছিল যে রফিক, তাকে নিয়ে যখন পত্র-পত্রিকায় লেখালেখি শুরু হলো তখন তাকে নাগরিকত্ব দিয়ে পুরো পরিবারসহ আমেরিকায় পাঠিয়ে দেয়া হলো। এই ঘটনা জহিরের নিখোঁজ হওয়া সম্পর্কে রফিকের ভূমিকাকে আরো সন্দেহযুক্ত করে তোলে আমার কাছে। (তথ্য সূত্র: শাহরিয়ার কবির সম্পাদিত “একাত্তরের অবিরাম রক্তক্ষরণ”, আসলাম সানী রচিত “শত শহীদ বুদ্ধিজীবী”)



আসিফ আরসালান

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.