নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। লেখালেখি করি শখের বস। ফেসবুক লিংক: https://www.facebook.com/tanjirul6795

মোঃ তানজিরুল ইসলাম হিমালয়

একটা দেশকে এগিয়ে নিতে খুব বড় কিছু করার দরকার নেই। সবাই যদি নিজ নিজ অবস্থান থেকে নিজের দায়িত্বটুকু ঠিকভাবে পালন করে তবে সেটাই অনেক বড় হয়ে দাঁড়ায়।

মোঃ তানজিরুল ইসলাম হিমালয় › বিস্তারিত পোস্টঃ

রিভেঞ্জ (মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক থ্রিলার)

১১ ই জানুয়ারি, ২০১৬ রাত ৮:৩২



এক

শিস দিয়ে মাথার ওপর দিয়ে চলে গেল গুলিটা৷ কিন্তু সেটা নিয়ে ভাবার সময় কোথায়? গুলি লাগলে লাগবে৷ আপাতত নিজের কাজ করছে ফাহাদ৷ অনবরত গুলি চালিয়ে যাচ্ছে সামনে৷ হানাদারগুলোও গাছের আড়ালে লুকিয়ে৷ মোটে দশ জন হানাদার৷ তাদের ঘায়েল করতেই অবস্থা খারাপ৷ ঠিক সুবিধে হচ্ছে না৷
মুক্তিগুলোকে শায়েস্তা করতে হবে৷ বেশকদিন হল উৎপাত বেড়ে গেছে শয়তানগুলোর৷ সে উদ্দেশ্যেই জায়গায় জায়গায় মুক্তিনিধন অভিযান চালাচ্ছে হানাদারেরা৷ দশজনে এক একটি দল হয়ে একেক গ্রামে যায়৷ গিয়ে যাকে পায় তাকেই গুলি করে৷ যদি মুক্তি হয়? আজও দশজন মিলে বের হয়েছিল৷ কিন্তু বজ্জাত মুক্তিগুলো কিভাবে জানি খবর পেয়ে আগে থেকেই ওৎ পেতে ছিল৷ এ পথে আসতেই গুলি করতে শুরু করেছে৷ কোনমতে পজিশন নেওয়া গেছে৷ এখন আর একটাকেও পালাতে দেয়া যাবে না৷
তুহিনকে চোখের ইশারায় অবস্থান পাল্টাতে বলে ফাহাদ৷ তারপর দুজনে গড়িয়ে গড়িয়ে পজিশন পাল্টে নেয়৷ পেছন থেকে বিপ্লব, মকবুল গুলি চালাচ্ছেই৷ অল্পক্ষণেই দুজন পাকসেনা মারা পড়ে৷ যাক, এখন সমান সমান হল৷ এখন হবে আটে-আটে লড়াই৷
প্রায় আধাঘন্টা যুদ্ধ স্থায়ী হয়৷ ফাহাদদের চারজন শহীদ হয়েছে৷ আর একজন গুরুতরভাবে জখম৷ ওদিকে আটটা পাকসেনা মরেছে৷ আর দুটো পালানোর চেষ্টা করছে৷ ফাহাদ জখম মকবুলের পাশে থেকে, মিঠু আর ওয়াসীমকে পাঠায় বাকী দুটোকে শেষ করতে৷ মিঠু ও ওয়াসীম ওই দুজনকে ধাওয়া করে৷ ফাহাদ আহত মকবুলের পাশে বসে থাকে৷
মিঠু ও ওয়াসীম যাওয়ার প্রায় দশ মিনিট হয়েছে, অথচ এখনও আসার নাম নেই৷ অবস্থা বুঝতে না পেরে ফাহাদ মকবুলকে বলে, "গুলির শব্দ তো শুনলাম না৷ ওরাও তো এখনো এল না৷ তুই থাক, আমি একটু দেখে আসি৷"
"তুমি থাকো ফাহাদ ভাই ৷ আমার ভয় হয় ৷"
মকবুল ফাহাদের দু'বছরের ছোট৷ ফাহাদ 'তুই' করে বললেও মকবুল তুমি করে বলে৷
"ধুর, কিসের ভয়? আমি গেলাম আর এলাম৷" বলেই দৌড় দেয় ফাহাদ৷ মকবুল পেছন থেকে গোঙ্গানোর মত একটা শব্দ করে৷
হঠাৎ বেশ কয়েকটি গুলির শব্দ শোনা যায়৷ কিছুক্ষণ বাদেই ফাহাদ দৌড়াতে দৌড়াতে ফিরে আসে৷ চোখে মুখে অজানা ভয়৷ এসেই কোন কথা না বলে মকবুলকে কাঁধে নিয়ে দৌড়াতে থাকে৷ মকবুল জিজ্ঞেস করে, "কি হল ফাহাদ ভাই? মিঠু ভাই, ওয়াসীম ভাই, ওরা কোথায়?"
ফাহাদ ধমকে ওঠে, "চুপ! এখন কথা বলার সময় নাই৷ পাকবাহিনী আসছে৷"

দুই

বেশ ব্যস্ত দিন কাটছে কামালের৷ প্রায় প্রতিদিনই অপারেশনে যেতে হচ্ছে৷ কখনও সারারাতও জাগতে হচ্ছে৷ আর ঘুমও তেমন হচ্ছে না বললেই চলে৷ সবসময়ই সজাগ থাকতে হয়৷ ঘাঁটিতে সদস্য কমে গেছে৷ তাই পালা করে পাহারার দায়িত্বটা বেশিই পড়ছে৷ এইত কদিন আগেও তারা তিরিশ জনের মত ছিল৷ পাঁচ ছ'দিনেই হুট করে পনেরয় নেমে গেছে৷ পনের জন মারা যাওয়া কম কথা নয়৷ ব্যাপারটা কেমন জানি গোলমেলে৷ বেশ সন্দেহজনক ঠেকে কামালের কাছে৷ এ বিষয়ে নিলয় দা এর সাথে কথা বলেছিল কামাল৷ নিলয় দা ওদের কমান্ডার৷ উনিও নাকি ব্যাপারটা খেয়াল করেছেন৷ ওনার মনে হচ্ছে ঘাঁটিরই কেউ এর পেছনে দায়ী৷ কিন্তু কাউকে সন্দেহ করেন কিনা সে বিষয়ে কিছু বললেন না৷ তবে কামালের একজনকে সন্দেহ হয়৷ কিন্তু শুধু সন্দেহের ভিত্তিতে সিদ্ধান্তে আসা যায় না৷ যথাযথ প্রমাণ লাগবে৷ কামাল ঠিক করে ওর ওপর চোখ রাখবে৷
হঠাৎ তুষার বলে ওঠে, "কি ভাবিস কামাল?"
তুষার ঘরেই ছিল৷ কামাল ঘরের এক কোণায় বসে আনমনা হয়ে ছিল৷ আর তুষার পাটিতে গা এলিয়ে বিশ্রাম নিচ্ছিল৷ ঘরে শুধু ওরা দুজন৷ বাকীরা বাইরে৷
কামাল নিজেকে সামলিয়ে নেয়, "কিছু না রে, এমনি৷"
"আচ্ছা কামাল, তুই যে একবার মিলিটারির হাতে পড়েছিলি?" চোখ বড় বড় করে বলে তুষার, "ওরা তোর ওপর কি কি অত্যাচার চালিয়েছিল?"
কামাল আগে একবার মিলিটারিদের হাতে পড়েছিল৷ তখন ওরা কামালের ওপর নির্মম নির্যাতন চালিয়েছিল৷ কিন্তু ভাগ্য ভাল ছিল বলে কামাল পালাতে পেরেছিল৷ এই কাহিনী ঘাঁটির সবাই জানে৷ তবুও অনেকেই মাঝে মধ্যে শুনতে চায়৷ কামালও বেশ আগ্রহ নিয়ে বলে৷
"সে কথা আর বলতে? ওইকটাদিন যে কষ্টে ভুগেছি! শালারা খাবার তো দূরে থাক, একফোঁটা পানিও দেয়নি৷ ঘাঁটির ঠিকানা জানার জন্য কত অত্যাচার চালিয়েছে৷ হাতের নখ তুলে নিয়েছে৷ ফুটন্ত গরম পানিতে হাত নিয়ে চুবিয়েছে৷ সে কি কষ্ট! এই দেখ৷" নখবিহীন আঙ্গুল আর হাতের পোড়া দাগ দেখায় কামাল৷ তা দেখে তুষার শিউরে ওঠে৷
কামাল আরও বলে, "এটুকুতেই ভয় পেলি? আরও কি করেছে তা তো শুনিসই নি৷ ওরা আমাকে উলঙ্গ করে পা উপরে, মাথা নিচে রেখে উল্টাপাশে ঝুলিয়ে রাখত৷ যার যখন ইচ্ছা এসে লাঠি, রাইফেলের বাট দিয়ে পেটাতো৷ রাইফেলের বেয়োনেট দিয়ে খোঁচাতো৷ ব্যাটারা বেছে বেছে আবার পাছায় খোঁচাতো আর হাসিতে ফেটে পড়ত৷ পাছায় এখনও অনেকগুলো দাগ আছে৷"
তুষার খানিকটা মুচকি হাসতে থাকে৷ কামাল চোখ মটকে বলে যায়, "ওরা আমাকে বড় বড় বরফ খন্ডের ওপরে উলঙ্গ অবস্থায় বেধে ফেলে রাখত৷ আমি ছটফট করতাম যন্ত্রনায়৷ কখনও কখনও মূর্ছা যেতাম৷ ওরা আমার কষ্ট দেখে হাসত৷ আমায় নিয়ে মজা করত৷ মনে হত একেকটাকে চিবিয়ে খাই৷ কিন্তু কিছু করার ছিল না৷ অবশেষে ভাগ্য সহায় হয়েছিল বলে পালাতে পেরেছি৷"
"তোর রাগ হয় না ওদের ওপর?"
"হয় না আবার? হয় হয়, রাগ হয়৷ এত রাগ মনে জমানো আছে যে ছাড়া পেলে কুত্তাগুলো ভেসে যাবে, রাইফেলের সমস্ত গুলি শেষ হয়ে যাবে৷ তবু রাগ ফুরোবে না৷"

তিন

বেশ অদ্ভূত ঘটনা ঘটেছে আজকে৷ তবে গত কয়েকদিন ধরে যা যা ঘটছে, সে হিসেবে এটা হওয়ারই ছিল৷ শফিক ও জাহিদ খুন হয়েছে৷ খুন বলা হচ্ছে একারণে যে ওদের মারা যাওয়ার ঘটনাটা সাধারণ নয়৷ কেউ একজন জবাই করেছে ওদের৷ এতে স্পষ্ট হয়ে গেছে যে কাজটা ঘাঁটিরই কেউ করেছে৷ কারণ পাকবাহিনী এদিকে আসেনি৷ আর তারা মারলেও জবাই করে মারত না৷ গুলি করে মারত৷ আশেপাশে তেমন লোকজনও নেই৷ সুতরাং, অন্যকারও কাজ এ নয়৷ তবে কাজটা ওই করেছে কিনা তা নিয়ে সন্দেহ কাজ করছে কামালের মনে৷ কিছু কারণে ওর ওপর সন্দেহ আরও প্রবল হয়ে উঠছে৷ কিন্তু পুরোপুরি নিশ্চিত হতে পারছে না কামাল৷
দুপুরে শফিক ও জাহিদ গিয়েছিল ফাতেমা চাচীর কাছ থেকে ভাত আনতে৷ ফাতেমা চাচী কামালদের জন্য ভাত রান্না করতেন৷ ঘাঁটি থেকে আধা কিলোমিটার দূরে ওনার বাড়ি৷ তার মেয়ে আর তিনি থাকতেন ওই বাড়িটায়৷ মেয়েটা কৈশোর ছেড়ে সবে যৌবনে পা দিয়েছিল৷ মেয়েটার কথা মনে হতেই কামালের বুকটা ছলাৎ করে ওঠে৷ মেয়েটাকে বেশ ভাল লাগতো ওর৷ কত যে স্বপ্ন সাজিয়েছিল ওকে নিয়ে... ইচ্ছে ছিল স্বাধীন দেশে দুজনে মিলে সংসার পাতবে৷ মন চাইত মেয়েটার লাজুক চোখে হারিয়ে যেতে৷ মেয়েটাকে দেখলেই খুশির ফোয়ারা ছুটত মনে৷ আবার ভয়ও হত৷ মনে হত এই বুঝি সব বুঝে ফেলবে মেয়েটা৷
কত কথা বলার ছিল মেয়েটাকে৷ কতবার বলতে চেয়েছিল, "জানিস, তোর খোঁপায় বেলি ফুল অপূর্ব লাগবে?" কিন্তু সব কথাই অব্যক্ত রয়ে গেল৷ মেয়েটাকেও মেরে ফেলেছে শয়তানটা৷ মেরেছে মেয়েটার মাকেও৷ সম্ভবত মেয়েটার মাকে আগে মেরেছে৷ তারপর মেয়েটাকে ধর্ষণ করেছে৷ ধর্ষণ করার পর খুন৷
কামালের বুকটা মুচড়ে ওঠে৷ হাহাকার বয়ে যায় হৃদয়ে৷ মেয়েটার নামটা পর্যন্ত জানা হয়নি৷ কুত্তাটাকে গুলি করে মেরে ফেলতে ইচ্ছে হচ্ছে৷ মনে হচ্ছে যেন রাইফেলের সমস্ত গুলি কুত্তাটার বুকে খালি করে দেয়৷ মুবিন হারামজাদাটা কিভাবে পারল এসব করতে?
যেদিন থেকে মুবিন ঘাঁটিতে এসেছে সেদিন থেকেই এসব শুরু হয়েছে৷ কমল মরার আগেও তো ওই কুত্তাটার সাথে ঝগড়া করেছিল৷ পরে কমল, রফিক, রতন, মুবিন আর জংলু- পাঁচজন গিয়েছিল একটা এ্যাকশনে৷ চার জনই মারা যায়৷ ফেরে শুধু মুবিন৷ এখানেই তো মূল খটকা৷
মুবিনতো আবার পশ্চিম পাকিস্তানে চাকরি করত৷ জানুয়ারিতে এসেছিল পূর্ব পাকিস্তানে৷ তারপর রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা ও অবস্থা আরও খারাপ হওয়ায় মুবিনের পশ্চিম পাকিস্তানে ফিরে যাওয়া হয়নি৷ কে জানে হয়তো পশ্চিম পাকিস্তানের জন্য দরদ পুষে রেখেছে মনে? আর ওপরে লোক দেখানো মুক্তিযুদ্ধ করছে৷ বেটা তো দেখি মাঝে মাঝে আবার পশ্চিম পাকিস্তানের গুণগানও গায়৷ ওর মুখটা দেখলেই কামালের ঘেন্না হয়৷ যে ভাবেই হোক ওর মুখোশ খুলে দিতে হবে৷

চার

গত কয়েকদিন ধরে মুবিনের ওপর চোখ রেখেছে কামাল৷ কিন্তু সন্দেহজনক তেমন কোন কিছুই দেখতে পায় নি৷ ছেলেটার বুদ্ধির প্রশংসা করতে হবে৷ বেশ ভেবে-চিন্তে কাজ করে ছেলেটা৷ তবে কামালও দমবার পাত্র নয়৷ ওর মুখোশ খুলেই ছাড়বে৷ ওই শয়তানটার জন্যই মেয়েটাকে হারিয়েছে কামাল৷ হারিয়েছে ভাইগুলোকে৷ কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কত যুদ্ধ করেছে একসাথে৷ কত পাক কুত্তাকে মেরেছে একসাথে৷ সে কথা মনে করে কামালের চোখের কোণে অশ্রু জমে৷ পরক্ষণেই সে অশ্রু মুছে নেয় কামাল৷ এর প্রতিশোধ ওকে নিতেই হবে৷
নিলয় দা'ও সবাইকে সাবধান থাকতে বলেছেন৷ কাউকে একা বাইরে যেতে নিষেধ করেছেন৷ তবে এজন্য অপারেশন কম হচ্ছে না৷ আগের মতই হচ্ছে৷ গত রাতেও কামাল একটা অপারেশনে গিয়েছিল৷ জয় নিয়েই ফিরেছে৷ তবে একফোঁটাও ঘুম হয়নি ফেরার পর৷ চোখে রাজ্যের ঘুম নেমে আসছে৷ বারান্দায় বসে ঝিমুচ্ছে কামাল ৷ হঠাৎ হন্ত দন্ত হয়ে ছুটে এল তুষার, "কামাল, ওই কামাল, পুকুর পাড়ে মুবিনের লাশ পাওয়া গেছে৷"
নিমিষেই সজাগ হয়ে ওঠে কামাল৷ চোখের সব ঘুম উধাও হয়ে যায়৷ মুবিন মরে গেল? কিভাবে সম্ভব? তাহলে কি অন্য কেউ? সব হিসেব গোলমাল হয়ে গেল কামালের৷
"কি বলছিস? কিভাবে?" উদ্বিগ্ন হয়ে জিজ্ঞেস করে কামাল৷
"গোসল করতে গিয়েছিল ওখানে৷ অনেক্ষণ হওয়ার পরেও ফিরে আসছে না দেখে ফিরোজ খুঁজতে যায়৷ দেখে মরে পরে আছে৷" কণ্ঠটা কেঁপে ওঠে তুষারের৷
কালক্ষেপণ না করে উঠে দাঁড়ায় কামাল৷ তীরের মত ছুটতে শুরু করে পুকুর পাড়ের উদ্দেশ্যে৷ পেছন পেছন ছোটে তুষার৷ অল্পক্ষণেই পুকুর পাড়ে পৌঁছে যায় ওরা৷ আগে থেকেই মুবিনের লাশের পাশে দাঁড়িয়ে আছে কয়েকজন৷ কামাল গিয়ে লাশটার পাশে দাঁড়ায়৷ লাশটাকে ভাল মত পর্যবেক্ষণ করে৷ একেও জবাই করা হয়েছে৷ গলার মাঝে গভীর ক্ষত৷ সারা দেহ রক্তে মাখামাখি৷ জায়গাটা ভেসে গেছে রক্তে৷ একজন মানুষের দেহে এত রক্ত থাকে!
কামালের প্রচন্ড ক্ষোভ হয় কুত্তাটার ওপর৷ হারামীটাকে চিনতে পারলে খুন করে ফেলত৷ লোহার শিক দিয়ে বুকের এফোঁড় ওফোঁর করে দিত৷ রাইফেলের সমস্ত গুলি শেষ করত কুত্তাটার বুকে৷ তবুও কুত্তাটার ওপর যে রাগ তা যেত কিনা সন্দেহ।

পাঁচ

ফায়ারিং চলছে অনবরত৷ একদিকে পাকসেনাদের আটজন৷ অন্যদিকে কামাল, ফিরোজ, তুষার, মকবুল আর ফাহাদ মোট পাঁচজন৷ রাতুলটা শহীদ হয়ে গেছে আগেই৷ কিন্তু এখন সেদিকে তাকাবার সময় নেই কারও৷ এরকম পরিস্থিতিতে অনুভূতিগুলো ভোঁতা হয়ে যায়৷ সবার মনোযোগ এক জায়গায় কেন্দ্রিভূত৷ পাকিগুলোকে মারতে হবে৷ এই অনবরত ঝাঁক ঝাঁক গুলির মাঝে অসতর্কতা মানেই বিপদ৷
প্রায় বিশ মিনিট গোলাগুলি স্থায়ী হয়৷ পাকিগুলো সব শেষ৷ ফিরোজ-তুষারও শহীদ হয়েছে৷ মকবুলের উরুতে একটা গুলি লেগেছে৷ বেশ গুরুতর জখম৷ রক্তপাত চলছেই৷ বেচারা নড়তে পারছে না৷ কামাল দৌড়ে এসে হাটুমুড়ে বসে মকবুলের পাশে৷ নিজের কোমরের গামছাটা একটানে খুলে মকবুলের উড়ুতে বাধার চেষ্টা করে৷ মকবুল ব্যথায় কুঁকরে ওঠে৷ কামাল গামছাটা বাধতে বাধতে ফাহাদের উদ্দেশ্যে বলে, "তাড়াতাড়ি কিছু পানি নিয়ে আয় তো ফাহাদ৷"
ফাহাদ কামালের পেছনে ছিল ৷ পেছন দিকে থাকায় কামাল খেয়াল করেনি যে ফাহাদ রাইফেল উঁচিয়ে এগিয়ে আসছে ৷
"তার আর দরকার হবে না৷" বেশ ঠাণ্ডা গলায় বলে ফাহাদ৷ ওর গলার স্বরে কিছু একটা ছিল৷ চমকে ওঠে কামাল৷ তার মেরুদণ্ড দিয়ে শিরশির করে কি যেন বয়ে গেল৷ মাথা ঘুরিয়ে তাকাতেই দেখতে পায় ফাহাদ রাইফেল উঁচিয়ে তার দিকে তাক করে রেখেছে৷ মুহূর্তেই ভয়ের শীতল স্রোত বয়ে যায় মস্তিষ্কে৷ কামাল হতভম্ব হয়ে জিজ্ঞেস করে, "তাহলে তুই, ফাহাদ?"
"হ্যাঁ আমিই৷" দৃঢ় কণ্ঠেই বলে ফাহাদ, "এখন মরার জন্য প্রস্তুত হ৷"
"তুই কেন এসব করলি ফাহাদ?"
"কথা বলার সময় নেই আমার৷"
"আমাকে তো মারবিই৷ মারার আগে এটুকু জানতে দে৷"
ফাহাদের মুখে বিরক্তি ফুটে ওঠে৷ মুখ খিঁচিয়ে বলে, "শোন তাহলে৷ তোর মরার আগে এটুকু তোকে শোনাতে পারি৷ প্রথম থেকেই তোদের ওপর ঘৃণা ছিল আমার৷ ঘৃণা ছিল ইয়াহিয়া-বঙ্গবন্ধুর ওপরে৷ ঘৃণা ছিল ওই পাক কুত্তাগুলোর ওপরেও৷ মনে আছে, আমি তোদের ক্যাম্পে যোগ দিয়েছিলাম মে মাসের সতের তারিখে? তার আগে আমি আমার পরিবারকে হারিয়েছিলাম... আমি ছিলাম নিরীহ এক যুবক৷ আমার এসব নিয়ে কোন মাথা ব্যথা ছিল না৷ আমি ছিলাম আমার মত৷ আমার বাবা-মাও ছিল সাধারণ৷ তারাও এসব নিয়ে মাথা ঘামাত না৷ আমার ছোট বোনটাও তো ছিল তার নিজের মত৷ আমাদেরকে নিয়ে ব্যস্ত থাকত৷ কি দোষ ছিল আমাদের? আমাদের নিজের মত থাকাটাই কি দোষ ছিল?"
ফাহাদের বুক থেকে একটা দীর্ঘশ্বাস বেড়িয়ে যায়৷ চোখের কোণে অশ্রুকণা চিকচিক করে৷ ফাহাদ আবার বলতে শুরু করে, "কিন্তু দশই মে, আমাদের গ্রামে আসে পাকি কুত্তাগুলো৷ হামলা চালায় আমাদের বাড়িতে৷ মেরে ফেলে আমার বাবা মাকে, আমার সাদাসিধে বাবা মাকে৷ ধর্ষণ করে আমার চৌদ্দ বছর বয়সের বোনটাকে৷ তারপর একটা গুলি ঠুকে দেয় বুকে... ওরা ছিল চারজন৷ দুজন আমাকে ধরে রেখেছিল৷ আমার চোখের সামনে ওরা করেছিল এসব৷ আমার বুকটা ফেটে যাচ্ছিল, পৃথিবীটা ভেঙ্গে যাচ্ছিল... ওদেরকে বাঁচাতে পারিনি আমি; সব হারিয়েছি৷ কিন্তু কার জন্য? তোদের সবার জন্য৷ ইয়াহিয়ার জন্য, বঙ্গবন্ধুর জন্য৷ ওই পাকি হানাদারগুলোর জন্য৷ ইয়াহিয়া যদি ন্যায়সঙ্গত ভাবে ক্ষমতা ছেড়ে দিত তাহলে এসব হত না৷ বঙ্গবন্ধু যদি বিক্ষোভের ডাক না দিত, স্বাধীনতার ডাক না দিত তাহলেও এসব হত না৷ তোরা যদি মুক্তিযোদ্ধাবাহিনী গঠন না করতি তাহলেও ওই পাকিগুলো তোদের খোঁজে আমাদের গ্রামে আসত না৷ আমাদের বাড়িতে আসত না৷ আমার মা, বাবা, বোন কেউ মারা যেত না৷ কেউ না৷ তোদের সবার জন্যেই আমি আমার সবকিছু হারিয়েছি৷ তোদের কি আমি এমনি এমনিই ছেড়ে দেব?"
ফাহাদের গাল বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়ছে৷ কেঁপে কেঁপে উঠছে ফাহাদ৷ গলার স্বর কাঁপছে, "ওদেরকে মেরে আমাকে ধরে নিয়ে যাচ্ছিল৷ হয়ত ক্যাম্পে নিয়ে টর্চার করে তথ্য আদায়ের উদ্দেশ্য ছিল ওদের৷ যদিও আমার কাছে কোন তথ্য ছিল না৷"
কিছুক্ষণ থেমে আবার বলতে শুরু করে ফাহাদ, "আমার গায়ে শক্তি বেশ ভালই ছিল৷ ওরা একটু অসতর্ক হতেই সুযোগ বুঝে সবগুলোকে ঘায়েল করে ফেলি৷ আমার তখন জীবনের মায়া বলে কিছু ছিল না৷ অন্তরে ভয় ছিল না৷ যা ছিল তা শুধু ওই পিশাচগুলোকে শেষ করবার ক্ষোভ... এরপর আমি ঠিক করি, আমি মুক্তিবাহিনীতে যোগ দেব৷ এখান থেকে সবার ওপর প্রতিশোধ নেব ৷ জীবনের মায়া নেই আর৷ মরলে মরব৷ কিন্তু প্রতিশোধ না নেয়া পর্যন্ত শান্ত হব না৷"
হঠাৎ মকবুল জিজ্ঞেস করে, "মিঠু আর ওয়াসীমকেও কি তুমিই মেরেছিলে, ফাহাদ ভাই?"
"হ্যাঁ, আমিই মেরেছিলাম৷"
"ফাতেমা চাচী আর তার মেয়েটাকে কেন মারলি? ওরা কি দোষ করেছিল?" জিজ্ঞেস করে কামাল৷
"অপরাধীকে যারা সাহায্য করে তারাও অপরাধী৷ ওরা তোমাদের সহায্য করেছে৷ তোমাদের জন্য রান্না করেছে৷ ওরাও সমান অপরাধী৷ তবে ফাতেমা চাচীর মেয়েকে আমি ধর্ষণ করিনি৷ শুধু লাশের অবস্থা এমন করেছিলাম যেন দেখে মনে হয় কেউ ধর্ষণ করেছে৷ যে ভাইয়ের বোন ধর্ষিত হয় সে কখনও কোন মেয়েকে ধর্ষণ করতে পারে না৷"
"পেছনে কে?" হঠাৎ উচ্চস্বরে বলে ওঠে কামাল৷
ফাহাদ মাথা ঘোরাতেই কামাল ক্ষীপ্র গতিতে হামলে পরে ফাহাদের ওপর৷ অপ্রস্তুত ফাহাদ সহজেই ধরাশায়ী হয়৷ কামাল ফাহাদের হাত ধরে হ্যাঁচকা টানে ঘাড়ের ওপর দিয়ে আঁছরে ফেলে মাটিতে৷ পিঠে হাত মুড়িয়ে মাটিতে চেপে ধরে ফাহাদকে৷ বলে, "ফাহাদ, তোকে সান্তনা দেবার মত কিছু জানা নেই আমার৷ কিন্তু... "
কামাল শেষ করার আগেই ফাহাদ বলে, "কিচ্ছু শুনতে চাই না আমি৷ আমাকে মেরে ফেল তুই৷ আমার আর বাঁচতে ইচ্ছে হয় না৷"
আকাশ বাতাস কাঁপিয়ে একটা গুলির শব্দ শোনা যায়৷ গাছে বসা শান্ত পাখিগুলো হুটোপুটি শুরু করে৷ কয়েকটা কাক গলা ফাটিয়ে চিৎকার করে৷ তারপর আবার সব শান্ত হয়ে যায়৷ একেবারে নিরব, নিস্তব্ধ৷
—০—
[[গল্পটার উদ্দেশ্য কখনই কাউকে খাট করে দেখানো নয় ৷ এখানে যেসব ধারণা, কর্মকান্ড ফুটে উঠেছে সবই চরিত্রভিত্তক ৷ পাঠককে প্রভাবিত করার উদ্দেশ্যে গল্পটি লেখা হয়নি ৷ গতানুগতিক ধারা থেকে কিছুটা ভিন্ন ধরণের কাহিনী ফুটিয়ে তোলার জন্যই গল্পটা লেখা ৷ এটাকে শুধু গল্প হিসেবেই নেয়া হোক ৷]]
(গল্পের আসর- সংকলন)

মন্তব্য ০ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.