![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
১.
হিমু আজ শুয়ে আছে কাজী সাহেবের ডেরায়। কাজী সাহেব মানে কবি কাজী নজরুল ইসলাম। হিমু কখনো কাউকে সাহেব ডাকে না। হিমুর চোখে সব মানুষই সাধারন। সে নিজেও অতি সাধারন। কিন্তু একটা অদ্ভুত কারনে কাজী নজরুল ইসলামকে সাহেব ডাকে। সেই অদ্ভত কারনটা আজো বের করতে পারেনি। কাজী সাহেব হিমুকে মাঝে মাঝে খবর করেন। যখন উনার খুবই একা একা লাগে তখন তিনি হিমুকে খবর দেন। তিনি হিমুকে খুবই ভালোবাসেন। হিমুর গল্প শুনতে পছন্দ করেন। হিমু তাই মাঝে মাঝে রাত যখন গভীর হয়, পৃথিবী যখন নিস্তব্দ হয় তখন চলে আসে কাজি সাহেবের ডেরায়। কাজী সাহেব হিমুকে কাছে ডেকে কপালে চুমু দেন। তারপর শিশুসুলভ কন্ঠে বলেন
- গল্প শোনাও। তোমাদের সময়ের গল্প। প্রেম আর দ্রোহের গল্প।
হিমু ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে গল্পের বাদশার দিকে। গল্পের বাদশা যখন গল্প শুনতে চান তখন অবাক হওয়াই স্বাভাবিক। একবার হুমায়ুন আহমেদও হিমুর কাছে হিমুর গল্প শূনতে চেয়ে অবাক করে দিয়েছেলেন।
তবুও হিমু শুরু করে। হিমু প্রেমের গল্প শুরু করে। হিমু রূপার গল্প বলে। কাজী সাহেব মুচকী হাসেন।
যখন ই হিমু কাজী সাহেবের কাছে আসে কাজী সাহেব গল্প শুনতে চান আর হিমু প্রত্যেক বারই রূপার গল্প শোনায়। কাজী সাহেব প্রত্যেকবারই মুচকী হাসেন।
হিমু আজ একটু ক্লান্ত। ক্লান্ত হতে হয়েছে তাকে। সারা ঢাকা শহর খুঁজে সে সোনামুখী সুই পায় নি। রূপা তাকে সোনামুখী সুই কিনে দিতে বলেছিলো। নিউমার্কেট, শাহবাগ, গুলিস্তান, ধানমন্ডি কোথাও সে সোনামুখী সুই পায় নি। তাই সে ক্লান্ত। কাল সকালে যে করেই হোক সোনামুখী সুইয়ের ব্যবস্থা করতে হবে। না হলে রূপা মুখ গোমরা করবে। রূপাকে গোমরা মুখে দুঃখী দু্ঃখী লাগে। সোনামুখী সুইয়ের কথা ভাবতে ভাবতে হিমু কাজী সাহেবের পাশে ঘুমিয়ে পরে।
২.
-হিমু, হিমু, এই হিমু।
কাজী সাহেব হিমুকে ডাকছেন। সে ধরফরিয়ে ঘুম থেকে উঠে।
- জি কাজী সাহেব।
- তোমার যাবার সময় হয়েছে। আমি মুসল্ললিদের পদদধনি শুনতে পাচ্ছি। একটু পরই মুআজ্জিন আযান দেবেন।
হিমু চোখ মুখ কচলিয়ে আরমোড়া ভেংগে দাঁড়ায়। কাজী সাহেবের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে পা বাড়ায়।
কাজি সাহেব হাতটা বাড়িয়ে হিমুর হাতে হাত রাখেন। বলেন
- হিমু, সামনের বার যখন আসবে তখন একটা দ্রোহের গল্প নিয়ে এসো। আমি দ্রোহের গল্প শুনতে চাই।
হিমু নজরুল সমাধী থেকে বের হয়ে, হাঁটা দেয়ার সাথে সাথে মুআজ্জিন আযানের সুর তুলেন। মোহনীয় একটা সুর রাতের নিস্তবদ্ধতা ভেঙে ভোরের জানান দিচ্ছে যেনো।
"হাইআলাস সালাহ
হাইআলাল ফালাহ"
হিমু একটু থমকে দাঁড়ায়। কি যেনো ভাবে। তারপর পথ ঘুরিয়ে মসজিদের দিকে রওয়ানা দেয়। হিমু আজ নামাজ পড়বে। কেন নামাজ পড়বে এটা সে জানেনা। হিমু কোনদিন নামাজ পড়েনি। কেউ তাকে নামাজ পড়ার কথা বলেনি। নামাজ কিভাবে পড়তে হয় তাও তার জানা নেই। তবুও সে আজ নামাজ পড়বে। তার মনে হচ্ছে মুআজ্জিন তার কানে কানে বলছেন "হিমু ভাই, ও হিমু ভাই এসো নামাজ পড়ি।"
নামাজ শেষে সবাই বের হয়ে যাচ্ছে। নামাজে আসা মুসল্লীদের মধ্যে এক ধরনের আতংকিত বোধআছে বলে অনুভব করছে হিমু। হিমু ভাবে কেন এদেরকে এতো শংকিত মনে হচ্ছে। সবাই কেমন যেনো চুপচাপ নামাজ পড়েই সটকে পড়ছে। বিষয়টা হিমুর বোধগম্য হলোনা। তবে সে বুঝতে পারলো সাংঘাতিক একটা কিছু হচ্ছে আশে পাশে। তাই সবাই সেই সাংঘাতিক কিছুকে এড়াতে চাচ্ছে।
হিমু মসজিদ থেকে বের হয়। লাইব্রেরির দিকে সে রওয়ানা দিলো। হিমুর মনে হলো অপরাজেয় বাংলাতে একটু যাওয়া দরকার। ভোর বেলাতে তিন মুক্তিযোদ্ধার সংগে একটু কথা বলা দরকার। আজ হিমু নামাজ পড়েছে সে খবরটাও দেয়া দরকার।
-এই থাম। দুই হাত উপরে।
হিমুর কাছে এসব নিত্য নৈমিত্তিক ব্যাপার। পুলিশী হয়রানী। রুটিন চেক। আজকাল এই এলাকায় অনেক টহল পুলিশই তার পরিচিত হয়ে গেছে। হিমু থামলো। হাত উপরে উঠালো। ইদানিং তল্লাশী নামের হয়রানীটা বেড়ে গেছে। তাই হিমু এর নাম দিয়েছে "হায়েনা তল্লাশী।" পাশ থেকে একটা কনস্টেবল বললো
- কিছু নেই স্যার। ছাইড়া দিমু?
লম্বামতো একটা লোক এগিয়ে আসে। চোখে সানগ্লাস। এতো ভোরে কেউ সানগ্লাস পরতে পারে তা হিমুর জানার বাইরে। দেখতে একটা বদমাইশ মনে হচ্ছে। সেই লোকটা হিমুর পা থেকে মাথা পর্যন্ত মাপতে থাকে।
- হুমম, পাঞ্জাবী, দাঁড়িও আছে। মাসজিদ থেকে বের হৈছে। পুরা ব্যাপারটার মাঝে জংগি জংগি ভাব আছে। এটা নির্ঘাত শিবির।
- জিনা আমি শিবির না। আমি হিমু, বলে হিমু একটু এগিয়ে যায় চশমা পরা বদমাইশটার দিকে। হিমুর মনে হলো সে এই লোকটাকে কোথায় দেখেছে। কিন্তু মনে করতে পারছে না।
-তুই শিবির না হলে মসজিদে গেছিস কেনো। দাঁড়ি রাখছস কেনো? এই পিযুস হ্যান্ডকাফ লাগা। নাশকতা মামলায় হান্দাইয়া দে শালারে। শালা শিবির না হলে ছাত্রদলতো হবেই। নিশ্চিত থাক এটা ছাত্রলীগ না।
- আমিতো নাশকতা করিনি।
- এই বেটা এতো কথা কস ক্যানো। বলেই লোকটা হিমুর শ্বাসনালী চেপে ধরলো। হিমু এইবার খুব কাছে থেকে লোকটাকে দেখে চিনতে পারলো।
মিনিট খানেক পরে হিমু মুক্ত হলো বদমাইশটার হাত থেকে। কিছুক্ষন খুক খুক করে কাশলো। হিমুর মুখ লাল হয়ে গেছে। কিন্তু হিমুর মাথা আশ্চর্য রকমের শান্ত আছে। একটুও ক্ষোভ নেই তার মনে। হিমু মাথাটা সোজা করে শান্ত চাহনী দিয়ে বললো
আপনার নাম প্রদীপ সাহা। আপনি আইনের পোষাক পরে বেআইনিভাবে অতি নিষ্ঠুরতার সাথে মানুষ কে গুলি করেছেন। আপনার কঠিন শাস্তি হবে।
কথাটা হিমু ঠিক মতো শেষ করতে পারেনি। তার আগেই ওসি প্রদীপ সাহা একটা লাত্থি দিলো তল পেটে। হিমু ছিটকে পড়লো প্রায় তিন চার হাত দূরে। প্রদীপ সাহা চিৎকার করে বললো শওরের বাচ্চা যুদ্ধাপরাধীকে থানায় নিয়ে মাশকালাই লাগা।
৩.
হিমুকে পুলিশের গাড়িতে উঠানো হলো। হিমুর হাতে হ্যান্ডকাফ লাগানো।তার পাশে বসা একটা কন্সটেবল এর দিকে তাকিয়ে বললো
- আপনার ব্যাজ নেই কেনো?
খেক করে কনস্টেবলটি বললো, কথা কবি না, একদম কথা কবিনা। শুওরের বাচ্চা।
উল্টা পাশে বসা জনের ব্যাজ আছে দেখে বললো। আপনার নাম সুজিত।
আচ্ছা সুজিতদা আপনি কি জানেন ঢাকা শহরের কোথায় সোনামুখী সুই পাওয়া যায়?
কনস্টেবল সুজিত ভ্রু কুঁচকে তাকালো হিমুর দিকে। এই প্রদীপ রাজ্যের আন্ডারে কেমন করে একজন মানুষ এতো দ্বিধাহীন, ভয়হীন থাকতে পারে তা নিয়ে কন্সটেবল সুজিত চিন্তিত হয়ে পড়লো বলে মনে হচ্ছে। সে কোন উত্তর দিলো না।
পাশ থেকে ব্যাজহীন পুলিশটা আবারো কুকুরের মতো খেক করে বললো, কথা কবি না । একদম কথা কবিনা শুওরের বাচ্চা।
- আচ্ছা আপনার সমস্যা কি? আপনি কি আপনার বাবা-মাকেও শুওরের বাচ্চা বলেন নাকি?
ধিরিম করে হিমুরকোমরে আরো একটা লাত্থি দিলো সে...
গাড়ি থেকে হিমুকে নামানো হলো। ঘাড় ধরে থানায় নেয়া হচ্ছে। হিমু জানে থানায় যাওয়া মাত্রই কেউ না কেউ তাকে চিনে ফেলবে। আর হিমুকে ছেড়ে দেওয়া হবে। কারন সে ইতোমধ্যে অসংখ্যবার থানায় এসেছে। এবং বারবারই তাকে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। নিউ মার্কেট থানার সবাই তাকে চিনে।
কিন্তু থানায় কাউকে চিনতে পারলো না। বরং অনেক গুলো ছেলে বা যুবকদের ধরে আনা হয়েছে। কারো হাত থেকে রক্ত পরছে, কারো জামা কাপড় ছেড়া ও শরীর থেকে রক্ত পরছে। কেউ কেউ খোড়াচ্ছে। কারো পায়ে গুলি। কারো পেটে গুলি। প্রায় সবাই চিৎকার করছে। এই প্রথম হিমুর বিশ্বাস করতে হচ্ছে নরক বলতে কিছু একটা আছে। দমবন্ধ হয়ে যাচ্ছে। এমনকি সে বিশ্বাস করছে সে এখন একটা নরকের মধ্যে দাঁড়িয়ে আছে। আর এই নরকের পরিচালক হচ্ছে ওসি প্রদীপ সাহা।
হিমুর এই প্রথম মনে হচ্ছে এখান থেকে বের হওয়া খুব মুশকিল হবে। তাই যা করার দ্রুত করতে হবে। রূপার জন্য সোনামুখী সুইের ব্যবস্থা করতে হবে। আজকের ভেতরে যদি সোনা মুখী সুই সে ব্যবস্থা করতে না পারে তাহলে রূপা ভিষন রাগ করবে। রূপা কে রাগানো যাবে না।
পাশের একটা কন্সটেবলকে বললো। পুলিশ ভাই একটা ফোন করা যাবে আপনার মোবাইল থেকে। পুলিশটি কোন উত্তর দিলো না, ঘাড় ধরে একটা ধাক্কা দিয়ে আধো আলো আধো অন্ধকার একটা কক্ষে ঠেলে দিলো। হিমুর একটু ভয় করছে। ভয় জিনিসটা হিমুর কখনোই ছিলোনা কিন্তু আজ কি কারনে জানি তার ভয় হচ্ছে। তার মনে হচ্ছে আজই তার জিবনের শেষ দিন। শেষবারের মতো সকালের সূর্যটা দেখার চেস্টা করলো কিন্তু তার আগেই কেউ একজন ঠাশ করে দরজাটা লাগিয়ে দিলো।
ঘরটা মোটামুটি অন্ধকার হয়ে আছে। হিমু ভাবছে। বাঁচতে হবে, বাঁচতে হবে। এমনকি সে ভাবছে নিজে বাঁচার পাশাপাশি বাঁচাতে হবে। রূপা কে বাঁচাতে হবে। তার কেন জানি মনে হচ্ছে সে মারা গেলে রূপাও মরে যাবে। এই প্রদীপ সাহারা রূপাকে ছিড়ে খুবলে খেয়ে ফেলবে। তাই রূপাকে বাঁচানোর জন্য হিমুকে বাঁচতে হবে।
একটা চিৎকারের শব্দ শুনতে পেলো।
কেউ একজন তাকে উদ্দেশ্য করে গালি দিলো। আর সাথেই বেদম পেটানো শুরু করলো। হিমুর মনে হচ্ছে তার শরীর ফেটে রক্ত বেরুচ্ছে। হাত, মাথা, পা, শরীর কিছুই বাদ যাচ্ছে না। চার পাঁচজন মিলে একসাথে পেটানো হচ্ছে। কেউ একজন বন্দুকের বাট দিয়ে গুতা দিচ্ছে আর বলছে, স্যার গুলি করি।
গুলি করি, গুলি করি বলতে বলতে একজন ঠিকই গুলি করে দিলো।
হিমুর মনে হলো একটা গরম কিছু তার উরোর ভেতর দিয়ে প্রবেশ করলো। সাথে একটা ঠাশ করে শব্দ হলো। গুলি করার সাথে সাথে পুরো রুমটা শান্ত হয়ে গেলো। কবেরের নিস্তব্দতা পেয়ে বসলো। হিমুর মনে হচ্ছে সে হারিয়ে যাচ্ছে কাশবনের সারিতে। সে দেখতে পাচ্ছে কাজি সাহেব তার পাশে পাশে হাঁটছেন। কাজী সাহেব তাকে কোলে তোলার চেস্টা করছেন। সে কাজি সাহেবকে রূপার গল্প বলতে চাচ্ছে কিন্তু সে কিছুতে কোন শব্দ করতে পারছেনা।
৪.
হিমুর মুখে সকালের স্নিগ্ধ রোদ এসে পড়েছে। হিমু তাকানোর চেস্টা করছে। কিন্তু চোখ খুলতে পারছে না। হিমুর মনে হচ্ছে তার হাত বেডের সাথে বাঁধা। হিমু রিকল কারার চেস্টা করলো কি হয়েছে। ধীরে ধীরে সব মনে পড়ছে।
একটা পুলিশ পাহাড়া দিচ্ছে হিমুকে। যেনো বিরাট কোন খুনী দাগী আসামী। হিমু তাকলো সেই পুলিশটার দিকে। ব্যাজ আছে। নাম লেখা কৌশিক।
হিমু একটু তার দিকে তাকালো। তারপর বললো
আপনি কি জানেন ঢাকা শহরের কোথায় সোনামুখী সুই পাওয়া যায়? লোকটা একটু ঘাবড়ে গেলো মনে হচ্ছে। ঘাবরানো সুরে বলছে, আপনার কি মাথা ঠিক আছে। এতো ডলা খাওয়ার পরও কেউ এমন আবোল তাবোল কথা বলতে পারে।
হিমু এবার আরো একটু সিরিয়াস ভংগি করে বললো। এ মুহুর্তে আমার কাছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ন বিষয় হচ্ছে সোনামুখী সুই। কারন আমাকে কিছুক্ষনের মধ্যেই সোনামুখী সুইয়ের ব্যবস্থা করতে হবে। তা না হলে রূপা প্রচন্ড রাগ করবে। রূপাকে রাগানো যাবে না।
পুলিশটা অবাক হয়। হা করে থাকে কিছুক্ষন। জিজ্ঞেস করে, তা আপনি ছাড়া পেলেতো সুই কিনবেন। ছাড়া পাবেন কেমনে?
হিমু একটু বাইরের দিকে তাকায়। তারপর আবার শিশুসুলভ চোখে পুলিশটার দিকে তাকায়। বলে, আমিতো আধা ঘন্টার মধ্যে বের হয়ে যাবো। আপনার ফোনটা দেন।
- স্যার আমার একটা উপকার করবেন। আমি স্যার এইসব রাজনৈতিক মাইর দাঙ্গার মধ্যে কাজ করতে চাইনা। আমি একটা ছুটির দরখাস্ত জমা দিছি। কিন্তু আমার ছুটি মঞ্জুর হচ্ছেনা। আমি তিন মাসের ছুটি চাই। আমি সরকারের হয়ে মানুষ খুন করতে চাইনা। আমাকে বাঁচান, ভগবান আপনার মঙ্গল করবেন। আপনি যদি নিজে আধা ঘন্টার মধ্যে অসুর প্রদীপের হাত থেকে বেঁচে যেতে পারেন তাহলে আমার ছুটি মঞ্জুর আপনার জন্যআঢা সেকেন্ডের ব্যাপার স্যার।
ফোনটা এগিয়ে দিলো হিমুর কাছে।
হিমু মিস সেনের নাম্বারে কল দিলো। মিস সেন ইন্ডিয়ান হাইকমিশনে আন্ডার সেক্রেটারী টাইপ একটা চাকরী করেন। বিরাট জানাশোনা। মিস সেন রূপার সাথে লন্ডনের ইম্পেরিয়েল কলেজে পড়াশোনা করেছেন। সেই থেকে রূপার সাথে তার বন্ধুত্ব।
- হ্যালো
- হ্যালো মিস সেন, আমি হিমু বলছি।
- আরে হিমু বাবু আপনি তো আসবেন বলে আর আসলেন না। আমি এদিকে হিজ এক্সেলেন্সি পংকজ বাবুকে বলে রেখেছি। যে অদ্ভুত একটা বাঙালী বাবুর সাথে মিট করিয়ে দেবো তাকে। তাছাড়া কলকাতা থেকে আমি একসেট হলুদ পাঞ্জাবী ও হলুদ ধুতি আনিয়ে রেখেছি। ধুতিতে আপনাকে মানাবে ভালো। মনে হবে একদম বাঙালী বাবু।
- মিস সেন আমার একটা উপকার করতে হবে কিন্তু রূপাকে বলা যাবে না।
- বলুন দেখি।
- আমি এমুহুর্তে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিউ মার্কেট থানার আন্ডারে বন্দি। আমাকে প্রচুর নি্র্যাতন করে হয়েছে। আমাকে থানার ভেতরে গুলি করা হয়েছে। আমাকে ছাড়ানোর ব্যাবস্থা করতে হবে।
- এক্ষুনি দেখছি কি করা যায়।
- শুনেন আরো একটা উপকার করতে হবে। নিউ মার্কেট থানায় কৌশিক কুমার নামের একজন কন্সটেবল এর একটা ছুটির দরখাস্ত পরে আছে এটাকে একটু মঞ্জুর করিয়ে দিতে হবে।
- ঠিক আছে হিমু সাহেব। সোজা আমার বাসায় চলে আসবেন আপনার জন্য আমি লুচি আর চচ্চরি বানাচ্ছি।
ফোনটা ছেড়ে দিয়ে। কন্ষ্টেবলকে বললো। যান ব্যাগ গোছান। আপনার ছুটি অতি দ্রুততার সাথে মঞ্জুর হবে। কৌশিক বিস্ফোরিত চোখে তাকিয়ে আছে হিমুর দিকে।
৫.
ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের গেটের সামনে দাঁড়িয়ে আছে হিমু। একটা রিকশা ডাকলো।
-মামা কই যাইবেন?
- রূপাদের বাসায়। হিমু রিকশায় উঠে বসলো। রিকশা ড্রাইভার এমন ভাব করলো যে সে প্রতিদিনই হিমুকে রুমার বাসায় দিয়ে আসে।
হিমু বসে আছে রূপারদের বাসার ড্রইং রুমে। রূপা বাসায় নেই। রূপার মা দরজা খোলে হিমু কে বসতে বলেন। টিভি ছেড়ে হিমুর জন্য চা করতে চলে গেলেন। টিভিতে অদ্ভুতদর্শী এক মহিলা সমানে হাত পা ছুড়ে চিৎকার করছে আর বলছে "আমি প্রধানমন্ত্রীত্ব চাই না আমি শান্তি চাই" হিমু বিরক্ত হয়। চ্যানেল পাল্টায়। কিন্তু সব চ্যানেলে ঐ এক মহিলা চিৎকার করছে "প্রধানমন্ত্রীত্ব চাই না আমি শান্তি চাই"
রূপা বাসায় ঢুকলো। সোনা মুখি সুই কি পেয়েছো?
হিমু হাত বাড়িয়ে এক ডজন সোনামুখী সুই দিলো।
- আমি জানতাম তুমি পারবে এটা কালেক্ট করে দিতে।
- না আমি পারিনি। এটার সন্ধান দিয়েছেন পুলিশ কনস্টেবল কৌশিক। তিনি এখন তার স্ত্রী ও একমাত্র কন্যা সন্তান নিয়ে তিন মাসের ছুটিতে যাচ্ছেন বরিশালের লঞ্চে করে।
হিমু কিছুক্ষন চুপ থাকে। তারপর হঠাৎ জিজ্ঞেস করে। আচ্ছা রূপা বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী কে?
- কেন? ঘসেটি বেগম।
- ও আচ্ছা। উনি কেনো বার বার বলছেন "প্রধানমন্ত্রীত্ব চাই না আমি শান্তি চাই"
- উনি একজন অন্য রকম মানুষ। উনি যা বলেন আসলে তার ঠিক উল্টাটা বুঝে নিতে হয়। যেহেতু উনি বলেছেন "প্রধানমন্ত্রীত্ব চাই না আমি শান্তি চাই" তাহলে ধরে নিতে হবে উনি বলেছেন " আমি প্রধানমন্ত্রীত্ব চাই,শান্তি চাই না" তাই তিনি সিংহাসনও ছাড়ছেন না এজন্যই দেশের মধ্যে অশান্তি সৃষ্টি হয়েছে।
রূপা খেয়াল করলো হিমুর পায়ে ব্যান্ডেজ? জিজ্ঞেস করলো কি হয়েছে/
হিমু মৃদু হাসলো। বললো ও কিছু না ও হচ্ছে আমাদের প্রধানমন্ত্রীর শান্তির মডেল।
হিমু বেড়িয়ে পড়লো। কোথায় যাবে বুঝতে পাড়ছে না। তার মনে হলো ঢাকা শহরটা একটু ঘুরে দেখবে। রূপাকে সাথে নিতে পারলে ভালো হতো। কিন্তু রূপাকে সাথে নিলো না। শান্তি নগর হয়ে বিজয় নগরের দিকে যাবে। এমন সময় দেখলো একটা বিরাট মিছিল। মিছিলটাকে ঠিক রাজনৈতিক মিছিল মনে হলো না। কেমন জানি ধর্মীয় মিছিল মনে হচ্ছে। হিমু কোনদিন এমন মিছিল দেখে নি। এরা ইসলাম ধর্মের প্রবর্বতক মুহাম্মদের সম্মান হানি যারা করছে তাদের শাস্তির জন্য মিছিল করছে। শত শত মেঘবালক দেখতে পেলো এই মিছিলে। হাজার হাজার কচি কচি মুখ দেখতে পেলো। এই মেঘবালক আর হিমুর মধ্যে মিল আছে। ওরাও সবাই হিমুর মতো পাঞ্জাবী পরেছে। হিমু হলুদ পাঞ্জাবী আর এই মেঘ বালকের দল পড়েছে সাদা পাঞ্জাবী। মেঘবালকের দল থেকে হাজার কন্ঠে আকাশ বাতাস প্রকম্পিত করছে, আল্লাহু আকবার, আল্লাহ মহান। হিমুর ভেতরে একটা মোচর দিলো। হিমুর চেতনায় নাড়া দিচ্ছে। হিমু দেখলো হাজার হাজার মানুষের দল মিছিলে মিছিলে রাজপথ কাঁপিয়ে চলে যাচ্ছে। হিমুর মনে হলো সে কাজী সাহেব কে দেখতে পাচ্ছে একদম সামনে। মিছিলের সবার সামনে। হিমু মিশে গেলো মিছিলের সাথে। হিমু চিতকার করছে, কাজি সাহেবকে সে এখন তার পাশে দেখতে পাচ্ছে।
হিমু চিৎকার করে বলছে
বল বীর
উন্নত মম শীর
হঠাৎ প্রচন্ড গোলাগুলী শুরু হয়ে গেলো। নিরীহ মেঘ বালকেদের উপর হিংস্র হায়েনারা ঝাঁপিয়ে পরলো বোধ হয়। নির্বিচারে গুলি হচ্ছে। সাদা সাদা পাঞ্জাবী লাল রক্তে ভেসে যাচ্ছে। মাটিতে লুটিয়ে পড়ছে মেঘ বালকের দল। আর্ত চিৎকারে বাতাস ভারি হচ্ছে। দ্বিতীবারের মতো হিমুর মনে হচ্ছে সে নরকের মধ্যে এসে পড়েছে। রক্তের ছোপ ছোপ দাগ এই শহরের দেয়ালে দেয়ালে। দুরে ১৬/১৭ বছর বয়সী একটি ছেলে সংগে আসা বন্ধুর লাশ কোলে নেয়ার জন্য আপ্রান চেস্টা করছে। হিমুর মনে হলো পৃথিবীতে একসাথে মিছিলে এসে লাশ হয়ে যাওয়া বন্ধুকে কোলে তোলার মতো ভারী বস্তু সম্ভবত আর নেই। কিছু মানুষ মাটিতে লুটিয়ে পরে কাঁতরাচ্ছে। হিমুর মন হলো সেদিন ফজরের নামাজে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় জামে মসজিদে ওরা সবাই ছিলো তার ডানে কিংবা বামে। কাজি সাহেবকে খুঁজছে হিমু। ওরা কি কাজি সাহেবকেও মেরে ফেলেছে। হিমুর চোয়াল শক্ত হয়। হিমুর অনুভূতি পরিবর্তিত হয়। মনে মনে বলছে "কাজী সাহেব, আপনার জন্য একটা দ্রোহের গল্প তৈরি হচ্ছে"
৬.
টাক টাক।
হিমু মিরপুরের একটা বাসার দরজায় কড়া নাড়ছে। হিমু কখনো কলিং বেল চাপে না। এটা হিমুর অভ্যাস। হিমুদের অভ্যাস। হিমুরা ওল্ড ফ্যাশনড।
আবারো কড়া নাড়লো।
টাক টাক।
একটা কাজের মেয়ে দরজা খুলে দিলো। ভেতর থেকে আওয়াজ হলো। ভেতরে আসতে দে ভাইজান কে। এটা ঢাকা শহরের শীর্ষ সন্ত্রাসী শাহাদাতের গোপন বাসা। শাহাদাত হিমুকে ভাইজান বলে ডাকে। শাহাদাতের সংগীরা অবাক হয়। ২৫/২৬ বছরের পোলারে বস ভাইজান ডাইকা সম্মান দেয় নিশ্চয় ঘাপলা আছে।
- ভাইজান বলেন কেন এসেছেন। আপনার আসার কথা নয়। তারপরেও যখন আপনি এসেছেন নিশ্চয় কোন গুরুতর কাজে এসেছেন। বলে শাহাদাত সোফার কোনায় থাকা কালশনিকব রাইফেলটা হাতে নিয়ে রুমাল দিয়ে মুছতে থাকে। শাহাদাতের এই কাজ দেখলে মনে হবে কোন স্বর্নকার নিমগ্নে আছেন সামনের কোন বিয়ে উৎসবের জন্য অলংকার তৈরিতে।
হিমু অনেক্ষন চুপ করে ছিলো। সেও খুব খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে অবলোকন করছে শাহাদাত কিভাবে আপন মনে রাইফেলটির যত্ন নিচ্ছে। শেষে শাহাদাত যখন ফাইনাল টাচ দিয়ে রাইফেলটা সামনের তাক করে ফাঁকা শুট করলো। তখন টাশ করে একটা আওয়াজ হলো।
হিমু এই বার মুখ খুলে বললো। আপনার হাতের রাইফেলটি আমাকে দিতে হবে এবং এক্ষুনি, সময় খুবই কম। হিমুর মাঝে অস্থিরতা। শাহাদাত চমকে উঠলো। কিছুক্ষন হা করে তাকিয়ে থাকলো। তারপর রাইফেলটি হিমুর হাতে দিলো। এবার হিমু কিছু বুলেট চাইলো। শাহাদাত একটা ব্যাকপ্যাক ভর্তি বুলেট দিলো। শাহাদাত খুব আপ্রান চেস্টা করছে হিমুকে প্রশ্ন করতে কিন্তু পারছেনা। হিমু হাত বাড়িয়ে শাহাদাতকে বললো, বিদায়।
সে এখনো কোন শব্দ করতে পারছেনা। তাকিয়ে তাকিয়ে হিমুর চলে যাওয়া দেখছে।
৭.
হিমু নিউ মার্কেট থানার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। হিমুর হাতে কালাশনিকভ। ওসি প্রদীপ সাহার লাশের উপর নির্যাতিত নিপিড়িত বন্দীরা থুথু দিয়ে বের হয়ে আসছে। হিমু হাঁটছে। হিমু দ্রোহের গল্প তৈরি করছে। হিমুর সামনে কাজী সাহেব। কাজী সাহেব তাকে পথ দেখিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন। হিমু কারওয়ান বাজার সার্ক ফোয়ারার কাছে যেয়ে একটু থামলো।
বাবার ১৩৯৩তম উপদেশ মনে পড়ছে তার।
" সাহসী মানুষরাই কেবল শান্তি প্রতিষ্ঠা করতে পারে। অতএব সাহসী হও, শান্তি আসবেই"
হিমু পিছনে তাকায়। দেখে লক্ষ তরুনের জোয়ার তার পেছনে। সব যেনো মেঘবলাকের দল। যারা তার সাথে ঐদিন ফজরের নামাজে ছিলো। যারা মিছিলে ছিলো। সবাই সাদা পাঞ্জাবীর বদলে আজ হলুদ পাঞ্জাবী পড়েছে। হিমুর চোখ ছল ছল করছে। কান্না আসবে। বৃষ্টি হবে। একবার আকাশের দিকে তাকালো। আকাশে মেঘ জমা হচ্ছে। মেঘ কুন্ডুলী পাকাচ্ছে। আজ বৃষ্টি হবে। সেই বৃষ্টিতে ধুয়ে মুছে সাফ হবে এই শহরের যাবতীয় পাপ পঙ্কিলতা। কান্না বৃষ্টিতে ভেসে যাবে সব গনহত্যার সাম্পান...।
হিমু কালাশনিকব কাঁধে তুলে সামনে পা বাড়ায়।
উদ্দেশ্য বিজয় স্মরনীর পরে ঘসেটি বেগমের রাজমহল...................
[[ডিসক্লেইমার: এই গল্পের কোন চরিত্রের সাথে বাস্তবের কোন চরিত্রের মিল নেই।]]
[বাংলা সাহিত্যের বরপুত্র হুমায়ুন আহমেদের জন্মদিনে উপপাদ্যের একটি অ-হুমায়ুনীয় হিমুর গল্প। স্যার আপনি নেই তাই মাঝে মাঝে কবিতার বইটা শুন্য মনে হয়।]
১৭ ই নভেম্বর, ২০১৩ সকাল ১০:৫১
উপপাদ্য বলেছেন: ধন্যবাদ সবুজ সাথী ভাই। অনেক ধন্যবাদ।
২| ১৬ ই নভেম্বর, ২০১৩ দুপুর ২:২৪
ভাইটামিন বদি বলেছেন: ওহ....চমতকার!
....কিন্তু আমাদের হিমু'রা সাহসী হয় না....এরা হয় কাব্যিক!
১৭ ই নভেম্বর, ২০১৩ রাত ৯:৩৬
উপপাদ্য বলেছেন: ধন্যবাদ।
একটা সাহসী হিমুর গল্প লেখার চেষ্টা করেছিলাম এই আরকি।
আমাদের হিমুরা সব সাহসী হোক।
৩| ১৬ ই নভেম্বর, ২০১৩ বিকাল ৩:১০
মুনেম আহমেদ বলেছেন: অনেক ভালো লেগেছে বিদ্রোহী হিমুকে।
১৮ ই নভেম্বর, ২০১৩ রাত ১২:০৩
উপপাদ্য বলেছেন: আপনাকে অনেক ধন্যবাদ, মুনেম ভাই
৪| ০৮ ই ডিসেম্বর, ২০১৩ রাত ১২:৪৯
একজন ঘূণপোকা বলেছেন: রাজনৈতিক বক্তব্যটা বাদ দিলেও এটা একটা অনন্য গল্প।
আর গল্পের মুল ভাব তো অনন্য।
অনেক ভাল লাগে।
এজন্য ই আপনার ব্লগে আসি বার বার।
হিটের দিকে চেয়ে থাকবেন না, প্লিজ লেখে যাবেন।
১৪ ই ডিসেম্বর, ২০১৩ দুপুর ১২:২২
উপপাদ্য বলেছেন: পোকা ভাই, অসংখ্য ধন্যবাদ। আপনাদের এমন ফিডব্যাক পেলে খুব ভালো লাগে। বিনম্র শ্রদ্ধা।
৫| ০৮ ই জানুয়ারি, ২০১৪ সকাল ৭:৩৩
খেয়া ঘাট বলেছেন: আপনিতো ভাই একজন গুনী লেখক। অনেক শ্রদ্ধা রইলো।
০৮ ই জানুয়ারি, ২০১৪ দুপুর ১২:০৬
উপপাদ্য বলেছেন: খেয়া ঘাট ভাই, আপনার এই প্রসংশা মাথায় তুলে রাখলাম, যদিও আপনি সহ সামুর অন্যান্য অনেক ব্লগারের লেখার মানদন্ড বিচারে আমি একজন অতি নগন্য লেখক।
আপনার মুখে ফুল চন্দন পড়ুক,
আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ।
৬| ২৩ শে এপ্রিল, ২০১৪ বিকাল ৪:৩৩
দেশান্তর বলেছেন: কি আর লিখব, অসাধারন। ইতিপূর্বে মানুষকে এভাবে হাসাতে আর কাদাতে পারতেন শুধু একজনই, আর এখন আপনি। বরং আপনার দ্রোহের হিমু আর বেশি রক্ত মাংসের, সময়ের দাবিতে আর বেশি যৌক্তিক।
০৫ ই সেপ্টেম্বর, ২০১৪ সন্ধ্যা ৬:৩৫
উপপাদ্য বলেছেন: আপনার এই প্রশংসাবাক্য শ্রদ্ধাভরে মাথয় তুলে রাখলাম ভাই।
দ্রোহের হিমেকেই বেশী দরকার এখন সমাজটা বদলাতে।
ভালো থাকুন। অনেক ধন্যবাদ
©somewhere in net ltd.
১|
১৬ ই নভেম্বর, ২০১৩ দুপুর ২:০৮
সবুজ সাথী বলেছেন: চমৎকার লিখেছেন ভাই। অশেষ ধন্যবাদ।