নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
লিন্ক সহ পোষ্টের বাহবা/দায়, মূল লেখকের।
আচ্ছা শুরুতেই যদি এমন প্রশ্ন তুলি যে কেন ৪১ বছর পরে আমরা ১৯৭৫ সালের নভেম্বর নিয়ে আলোচনা করবো ? কেন এখনো প্রাসঙ্গিক সেই রক্তাক্ত আর সেনা বিশৃংখলার নভেম্বর! একটি নতুন ধরনের টক শো করবো, নতুন টেলিভিশন চ্যানেল ডিবিসি নিউজে। গতানুগতিকতার বাইরে কিছু করার উদ্দেশ্যই ছিল। তাই একটি সুনির্দিষ্ট বিষয়ে ধারাবাহিক আলোচনা। আর আলোচনা শেষে একটি উপসংহারে পৌঁছানোর চেষ্টা। প্রথমে “বামপন্থী রাজনীতির উত্থান-পতন”। আর পরের বিষয়টিই ছিল “৭৫ এর নভেম্বর, ঘটনা-রটনা”। আট পর্বের আলোচনা করলাম । কিন্তু তারপরও মনে হচ্ছে অনেক কিছুই বাকী থেকে গেলো।
আমরা জানি এবারও ৭ নভেম্বর দেশের রাজনৈতিক মহলে আলোচনায় আসবে ১৯৭৫ সালের এই ঘটনাটি। পালিত হবে ৩ নভেম্বরের জেল হত্যা দিবস। যে খালেদ মোশারফ ১৯৭৫ সালের ২ নভেম্বর অভ্যুত্থান করে উৎখাত করেছিলেন খুনী মোশতাক চক্রকে, সেই খালেদ মোশাররফ, কর্নেল হায়দার এবং কর্নেল হুদাসহ বেশ কয়েকজন বীর মুক্তিযোদ্ধাকে নিহত হতে হয়েছে সেনাসদস্যদের হাতেই। এই তিন সেনা কর্মকর্তাকে নিয়েও আছে নানা বিভ্রান্তি। কিন্তু এটাও ঠিক যে তাদের হত্যাকাণ্ডের কোন তদন্ত হয়নি, বিচারতো দুরের কথা।
আমাদের আলোচনায় এসেছিলেন তখনকার চিফ অব জেনারেল স্টাফ ব্রিগেডিয়ার জেনারেল খালেদ মোশাররফের মেয়ে আওয়ামী লীগের সাংসদ মাহজাবিন খালেদ । বাবার হত্যার বিচার চান তিনি। একটি মামলা করতেও আগ্রহী। কিন্তু ক্ষমতাসীন দল করেন তিনি। তাই নানা সীমাবদ্ধতার কথা সরাসরি না বললেও মাহজাবিন খালেদ বলেছেন “আমার বাবা তখন বুঝেছিলেন, একটা কিছু হতে যাচ্ছে। বেশ কয়েকদিন ধরেই প্ল্যানিং হচ্ছিল। আমরা কিন্তু ১ তারিখ থেকে ৭ তারিখ পর্যন্ত গুলশানে নানীর বাসায় ছিলাম। আমার মার সাথে এর মধ্যে শুধু একদিন বাবার কথা হয়েছিল। সেসময় আমার মা সারাদিন টেনশনে কেঁদেছেন। বাবার কোন খবর নেই। গণমাধ্যম বলেওতো তখন কিছু ছিল না। বাবা কোথায় জানি না। খুবই কম বয়সে বিধবা হয়েছেন আমার মা। আমরা তিন বোন তখন অনেক ছোট। আমি অপেক্ষা করছি- একদিন না একদিন (রহস্য উন্মোচিত) হবেই। ইতিহাসতো আর বদলাবে না, আমরা বদলাতে পারবোও না।”
ইতিহাস বদলানো যাবে না। কিন্তু ইতিহাসের মূল্যায়ন করেই আমাদের এগুতে হবে। ডিবিসি নিউজের সাপ্তাহিক আয়োজন উপসংহারের এক মাসের আলোচনা শেষে এটা বলাই যায় যে, জাতির জনক বঙ্গবন্ধুকে সপরিবার হত্যা করার পরও ৭৫ এর নভেম্বর জুড়ে যে অভ্যুত্থান পাল্টা অভ্যুত্থান হয়েছে তার পেছনে ছিল বড় ধরনের দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্র। আর সে কারণেই জেলখানায় থেকেও রেহাই পাননি জাতীয় চার নেতা। কারণ, যারা বঙ্গবন্ধু হত্যা করেছিল তারা ভয় পেত আওয়ামী লীগকে। এ কারণে মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বদানকারী চার নেতাকেও হত্যা করা হয়েছিল। কারণ আগস্টে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পরও তারা নিশ্চিত হতে পারেনি যে মুক্তিযুদ্ধের সংগঠন আওয়ামী লীগ ঘুরে দাঁড়াতে পারবে কি পারবে না। আর সেনাবাহিনীর কিছু সদস্য ১৫ আগস্টের কালরাতের কলঙ্কতিলক জাতির ললাটে লাগিয়ে দিলেও পুরো সেনাবাহিনী তাদের বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা নেয়নি। বরং নভেম্বর জুড়ে যে ক্যু আর পাল্টা ক্যু হলো তাতে জড়িত ছিল সেনাবাহিনীরই নানা অংশ। আর এটাও আমরা আলোচনা থেকেই উপসংহারে যেতে পারি যে, মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে গড়ে ওঠা বাংলাদেশের সশস্ত্র বাহিনী তখনও তাদের পাকিস্তানি লিগ্যাসি থেকে বের হতে পারেনি। ফলে ক্ষমতার বলয়ে প্রবেশ এবং ক্ষমতা নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা তাদের ছিল। এ কারণে পদস্থ সেনা কর্মকর্তাদের মধ্যে আওয়ামী লীগ সরকার সম্পর্কে এক ধরনের ক্ষোভ ছিল। আর এর অন্যতম কারণ ছিল জাতীয় রক্ষীবাহিনী।
বাকশাল গঠনের পর অন্যান্য রাজনৈতিক দলের তৎপরতা প্রায় সীমিত হয়ে পড়ায় বিভিন্ন দলের নেতারাও সরকারের ওপর ক্ষুব্ধ ছিল। সেটাও নভেম্বরের ঘটনার অন্যতম কারণ। সেজন্য সৈনিক সংস্থার লিফলেট ছাড়াও ৭ নভেম্বর মুসলিম লীগও লিফলেট ছেড়েছিল। খালেদ মোশাররফের যে অভ্যুত্থান, তাতে অন্যতম পরিকল্পনাকারী মেজর (অব) নাসির উদ্দিন । তার বইতে খুব সংক্ষিপ্ত করেই মুসলিম লীগের লিফলেট সম্পর্কে উল্লেখ করা আছে। আলোচনায় তিনি জানিয়েছেন, তার সামনেই ওই লিফলেট বিলি হয়েছে। এমনকি বিশৃংখল অবস্থার মধ্যে অনেকে “পাকিস্তান জিন্দাবাদ” বলেও স্লোগানও দিয়েছে।
মেজর (অব) নাসির উদ্দিন তার লেখা ‘গণতন্ত্রের বিপন্নধারায় বাংলাদেশের সশস্ত্র বাহিনী’ বইতে লিখেছেন “ইতিমধ্যে রক্ষীর গোয়েন্দা বিভাগের প্রধান এসে ব্রিগেডিয়ার নুরুজ্জমানকে কিছু প্রচারপত্র দেখালেন। এগুলো সব জাসদের বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার নামে বিলি করা হয়েছে। এসব প্রচারপত্রে খালেদ মোশাররফকে দেশদ্রোহী ও ভারতের দালাল আখ্যা দিয়ে বলা হয় যে খালেদ বাংলাদেশকে ভারতের কাছে বিক্রী করে দিতে চায়। মুসলিম লীগের বিলিকৃত অপর এক প্রচারপত্রে বলা হয় খালেদপন্থী এই অভ্যুত্থানের উদ্দেশ্যই হলো বাকশালের পুনরুত্থান।” কিন্তু যখন আমি জানতে চেয়েছিলাম কর্নেল তাহেরের ভাই অধ্যাপক আনোয়ার হোসেনের কাছে, তিনি পরিষ্কার করেই বলেছেন, মুসলিম লীগের কোন লিফলেট সৈনিক সংস্থার বিতরণ করার প্রশ্নই ওঠে না।
তবে মেজর (অব.) জিয়াউদ্দিন আহমেদের মন্তব্যে বোঝা যায়, ২/৩ নভেম্বরের অভ্যুত্থানে ভারত একটি বিষয় ছিল। তিনি বলেছেন “৯ তারিখ আমি ঢুকে দেখছি যে কর্নেল তাহের ২০/২২ জন অফিসার নিয়ে বসে আছেন। তাদের দুশ্চিন্তা হলো, এই যে একটা ফ্যাকশনটা নিয়ে, যারা অফিসারদের হত্যা করছে তাদের নিয়ে। বাইরে প্রোপাগান্ডা ছড়িয়ে দিলো যে, দেশটা ইন্ডিয়াকে দিয়ে দেবে। ব্যস, ইসলাম চলে গেলো, হিন্দুরা এসে গেল, হিন্দু সেনাবাহিনী এসে গেলো এইসব বলে তারা এই কাজগুলো ঘটায়। সেদিনও ঘটিয়েছে। তারা এয়ারপোর্টে হত্যা করেছে, আর সাথে সাথে রিউমার ছড়িয়ে দিলো ভারতীয় সেনাবাহিনী এসে দেশ দখল করে নিচ্ছে! ব্যস! পুরো মুভমেন্টের ক্যারেক্টার নষ্ট হয়ে গেলো।”
হয়তো এ কারণেই ২৬ নভেম্বর ঢাকায় নিযুক্ত ভারতীয় হাই কমিশনার সমর সেনকে অপহরণের ব্যর্থ চেষ্টা করেছিল জাসদের গণবাহিনী। সেই অপহরণের জন্য গঠিত ছয়জনের সুইসাইড স্কোয়াডের চারজনই নিহত হয়েছিলেন। “জাসদের উত্থান পতন: অস্থির সময়ের রাজনীতি” নামের বইটিতে আছে সেদিনকার ঘটনার একটি সংক্ষিপ্ত বিবরণ। মহিউদ্দিন আহমদ লিখেছেন, “২৬ নভেম্বর সময়মতো ছয়জন অকুস্থলে হাজির হলেন। দলের নেতা বাহার। তিনজন অবস্থান নিলেন রাস্তার দক্ষিণ পাশে জার্মান সাংস্কৃতিক কেন্দ্রের চত্বরে। তিনজন অপেক্ষা করতে থাকলেন ভারতীয় ভিসা অফিসের সামনে। সবাই সশস্ত্র। এমন সময় হাইকমিশনার এসে গাড়ি থেকে নামলেন। সঙ্গে সঙ্গে বাহারদের দলের দুজন তার দুই হাত ধরে বললেন ‘আপনি আমাদের হাতে জিম্মি। আপনার ঘরে চলুন। আপনার সঙ্গে আমাদের কিছু কথা আছে।’ সিঁড়ি দিয়ে একতলা থেকে দোতালায় যাওয়ার পথে ওপরে অপেক্ষমান নিরাপত্তারক্ষীরা ব্রাশফায়ার করলে ঘটনাস্থলেই বাহার, বাচ্চু, মাসুদ ও হারুন নিহত হন। বেলাল ও সবুজ আহত হন। হাইকমিশনারের কাঁধে গুলি লেগেছিল।…..”
‘৭৫ এর নভেম্বরের অনেক কিছুরই সরাসরি জবাব মেলে না। কিন্তু ঘটনাক্রম এবংওই সময়ের নানা ঘটনার কুশীলবদের সাথে আলোচনা করে এটা বোঝা যায় যে তখনকার জাসদ অনেকগুলো হঠকারী ও ভুল পদক্ষেপ নিয়েছিল। যে আট পর্বের আলোচনা আমরা করেছি, সেখানে একাধিক ব্যক্তি এ বিষয়টি উল্লেখ করেছেন। যদিও আলোচনায় অংশ নিয়ে অধ্যাপক ড. আনোয়ার হোসেন তা মানতে রাজী হননি।
নভেম্বরে রংপুর থেকে ঢাকায় এসেছিলেন কর্নেল (অব) জাফর ইমাম বীর বিক্রম। তিনি আমাদের আলোচনায় মন্তব্য করেছেন, “জাসদের হঠকারিতায় জিয়াউর রহমান আত্মপ্রকাশ করল। জিয়াউর রহমানকে তো তারা প্লেটে করে দিয়েছে (ক্ষমতা)। আমিতো অনেক সময় বলি, রসিকতা করে নয়, যুক্তি দিয়ে যে, জিয়াউর রহমান নিজে ৭ নভেম্বর অভ্যুত্থানের সুবিধাভোগী। জাসদ অর্থাৎ কর্নেল তাহের যদি সকালে বেতারে ভাষণ দিতে পারত; পরে গিয়েছিলো, কিন্তু তখন আর ভাষণ দিতে পারেনি। ততক্ষণে চেইন অব কমান্ড জিয়াউর রহমান ফিরিয়ে এনেছিলো। যদি জাসদের সাথে জিয়াউর রহমান লং মার্চে যেত, যে কথা সে দিয়েছিল জাসদকে, তাহলে হয়ত পরিস্থিতি অন্যরকম হত। এ কারণেই জাসদ বলে যে, জিয়া বিট্রে করেছে।”
জাসদের একাংশের সাধারণ সম্পাদক শরীফ নুরুল আম্বিয়া মূল্যায়ন করেছেন, “মেজর জলিল আর কর্নেল তাহেরের সঙ্গে সৈনিকদের যোগাযোগটা ছিলো অনেকটা সামাজিক। যারা যার অধীনে যে সেক্টরে যুদ্ধ করেছে তারা এসে কথাবার্তা বলত। সৈনিক সংস্থার গঠন, নীতি নির্ধারণী কমিটির সিদ্ধান্ত ছিলো না, বরং এটা ছিল কমিটির কয়েকজন নীতি নির্ধারকের সিদ্ধান্ত। স্ট্যান্ডিং কমিটি এই সিদ্ধান্তে আপত্তি করেনি। যেহেতু এটা রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত ছিল না সেজন্য কিছু দুর্বলতা ছিল। এরপরে জাসদের হাজার হাজার নেতা-কর্মীর উপর যে নির্মম অত্যাচার চালানো হয়েছে তা ভাষায় বর্ণনা করা যাবে না। জাসদকে অত্যন্ত কঠিনভাবে খেসারত দিতে হয়েছে এই পরাজয়ের এবং এই বিপর্যয়ের পর।”
সূত্র
©somewhere in net ltd.
১| ০৫ ই নভেম্বর, ২০১৬ সকাল ৮:৩৮
চাঁদগাজী বলেছেন:
শেখ সাহেবের শুরু ও শেষ সবকিছুতে ছাত্রলীগ; উনার ছাত্রলীগের আরেক ভয়ানক রূপ হলো জাসদ; বাংগালীর শত্রু জামাত, বাংগালীর দু:খ ছাত্রলীগ।