নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
লিন্ক সহ পোষ্টের বাহবা/দায়, মূল লেখকের।
বিশ শতকের সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের শেষ নক্ষত্রটি বিদায় নিলেন। নব্বই বছর বয়সে মৃত্যু হলো কিউবার ফিদেল ক্যাস্ট্রোর। এটি পরিণত বয়সের মানুষের মৃত্যু। কিন্তু বিপ্লবের মৃত্যু হয় না। যারা মনে করেছিলেন, বিশ বা গত শতকের শেষদিকে সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের বিপর্যয়ের সঙ্গে সঙ্গে সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থার পতন হয়েছে, তাদের উক্তির উদ্যত প্রতিবাদ ছিলেন ফিদেল ক্যাস্ট্রো। একুশ শতকের প্রথম পাদ পর্যন্ত বেঁচে থেকে এবং সমাজতান্ত্রিক কিউবাকে সকল আক্রমণের মুখে টিকিয়ে রেখে তিনি প্রমাণ রেখে গেছেন মানব মুক্তির বিপ্লবের মৃত্যু হয় না, বিপ্লব ধারা বদলায়।
তাকে হত্যার এবং ক্ষমতা থেকে উত্খাতের অন্তত একশটি চক্রান্ত হয়েছে। চক্রান্ত করেছে আমেরিকার গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএ, কোলাবরেটর দেশীয় অনুচরদের দ্বারা বার বার কিউবার প্রতি বিপ্লব ঘটানোর চক্রান্ত করা হয়েছে। কেন, বে অব পিগসের ঘটনা কি আমাদের মনে নেই? প্রেসিডেন্ট কেনেডির আমলে আমেরিকা তার নিকটবর্তী উপকূলীয় সমাজতান্ত্রিক দেশ কিউবায় হামলা চালানোর উদ্যোগ নিলে তত্কালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের নেতা ক্রুশ্চেভ জাহাজযোগে আণবিক প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা পাঠিয়েছিলেন দেশটিতে সেই হামলা প্রতিরোধের জন্য।
আণবিক অস্ত্রবাহী সোভিয়েত জাহাজকে কিউবার সমুদ্র সীমায় বাধাদানের জন্য কেনেডি পাল্টা ব্যবস্থা গ্রহণের হুমকি দিয়েছিলেন। তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ প্রায় শুরু হয় হয়। বিশ্বের শান্তিকামী মনীষীরা ক্রুশ্চেভ-কেনেডি এমনকি ফিডেল ক্যাস্ট্রোর কাছে আবেদন জানিয়েছিলেন একটি ভয়াবহ আণবিক যুদ্ধ থেকে দুনিয়াকে মুক্ত রাখতে। ক্যাস্ট্রো সেই আবেদনে সাড়া দিয়েছিলেন। আমেরিকা শুভবুদ্ধির পরিচয় দিয়ে কিউবায় হামলা না চালানোর সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেছিল। সোভিয়েত ইউনিয়ন কিউবাগামী আণবিক বোমাবাহী জাহাজ ফিরিয়ে নিয়েছিল। একটি প্রলয়ঙ্কর আণবিক যুদ্ধ থেকে পৃথিবী রক্ষা পায়।
আমেরিকার সবচাইতে বড় লজ্জা ছিল, সে সারাবিশ্বে মার্কিন আধিপত্য প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ছোট-বড় বহু দেশে জাতীয় নেতাদের হত্যা করেছে, সরকারের পরিবর্তন ঘটিয়েছে; কিন্তু তার সবচাইতে নিকটতম প্রতিবেশী দেশ কিউবায় সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থার অভ্যুদয় ঠেকাতে পারেনি। ক্যাস্ট্রোর নেতৃত্বে সংঘটিত সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের বিজয় ঠেকাতে পারেনি। গুপ্ত ও প্রকাশ্য হত্যার চেষ্টা, এমনকি অনুগত কিউবানদের দ্বারা বার বার সশস্ত্র প্রতিবিপ্লব ঘটানোর চেষ্টা দ্বারাও ক্যাস্ট্রোকে হত্যা বা কিউবার সরকার পরিবর্তন সম্ভব হয়নি। ক্যাস্ট্রো দীর্ঘকাল বেঁচে থেকে, তার দেশে সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র ব্যবস্থা সুপ্রতিষ্ঠিত করে অবশেষে বার্ধক্যজনিত কারণে ভাই রাউল ক্যাস্ট্রোর কাছে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা হস্তান্তর করে অবসর নেন। সমাজতান্ত্রিক বিশ্বে এমন একজন সফল বিপ্লবী নায়কের তুলনা নেই বললেই চলে।
রাষ্ট্রক্ষমতা থেকে বিদায় নিলেও বিশ্ব-রাজনীতি থেকে বিদায় নেননি ক্যাস্ট্রো। রোগ শয্যায় শুয়েও তিনি কিউবাকে সামনে এগিয়ে যাবার পথনির্দেশ করেছেন। সাম্রাজ্যবাদী চক্রান্তগুলোর স্বরূপ ধরিয়ে দিয়েছেন। ইরাক-হামলার তীব্র নিন্দা করেছেন। ওবামা প্রশাসনের চাতুরি ও ফাঁক-ফোকরগুলো ধরিয়ে দিয়েছেন। সমাজতন্ত্রের এই বিপর্যয়ের যুগে কিউবায় কিভাবে তাকে টিকিয়ে রাখা যাবে তার পথনির্দেশ করে গেছেন। নয়া চীনকে ধ্বংস করতে না পেরে গত শতকে মার্কিন প্রেসিডেন্ট নিক্সনের সময়ে তার পররাষ্ট্রমন্ত্রী কিসিঞ্জার গোপনে চীনে ছুটে গিয়ে কম্যুনিস্ট সরকারের সঙ্গে মিতালি পাতিয়েছিলেন।
এই মিতালি সোভিয়েত ইউনিয়নকে ধ্বংস করার মার্কিন প্রচেষ্টায় সাহায্য জুগিয়েছে। চীনেও মাওবাদের উচ্ছেদ ঘটিয়ে দেশটিকে মুক্তবাজার অর্থনীতির সঙ্গে আপস করতে বাধ্য করেছে। এই শতকে কিউবার প্রতিও একই কিসিঞ্জার-নীতি অনুসরণ করতে চেয়েছেন বিদায়ী মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা। তিনি দীর্ঘ কয়েক দশকের কিউবা-বিরোধী নীতি বর্জন করে মৈত্রীর হাত বাড়িয়ে হাভানায় ছুটে যান। কিউবার বর্তমান নেতা ফিদেলের ভাই রাউল ক্যাস্ট্রোর সঙ্গে হাত মেলান এবং অর্থনৈতিক ও সামরিকভাবে কিউবাকে অবরোধ করে রাখার নীতি ত্যাগ করেন।
ফিদেল ক্যাস্ট্রোর জীবদ্দশাতেই ওয়াশিংটন-হাভানা সম্পর্ক পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হয়। ফিদেল এই সম্পর্ক পুনঃপ্রতিষ্ঠাকে অভিনন্দন জানিয়েছেন। কিন্তু একই সঙ্গে এই মৈত্রীর গোপন উদ্দেশ্য সম্পর্কে কিউবার সরকার ও জনগণকে সতর্ক করে দিয়েছেন। এই বৃদ্ধ বিপ্লবী নেতা নিজে ক্ষমতায় থাকতে বিশ্বায়নের তখনকার অপ্রতিরোধ্য জোয়ারকে ঠেকাতে চাননি; আবার তার জোয়ারে ভেসেও যাননি। কিউবার সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতির মূল কাঠামোতে তিনি কোনো পরিবর্তন ঘটাতে দেননি। এখন কিউবার মার্কিন মৈত্রীর ‘অনুপ্রবেশের’ পর ক্যাস্ট্রোর স্বাভাবিক মৃত্যু ঘটায় কেউ যদি আশা করেন এই মূল কাঠামো সম্পূর্ণ বদলে ফেলা সম্ভব হবে, সে আশা ফলবতী হবে বলে অনেক রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকই মনে করেন না।
মার্কিন তাঁবেদার জেনারেল বাতিস্তার স্বৈরাচারী সরকারকে ক্ষমতা থেকে উচ্ছেদ করে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব সফল করার পর ক্যাস্ট্রোকে শক্তিশালী পশ্চিমা বিশ্বের অনেক হামলা প্রতিরোধ করতে হয়েছে। চে গুয়েভারা ছিলেন ক্যাস্ট্রোর বিপ্লবী সহকর্মী। চে ও ফিদেলের মধ্যে মতানৈক্যও ছিল। সিআইএ গুয়েভারাকে নির্মমভাবে হত্যা করতে পেরেছে। কিন্তু ফিদেলকে পারেনি। এখানেই তার এবং তার বিপ্লবের সাফল্য।
কিউবার সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের সাফল্য যাতে সারা লাতিন আমেরিকাকে প্রভাবিত না করে সেজন্যে কিউবার ক্যাস্ট্রো সরকারকে ধ্বংস করার উদ্দেশ্যে পশ্চিমা ধনতান্ত্রিক বিশ্ব অনেক চেষ্টা করেছে। কিউবাকে অর্থনৈতিক ও সামরিক অবরোধের মুখে রেখেছে দশকের পর দশক। একবার আমেরিকার “ইকোনমিক স্যাঙ্কসনের” মুখে কিউবা তার উত্পাদিত চিনির বিশাল স্টক আন্তর্জাতিক বাজারে বিক্রি করতে না পারায় ভয়াবহ অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের মুখে পড়ে। সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন সেই চিনির সবটা কিনে নিয়ে কিউবাকে অর্থনৈতিক বিপর্যয় থেকে রক্ষা করেছিল। আমেরিকার চোখ রাঙানি অগ্রাহ্য করে বাংলাদেশের বঙ্গবন্ধু সরকার কিউবার কাছে পাট বিক্রি করেছিল বলে মার্কিন সিআইএ যে বঙ্গবন্ধু হত্যার নীল-নকশা প্রণয়নে মদদ জুগিয়েছিল সে কথা আজ কার অজানা?
সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যাওয়ার পর কিউবাকে একা পেয়েও শায়েস্তা করতে চেয়েছিল একবার অমেরিকা। সেবার ক্যাথলিক চার্চ ও ভ্যাটিকানের পোপকে উসকে দেওয়া হয়েছিল। কিউবায় প্রচার শুরু হলো ক্যাস্ট্রো খ্রিষ্টান ধর্ম ধ্বংস করতে চান। সেজন্যে তিনি কিউবায় ক্রিসমাস পালন নিষিদ্ধ করেছেন। কিউবার জনগণের মধ্যে ধর্মীয় উন্মাদনা সৃষ্টি করে ক্যাস্ট্রো সরকারকে ক্ষমতা থেকে উত্খাতের জন্য স্বয়ং পোপ কিউবা সফরের সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেন।
এ সময় ক্যাস্ট্রো দেখিয়েছেন তার রাজনৈতিক দূরদর্শিতা, তিনি হাভানায় বিমান বন্দরে নিজে পোপকে অভ্যর্থনা জানান এবং তার উপস্থিতিতে বিশাল জনসমাবেশে ঘোষণা করেন, ‘এখন থেকে কিউবায় ক্রিসমাস পালিত হবে। তবে ধর্মীয় ক্রিসমাস নয়। এই উত্সবের নাম হবে পিপল্স ক্রিসমাস বা জনগণের ক্রিসমাস।’ এই ঘোষণা শুনে জনতা উল্লাস ধ্বনি দিয়ে শান্তভাবে ঘরে ফিরে যায়। ক্যাস্ট্রোকে ক্ষমতা থেকে উত্খাতের চক্রান্ত ব্যর্থ হয়।
ক্যাস্ট্রো দেখিয়েছিলেন, সমাজতান্ত্রিক রাজনীতিতে এক পা এগুবার জন্য কিভাবে দু’পা পিছিয়ে যেতে হয়। এভাবেই ফিদেল ক্যাস্ট্রো কিউবান সমাজতন্ত্রকে রক্ষা করেছেন। বাংলাদেশেও শেখ হাসিনার সরকারের বড় সাফল্য এই যে দেশটিতে হিংস্র ধর্মীয় উন্মাদনার জোয়ারের মুখে “সমাজতন্ত্র”, “ধর্মনিপেক্ষতা” ইত্যাদি আদর্শকে আপ্তবাক্য হিসেবে ধরে না রেখে দু’পা পিছিয়ে এক পা এগিয়ে এই দুটি নীতিকেই রক্ষা করার কৌশলী চেষ্টা চালাচ্ছেন। কিউবায় এভাবেই ক্যাস্ট্রো সমাজতন্ত্রকে রক্ষা করেছেন; বাংলাদেশেও অনেকটা একই ভাবে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে রক্ষা করে চলার চেষ্টা চালানো হচ্ছে।
আমি শেখ হাসিনাকে ক্যাস্ট্রোর সঙ্গে তুলনা করছি না। কিন্তু দুটি ব্যাপারে তাদের মধ্যে মিলের দিকেই পাঠকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি। কিউবার সমাজতন্ত্র রক্ষা ও বাংলাদেশে গণতন্ত্র রক্ষায় তাদের কৌশলের মধ্যে মিল রয়েছে। আবার ক্যাস্ট্রোকে হত্যার জন্য যতটা চক্রান্ত হয়েছে ততটা চক্রান্ত হয়েছে হাসিনাকেও হত্যার জন্য। ক্যাস্ট্রো প্রতিবার অলৌকিক ভাবে বেঁচেছেন। হাসিনাও অলৌকিকভাবে এখন পর্যন্ত বেঁচে আছেন।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গেও ফিদেল ক্যাস্ট্রোর সম্পর্ক ছিল গভীর। ১৯৭৩ সালে আলজিয়ার্সে ৭৩ জাতি জোট নিরপেক্ষ সম্মেলনে মুজিব-ক্যাস্ট্রো প্রথম সাক্ষাত্ হয় এবং তখন থেকে ক্যাস্ট্রো বঙ্গবন্ধুকে “কমরেড মুজিব” বলে ডাকতে শুরু করেন। বঙ্গবন্ধু সম্পর্কেই ক্যাস্ট্রো বলেছিলেন, “আমি হিমালয় দেখিনি, কিন্তু শেখ মুজিবকে দেখেছি।”
৯০ বছর বয়সে মৃত্যু পরিণত বয়সের মৃত্যু। কিন্তু নশ্বর দেহের মৃত্যু দ্বারা আদর্শবাদী সত্তার মৃত্যু হয় না। ফিদেল ক্যাস্ট্রোরও হয়নি। আগামী দিনের নতুন সমাজবাদী বিপ্লবেরও একজন অগ্রদূত হয়ে তিনি বেঁচে থাকবেন।
সূত্র
©somewhere in net ltd.
১| ২৭ শে নভেম্বর, ২০১৬ সকাল ৭:০৩
ডঃ এম এ আলী বলেছেন:
খুব সুন্দর করে লিখেছেন । উঠে এসেছে কাস্ত্রোর জীবনের অনেক মুল্যবান কথা , অনেক ইতিহাস । কাস্ত্রোর মহাপ্রয়ানে নির্বাক মনে শুধু বলতে চাই তুমি তো জানোই কষ্ট আর বেদনার অনুভূতি নিয়েই তোমাকে প্রাণের অর্ঘ্য করব নিবেদন । একটি জাতির নির্মাণকারী হিসেবে তুমি তোমার বিশুদ্ধ আশাগুলো এবং সবচেয়ে প্রিয় স্বপ্নগুলোই রেখে গেছ ধরনীর বুকে । নীজ দেশে রেখে গিয়েছ সেই মানুষগুলোকেই যারা তোমাকে তাদের নিজ পিতার মত করেছিলো গ্রহণ। তোমার কাছ থেকে পাওয়া যে বিশ্বাসের শিক্ষা, দেশের মানুষের যে বিপ্লবী বোধ, দেশের জন্য পবিত্রতম দায়িত্বগুলো পালনের প্রতি যে একাগ্রতা, সাম্রাজ্যবাদের বিরূদ্ধে একজন মানুষের লড়াইয়ের যে আদর্শ- তাইতো তুমি রেখে গিয়েছ বিশ্ববাসীর জন্য । এটাই নিপিড়িত মানব জাতির শক্তির উৎস, আর এটাই মানবতার বুকে পেরেক ঠুকিয়ে সৃজিত গভীরতম ক্ষত গুলি সারিয়ে তোলার স্পৃহা জাগায় দুনিয়ার সর্বত্র । পরিশেষে কবি গুরুর ভাষায় বলতে চাই ’এনে ছিলে সাথে করে মৃত্যুহীন প্রাণ , মরনে তাই তুমি করে গেলে দান ‘ ।
শুভেচ্ছা রইল