![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
জীবনানন্দ দাশ ব্ল্যাকলেভেল বিক্রি করতেন
এমন পাড়া-গাঁ, সেকালে মাটির রাস্তায় বর্ষাবাদলের দিনে খুব কাদা হয়ে থাকত। সেই কাদার রাস্তায় ঘোড়ার গাড়িতে চড়ে গাঁয়ের বধুরা নাইওরে অাসত। অামার মা'ও নাইওরে অাসতেন মামাবাড়িতে, মামাবাড়ির গ্রামের নাম, ভায়না। সবাই বলত, তার ওপারে কেউ যায় না। সেই ভায়না গ্রামেই অামার জন্ম, এক ধাত্রীমার হাতে। সেই ধাত্রীমাকে অামি ছোটবেলায় দেখেছি, ভায়না ও অাশেপাশের দু'দশ গ্রামে তিনি ধাত্রীমা ছিলেন। সেসব গ্রাম বলতে নাম ছিল যেমন পাখিমারা, উত্তরপাড়া, জোড়াদহ, হরিশপুর, হরিশপুরের পাশেই সিরাজ সাঁইয়ের ভিটেমাটি অাছে। লালন জন্মেছেন এই হরিশপুরে, এক মুসলিমের ঘরে, এরকম মতান্তরের বিশ্বাস সাঁই ভক্তদের মধ্যে চালু অাছে হরিণাকুণ্ডতে, ঝিনাইদহ জেলায়। অাবার, কুষ্টিয়ার ছেউড়িয়াতে লালনের অাখড়া, সমাধি, এই ছেউড়িয়াতেই নাকি লালন জন্মছিলেন এক হিন্দুর ঘরে। এসব অামি ছোটবেলা থেকেই শুনছি, বড়দের মধ্যে। একই মানুষ, কেউ বলে মুসলমান, কেউ বলে হিন্দু, অার লালন নিজে বলে গেলেন, জাতের বিভেদ বুঝলাম না এ সংসারে। ছোটবেলার শোনা সেই অমীমাংসা বড়বেলাতেও মীমাংসা হলো না অামার, প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে উত্তরহীন, লালন, হিন্দু কি যবন?
প্রায় চৌদিকেই নদী ঘেরা থাকায় ভায়না গ্রামে স্বাভাবিকভাবেই মোটরযান ঢুকতে পারত না তখন, যখন অামি সেখানে বাল্যবেলা পার করছিলাম। সেখানে দুপুরবেলায় বিস্তৃত-নির্জন শিশুবাগানে খুব ঘুঘু ডাকত। ভয ভয় করা বাগানের প্রতি অামার একটা ঝোঁক ছিল। সে অামার প্রাইমারি ইশকুলের সূচনাপর্বের সময়। তারপর অামাকে মামাবাড়ি থেকে, ভায়না সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে নিয়ে যাওয়া হলো মধুপুরের পৈতৃক বাড়িতে, সেটা গাড়াগঞ্জ বাজারের পাশে, শৈলকূপাতে। ঝিনেদা জেলার মধ্যেই দুই থানার দুই গ্রাম, মধুপুর ও ভায়না। মধুপুরের ছেলেটির সঙ্গে সেকালের ঘটকপ্রথায় ভায়নার একটি মেয়ের বিয়ে হয়েছিল, সেই দম্পতিই অামার বাবা-মা। অামি তাদের প্রথম সন্তান। অামার দুই বোন অামার পরে জন্মেছে। অামার একটি ভাইও অামার পিঠেপিঠি জন্মেছিল, মুক্তিযুদ্ধের সময় জন্ম নিয়ে অামার ভাই 'মিলন' বেঁচেছিল মাত্র ছয়দিন। বারবার গ্রামের ডাক্তারকে ডাকলেও পাকিস্তানি ফৌজ ও তাদের দেশীয় দোসর রাজাকারদের ভয়ে ডাক্তার অাসেননি। অামার ভাইটিকে বাঁচানো যায়নি। শুধু একটি ইনজেকশন দিতে পারা যায়নি সেসময়ে, তাই ভাইটি ছয়দিন থেকেই মরে গেল যুদ্ধের সময়। এসব অামার বড় হয়ে ওঠার পর মায়ের কাছে শোনা। তো পৈতৃক বাড়ি মধুপুরে অাসার পর অামাকে ভর্তি করিয়ে দেওয়া হলো গাড়াগঞ্জ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। মধুপুরের পাশ দিয়ে পাকা রাস্তা, রাস্তার ধার দিয়ে অাঁকাবাঁকা কুমার নদ। অামরা বলতাম গাঙ। সে বয়সে হাফপ্যান্ট ডাঙায় খুলে রেখে গাঙে দিতাম ঝাঁপ। সেই অামাদের সাঁতার শেখা হলো। একবার সাঁতরে গাঙের ওপারে যাই, অাবার ফিরে অাসি।
অামাদের বাড়ির পাশেই বাড়ি নজরুল ভাইদের। নজরুল ভাই কাজী বংশের কেউ না, নাম সাক্ষর করতে পারেন কোনো মতে, তারপরও কেন যে নজরুল ভাই কাজী নজরুলের মতো বাবরি চুল রেখে ঘুরে বেড়াতেন, দেখে খুব কৌতূহলী ছিলাম। অামরা সেই কিশোর বয়সেই স্কুলের পাঠ্যবই থেকে বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের নাম জেনে ফেলেছিলাম। হয়তো 'খুকি ও কাঠবেড়ালি' পড়েও ফেলেছি। অামরা তখন বুঝতে চেষ্টা করছি, 'থাকব নাকো বদ্ধ ঘরে/ দেখব এবার জড়ৎটাকে...' কিম্বা 'অামরা যদি না জাগি মা, কেমনে সকাল হবে?' জানলাম, নজরুলের ডাক নাম দুখু মিয়া। অার জানলাম বিপ্লবী কবি সুকান্ত ভট্টাচার্যের ২১ বছর বয়সে যক্ষারোগে মরে যাওয়ার কথা। সুকান্তের অকালমৃত্যুকে মনে মনে মানতে পরতাম না। অথচ সুকান্ত মারা গেছেন অামার জন্মেরও কত অাগে! অার অামাদের এলাকা--শৈলকূপা অঞ্চলের দু'একজন করে কবির সঙ্গে অামার যোগাযোগ হচ্ছিল সেই সময়, যখন অামি হাই স্কুল পাড়ি দিচ্ছিলাম। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কবিতাও অামরা পড়লাম পাঠবইতে। পড়া হলো জসীম উদ্দীন, বন্দে অালী মিয়া, কাজী কাদের নেওয়াজ...কতজনের কবিতা। সবই পাঠ্যবইয়ে পড়া কবিতা। পাঠ্যবইতেই ছো্ট্ট করে লেখা থাকত কবির জীবনী। কবিকে মনে হতো অারেক ধরনের মানুষ। কী ধরনের! ধরনটা কেমন? এটা বলা সম্ভব নয়। তবে কবি অঅরেক ধরনের মানুষ, কিম্বা পুরো মানুষ কীনা, তারও নির্ণয় নেই মনের কাছে।
বাংলা কবিতা সম্পর্কে অামাদের স্কুলের পাঠ্যবই একটা ধারণা দিল অামাকেও। কিন্তু কবে যেন, নাইনে থাকতেই, নাকি টেনে ওঠার পর, ঠিক মনে করতে পারছে না অামার মেমোরি, কে যেন অামাকে বলল, 'বনলতা সেন সম্পর্কে কিছু জানো?'
'সে কে?'
'সে খুব সুন্দরীএক দীর্ঘচুলের নারী, তার চোখ দুটো হচ্ছৈ পাখির বাসা। তাকে নিয়ে জীবনানন্দ দাশ কবিতা লিখেছেন।'
'তাই? তার চোখই পাখির বাসা?'
'হ্যাঁ, তুমি যদি পাখি হতে পারো, তুমিও বনলতা সেনের চোখের মধ্যে থাকতে পারবা।'
সে হয়তো কথার কথা। কিন্তু দু'দিন পরই গাড়াগঞ্জ থেকে বাসে চড়ে কুষ্টিয়া গেলাম। 'বই মেলা' নামের এক পুরোনো বইয়ের দোকান থেকে এক কপি 'বনলতা সেন' কিনে বাড়ি ফিরলাম। হারিকেনের অালোয় সারারাত 'বনলতা সেন' বইটি নিয়ে পড়তে শুরু করলাম। বইয়ের প্রথম কবিতাই 'বনলতা সেন'। অারো অনেক কবিতা ছিল বইটির মধ্যে। বেশির ভাগ কবিতাই অামার সম্পূর্ণ ধরে ওঠা সম্ভব হচ্ছিল না। তাই বনলতা সেনকে ধরার নেশায় কিম্বা জীবনানন্দ দাশকে জানার নেশায় অামি বারবার পড়েছি একই কবিতা, কী অর্থ এর? বনলতা সেন, অরুণিমা সান্যাল, সবিতা, অনন্ত নক্ষত্ররাজির গতিবিধির দর্শক, জীবনানন্দের?
জীবনানন্দ দাশের লেখা কবিতা, ছোটগল্প, উপন্যাস, চিঠিপত্র পড়ি, মাঝেমধ্যেই পড়ি। কবিকে নিয়ে লেখা স্মৃতিচারণা পড়ি। লাবণ্য দাশকে পড়ি। কবির মা কবি কুসুমকুমারী দাশকে পড়ি। কবির মেয়ে মঞ্জুশ্রী দাশকে পড়তে চেয়েছি। ধরতে চেয়েছি। যে চাওয়ার শুরু সেই কৈশোরে, এখনো সেই কৈশোর কাটেনি। জীবনানন্দ দাশের সামনে অামি কিশোরই থেকে গেলাম। কীভাবে? বলি?
'বনলতা সেন' বইটির প্রচ্ছদ ছিল এক মনকাড়া রমণীর মুখ। ব্যাপক চুল তার মাথায়। চোখও টানা টানা। বইটির প্রচ্ছদে ব্যবহৃত রমণীর চোখ 'পাখির নীড়ের মতো' কীনা, তাতে অামি সন্দেহ করি। কারণ, ঢাকার বাংলাবাজারের কোনো এক প্রকাশকের বউয়ের মুখই নাকি সেই মুখ। এটা জেনেছিলাম অবশ্য পরে। অামি সেই বইয়ের প্রচ্ছদে ব্যবহৃত রমণীর মুখে দেখলাম কাম। কিন্তু অামি বনলতা সেনের সঙ্গে প্রথমেই কাম করতে চাইনি, বিশেষ করে সেই বয়সে। অবশ্য জীবনানন্দ দাশের কবিতা তখনও অামার বোধগম্যতার মধ্যে পড়ে না, তাই পড়তেই থাকি। পড়তে পড়তে, একাধিক পঠনের মাধ্যমে অামি তখন বুঝতে না পারা কবিতাগুলো বোঝার চেষ্টায় বুঁদ থাকতাম। এভাবেই, অচিরেই টের পেয়ে গেলাম, দাশ একটা দেশ। কবিতার নতুন দেশ। যেরকম কবিতা অামরা মানে অামি ও অামার গুটিকয় বন্ধুরা অাগে কখনো পড়িনি। কী সুন্দর, একটা ধ্যানী বকের মতো বসে থাকি এক ঝিলের ধারে, ঝিলটাই সেই কবি, কবিতাগুলো হয়তো মাছ, ফলে, মাছ খেয়ে বেঁচে থাকতে চাই। মাছ বলতে কবিতা, জীবনানন্দ দাশের কবিতা। মজে গেলাম ট্রামে ধাক্কা খেয়ে মরে যাওয়া এই কবির কবিতার মধ্যে। 'রুপসী বাংলা' 'কালবেলা অবেলা', 'সাতটি তারার তিমির'... সামুদ্রিক নাবিকের স্মৃতি জমে উঠল জীবনানন্দ দাশের কবিতা পড়তে পড়তে। খালি মনে হতে লাগল, এইরকম একজন কবি বাংলাভাষায় জন্ম নিয়ে মরেও গেলেন মাত্র ৫৪ বছর বয়সে, কোলকাতায়, ট্রামের ধাক্কায়, এ কেমন কথা! এই কবি তো কোনোদিন মরবেন না। বাংলার বরিশালে জন্ম নিয়ে নিজেকে তিনি কবিতা লিখেই অমরত্বে রেখে গেছেন। বাংলাভাষায় এই টেস্টে কবিতা অার কারো নেই, শুধু তার, শুধু তার। যেন ঈগল ওড়া জোসনায় ভেসে যাওয়া চরাচারের সবটুকু ধূধু তার, ধূধু তার। শুধু তার, ধূধূ তার। একরাতে, সেই ধূধূ চরাচারের জোসনায় কবির সঙ্গে অামারও দেখা হয়েছিল, বাগেরহাটে। তখন তিনি বাগেরহাট পিসি কলেজের ইংরেজি বিভাগে তরুণ লেকচারার হিসেবে জয়েন করেছেন। যদিও জীবনানন্দ দাশের কবিতায় অামরা পাই এক নদবিধৌত অাত্মগত-লোকায়ত এক বাংলা, বরিশাল, বাংলাদেশ, কবি বিয়ে করলেন ঢাকায়, ইডেন কলেজের স্বদেশি করা মেয়ে লাবণ্যকে, যিনি হলেন লাবণ্য দাশ। কবির বউ। অার কবি মরলেন কোলকাতায়। তার চিতাভষ্ম দাহ হলো কেওড়াতলা শ্মশানে। কিন্তু কবি অমর হয়ে গেলেন বাংলাভাষার কবিতাপাঠকের ঝিরিঝিরি অন্তরে।
তারপর কবির মৃত্যুর পর ট্রাঙ্ক খুলে খুলে মানে ধরা যাক প্যান্ডোরার বাকশো খুলে খুলে ভূমেন্দ্র গুহ'রা তো বের করলেন কবির গদ্যসামগ্রী। পড়লাম 'জলপাইহাঁটি' 'কারুবাসনা' 'প্রেতিণীর উপকথা', 'মাল্যবান' অার ছোটগল্পসমগ্র। গতবছর তো কবি ভূমেন্দ্র গুহও চলে গেলেন। অামি জানি না, জীবনানন্দ দাশের রেখে যাওয়া ট্রাঙ্ক বা প্যান্ডোরার বাকশের অার কিছু প্রকাশের অগোচরে রয়ে গেছে কীনা! রয়েছ কবিতা নিয়ে লিখিত গদ্যে বই 'কবিতার কথা' অাছে কিছু চিঠিপত্রও।
কবিতার জীবনানন্দ যেমন স্বতন্ত্র, গদ্যের জীবনানন্দও তেমন স্বতন্ত্র ও শক্তিশালী। তবে ১৯৫৪ সালে মৃত্যুর পর থেকে ক্রমশ বিস্তৃতি-স্বীকৃতি পেয়েই চলেছেন। এক সৌভাগ্যবান নৃপতির মতো। কবিতার জীবনানন্দ পরবর্তী প্রায় ষাট বছর অতিক্রম করে অঅসা সময়েও বাংলা কবিতার এক শাসন কর্তা। সমস্ত তর্কের পরেও এটা এখন পর্যন্ত সত্য, যে সত্য উপলব্ধিজাত। ল্যাবরেটরিজাত নয় নিশ্চয়ই কবিতার সত্য। অার ল্যাব থাকলেও সেটা থাকে কবিতার শব্দ-বাক্যের মধ্যেই জড়িয়ে। সেই ল্যাব রিচার্চ করেন পাঠক। কিন্তু অামি অাসলে এই অালাপন শেষ করব জীবনানন্দ দাশ অামাকে কি দিলেন, কতটা তার নিতেই পারলাম, তাই নিয়ে।
এরকম তো না যে, জীবনানন্দ দাশ অামাকে ঢাকায় একটি ফ্ল্যাট দিয়েছেন, রাঙামাটিতে একটা পাহাড় কিনে দিয়েছেন! জীবনানন্দ দাশ অামাকে একটি বইও কিনে দেননি, বরং প্রচুর বই কিনিয়েছেন। নিজেরগুলো তো কিনিয়েছেনই, কিনতে বললেন প্রেমেন্দ্র মিত্র, বুদ্ধদেব বসু, বিষ্ণু দে, অমিয় চক্রবর্তী, দীপ্তি ত্রিপাঠি, সঞ্জয় ভট্টাচার্য, ভূমেন্দ্র গুহ, অাবদুল মান্নান সৈয়দ, ক্লিনটন বি সিলি, উইলিয়াম রাদিচে...শতাধিক বই তো হবেই, যা জীবনানন্দ দাশের কারণেই অামাকে কিনতে হয়েছে। এই যে শতাধিক বই অামাকে শ্রী সর্বানন্দ দাশ ও কবি কুসুমকুমারী দাশের বড় ছেলে অামাকে টাকা খরচ করে কেনালেন, এখনো কিনিয়েই যাচ্ছেন, অামি তার কী ক্ষতি করেছিলাম! কত যে লিটল ম্যাগাজিন কিনলাম, প্রতিক্ষণ, অানন্দ, দেজ, অবসর কিনলাম, মঞ্জুশ্রী দাশের বাবার কারণেই কিনলাম। মিলু; ওর ডাক নাম, মিলুর কথামতোই কিনলাম। কিনলাম তো কিনলাম, এক রহস্যবনের কুয়াশাসমগ্র কিনলাম। মনে হলো, লোকটা এখানকার কেউ ছিলেন না, লাবণ্য দাশের হাসব্যান্ড ছিলেন না, ছিলেন গ্রহান্তরের মানুষ। মানুষ? মানুষ কিম্বা শঙ্খচিল, পেঁচা কিম্বা কাক, কাক কিম্বা ভোরের দোয়েল এবং ছিলেন একটি শালিক। ছিলেন চিল, সোনালি ডানার চিল, সারাদিন যার কাজই হচ্ছে, কান্না চেপে উড়ে বেড়ানো। হৃদয় খুঁড়ে বেদনা জাগানোর শোকাশ্রু চেপে উড়ে উড়ে বেড়ানো 'হায় চিল' ছিলেন কবি?
কী ছিলেন কবি? কে ছিলেন কবি? নাকি জীবনানন্দ দাশ নামে কেউ ছিলেন না কখনো! 'নির্জন সাক্ষর' লিখেছেন এক শালিক, 'মাল্যবান' লিখেছেন হেমন্তের সন্ধ্যা নিজেই! এমন বিষাদ অামরা অাগে দেখিনি 'কবেকার পাড়াগাঁ'র অরুণিমা সান্যালের মুখে'। অস্তিত্বের এমন স্বরচিত সংকট, অসহায়ত্বের এমন মধুর ব্যঞ্জনাও যেন শুনিনি অামরা। 'এক ভিড় হরিয়াল পাখি' উড়ে যেতে যেতে বলল, দুই পায়ে হেঁটে কতদূর যেতে পারে মানুষ একাকী? মানে সঙ্গী লাগে। সেই সঙ্গী যদি না মেলে! অাবার শুরু হলো অাত্মপলায়নপরতা। অন্য কোনো সময়ে চলে যাওয়া যায়। শালিক উচাচারণ করলেন, 'কেউ যাহা শোনে নাই, কোনো এক বাণী, অামি বয়ে অানি'। বললেন, 'নগরীর মহৎ রাত্রিকে মনে হয় লিবিয়ার জঙ্গলের মতো।' পরে একদিন অামাকে কে যেন বলল, লিবিয়ায় দুই চারটা খেঁজুরগাছ ছাড়া কিছু নেই, জঙ্গল অাসবে কোত্থেকে? অর্থাৎ জীবনানন্দ দাশ লিবিয়ায় একটি জঙ্গল প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।
সেই জঙ্গলে চিতা ছিল? রাতের অন্ধকারে চিতার জ্বলন্ত চোখ কি নক্ষত্র হয়ে গেছে, জীবনানন্দ দাশের কবিতায়? বাংলা কবিতায় সম্ভবত এত নক্ষত্র অামরা অার অন্য কারো কবিতায় খুঁজে পাব না। এত এত চিল, শালিক, ঘুঘু, পানকৌড়ি, ফড়িং-গঙ্গা ফড়িং ব্যবহৃত হয়েছে তাঁর কবিতায়, যেন সত্যিই এক বাগানবাড়িতে ধানসিঁড়ি নদীর তীরে তিনি হেঁটে বেড়াচ্ছেন।
অামাদের ঝিনেদা শহরের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত নবগঙ্গা নদী। নদীর দু'ধারে বেলে-শীতকাল রোদ পোহাতে থাকে। ঝিনাইদহ শহরের প্রধান দুটি সড়কের নাম, 'গীতাঞ্জলি সড়ক' ও 'অগ্নিবীণা সড়ক'। শহরের নবগঙ্গা নদীর ধারে সারি সারি শতবর্ষী দেবদারু গাছ। বিকেলেই সেই দেবদারু গাছে থোকা থোকা অন্ধকার ঝিম হয়ে থাকে। পাশেই পুরোনো কোর্ট, জমি রেজিস্ট্রি অফিস। এক সন্ধ্যায় রাস্তাটার নাম দিয়েছিলাম, 'দেবদারু এভিনিউ'। এতে কবি খুব খুশি হয়েছিলেন, কারণ, নদীর ধারের রাস্তার নামটা দেবদারু এভিনিউ রেখেছি জীবনানন্দ দাশের স্মরণে, সে কথা কবিকে বলেওছি। সন্ধ্যার পর রাতের অন্ধকারে ওই দেবদারু গাছে স্তব্ধতা অনুবাদ হওয়ার অপেক্ষায় বসে থাকে। অামাদের মফস্বলের কবি বন্ধুরা সেই স্তব্ধতা অনুবাদ করতে চেয়ে কতরাত কাটিয়ে দিয়েছি নবগঙ্গা নদীর পাড়ে, দেবদারু এভিনিউতে, জীবনানন্দ দাশের কবিতার ভেতর দিয়ে।
বরিশালে অামার বন্ধু হেনরী স্বপন ও অালফ্রেড খোকন। ওদের কাছেও শুনি, ওরা বলেন, কবিকে ওরা দেখেছেন। জীবনানন্দ দাশকে ধানসিঁড়ি, ফুল্লশ্রী নদী, সন্ধ্যা নদী, কীর্তনখোলা নদীর পাড়ে একলা ঘোরাঘুরি করতে দেখেছেন। কবির মা'ও ছিলেন কবি। অাদতে তারা বিক্রমপুরের লোক। কবির মা কবি কুসুমকুমারী দাশ, যিনি লিখলেন, 'অামাদের দেশে হবে সেই ছেলে কবে/ কথায় না বড় হয়ে কাজে বড় হবে।' কুসুমকুমারী দাশের ছেলে মিলু, অামাদের অগ্রজ জীবনানন্দ দাশ বাংলা কবিতায় এক অপ্রতিদ্বন্দ্বি ও পরাক্রমশালি কবি। বাংলা ভাষা জীবনানন্দের কাছে ঋণী হয়ে পড়েছে। সংষ্কৃতির অন্যান্য শাখাতেও এই কবি তার অাপন অস্তিত্বে বিম্বিত হয়েছেন, হচ্ছেন। সেকারণেই, জীবনানন্দকে অনেক চেনা চেনা লাগে। প্রিয়জন লাগে। পরম অগ্রজ মনে হয়। তার নিঃসঙ্গতা বিদিত বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে, অার অামরা নিঃসঙ্গতা কাটাই তার লেখার মধ্যে ঢুকে। এই হচ্ছে জগৎসংসার। কবি এই সংসারের উর্ধে এক অন্য সংসারের বাসিন্দা ছিলেন, যদ্দুর ধারণা করি। নইলে শ্লথগতির ট্রামের নিচে মানুষ পড়ে নাকি?
একবার, মোস্তফা সরয়ার ফারুকী, অামাদের বন্ধু, যখন বানাচ্ছিল ওর প্রথম সিনেমা 'ব্যাচেলর'।' অভিনেতা হুমায়ুন ফরিদী অার অামার পাট ছিল সমুদ্রের ধারে, কক্সবাজারে। রাতে অামরা ছিলাম 'সি-গাল' হোটেলে। সি-গালে অামাদের নৈশসঙ্গ দিয়েছিল 'ব্ল্যাকলেভেল'। মারজুক রাসেল, অামি অার ফরিদী ভাই 'ব্ল্যাকলেভেল' ভেসে যাচ্ছিছিলাম। রাত গড়িয়ে যাচ্ছে। হোটেলের স্যুটে সব বাতি নিভিয়ে দিলেন কবি হুমায়ুন ফরিদী। ফরিদী ভাই যখন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলেন, ম্যাগাজিনে লিখেছেন কবিতা। সেই কবির কবিতার দুইটা চরণ অামি পড়েছি যশোর ইনস্টিটিউট অব পাবলিক লাইব্রেরির অন্দর দেয়ালে। সেই দেয়ালে অারো অনেক কবির কবিতার পংক্তি লেখা ছিল। জীবনানন্দ দাশেরও ছিল, অাজীজুল হকের ছিল, অাবুল হাসানের ছিল, রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহর ছিল। অারো অনেক কবির কবিতা পড়েছি। কিন্তু সেই রাত, সি-গালের বাইরে সামুদ্রিক জোসনায় ভেসে যাওয়া রাত। হঠাৎ ফরিদী ভাই বললেন, 'তারপর থাকে শুধু অন্ধকার, মুখোমুখি বসিবার, ডট ডট ডট, ব্ল্যাকলেভেল। কী, হলো তো?
বললাম, 'হলো।'
'কী হলো?'
'ব্ল্যাকলেভেলের বিজ্ঞাপন হলো।'
'ভেবে দ্যাখো, কবিতার ওই দুটি শব্দ, বনলতা সেন উঠিয়ে দিয়ে শুধু ব্ল্যাকলেভেল বসিয়ে দিলেই ব্যস...হয়ে গেল। ঢালো। ঝিমাচ্ছ কেন?
মারজুক ও অামার ঝিমানো ছুটে যায়। কারণ, বোতলে তখনও অনেকখানি বনলতা সেন রয়ে গেছে। গ্লাসে ঢালতে হবে...
হুমায়ুন ফরিদী মরে গেছেন এক পহেলা বসন্তে, বনলতা সেনের ঝুলনমায়ায়। শঙ্খ ঘোষ হ্যাঙওভারকে বলেছেন ঝুলনমায়া। সন্ধ্যার অন্ধকার নামলেই অামি ও অামার বন্ধুরা গ্লাসে ঢেলে নিচ্ছি বনলতা সেন, গলায় ঢেলে দিচ্ছি বনলতা সেন।
মাতাল হয়ে বাড়ি ফিরছি। জীবনানন্দ দাশ অন্ধকারে ব্ল্যাকলেভেল বিক্রি করতেন।
২| ২০ শে এপ্রিল, ২০১৬ বিকাল ৩:০৩
আলী বলেছেন: তারপর থাকে শুধু অন্ধকার, মুখোমুখি বসিবার, ডট ডট ডট, ব্ল্যাকলেভেল
৩| ২১ শে এপ্রিল, ২০১৬ রাত ২:৩৯
ফারগুসন বলেছেন: হুম----তুমিই পারবে ঠাকুর------- তবে অনেক খেতে হবে ।
©somewhere in net ltd.
১|
২০ শে এপ্রিল, ২০১৬ সকাল ৯:৩৬
আবুহেনা মোঃ আশরাফুল ইসলাম বলেছেন: হুম!