নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

জোছনায় ভুবনের ছবি

উড়ুউড়ু

আমি কখনই লটারী করি না কিন্তু মনে প্রানে বিশ্বাস করি যে আমার জীবনটাই একটা বড় লটারী।

উড়ুউড়ু › বিস্তারিত পোস্টঃ

শ্রদ্ধাঞ্জলি

০৭ ই অক্টোবর, ২০১৩ রাত ৯:২১

শ্রদ্ধেয় হেড স্যার,



এমন একদিনে লিখতে বসলাম যেদিন অতি স্বাভাবিক একটি প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করা যায় না, স্যার আপনি কেমন আছেন? বাংলাদেশ ছেড়ে এতদুরে থেকে অন্তত আজকের দিনটি নিজেকে অত্যন্ত সৌভাগ্যবান মনে হচ্ছে। আজ একজন মানুষকে তার নিজের যত্নে গড়া পৃথিবী থেকে বিদায়ের আয়জন চলছে। আমি সত্যিই জানি না স্যার এই স্কুলটির বাইরে আপনার অন্য কোন পৃথিবী ছিল কিনা! সেই পৃথিবী ছেড়ে আপনি চলে যাচ্ছেন এমন অমানবিক একটি দৃশ্য আমাকে দেখতে হচ্ছে না। আজ আমি সত্যি খুব সৌভাগ্যবান!



আপনাকে সারা জীবন যেমন দেখে এসেছি- ক্লাস পালিয়ে বাথরুমে লুকানো ছাত্রদের হৃদপিন্ডের সঞ্চালনে আপনার নাম বাজত, হোম ওয়ার্ক না করে আসা ছাত্রটির আতংকের নাম ছিল রমজান স্যার। এলাকার সবেচেয়ে ডানপিটে ছেলেটিও আপনাকে দেখলে মাথা নিচু করে নিঃশব্দে চলে যেত। প্রচন্ড ব্যক্তিত্ব আর দৃঢ় মূর্তি, সেই বজ্র কন্ঠস্বর আর তীক্ষ্ণ চোখজোড়া। আমি অত্যন্ত সৌভাগ্যবান যে আজ সেই একই স্কুল প্রাঙ্গনে মলিন বদনে চেয়ে থাকা হেড স্যারকে আমার দেখতে হচ্ছে না!



তবে অন্য আরেক রমজান স্যারকে আমি চিনতাম। অসংখ্য স্মৃতি থেকে দু’একটি না বললেই নয়। ক্লাস টেনের প্রি-টেস্ট পরীক্ষা ২০০৩ সাল। বদরগঞ্জ উপজেলার সকল স্কুলে একযোগে পরীক্ষা হবে। কয়েকটি পরীক্ষা হবার পর দেখা গেল প্রশ্ন ফাসের মহা উৎসব। আমরা বেকে বসলাম। আমরা এই ফাস হওয়া প্রশ্নে পরীক্ষা দেব না। আমাদের সাথে যোগ দিল অন্য সব ক্লাস, স্কুলের সব ক্লাসে লাগানো হল তালা, চাবি কার কাছে কেউ জানে না! স্যারের উপর তখন প্রচন্ড চাপ-উপজেলা থেকে টিএনও, সুগার মিলের এমডি। স্যার সেইদিন আমাকে ডেকেছিল। আমি আজও ভুলতে পারি না, স্যারকে কি যে প্রচন্ড অসহায় দেখাচ্ছিল। ফাস হওয়া কোন প্রশ্নে আমাদেরকে পরীক্ষা দেয়ার অনুরোধ করতে আপনার নীতি-আদর্শ যে চরমভাবে লুন্ঠিত হচ্ছিল আমি খুব স্পষ্ট বুঝতে পারছিলাম। শুধুমাত্র প্রধান শিক্ষক হবার কারনে এরকম আরও কত চাপ যে স্যারকে সহ্য করতে হয়েচে! তবুও এই স্কুলটাকে আকড়ে ধরে ছিলেন। দীর্ঘ তিরিশ বছর আকড়ে ধরে থাকা সহজ কথা নয়। তার জন্য দায়িত্ব, পারিশ্রমিকের বাইরেও একটি শক্ত বন্ধন লাগে। সেই বন্ধন একটি ‘বিদায় অনুষ্ঠানে’ ছেড়া যায় না!



হঠাৎ একদিন অন্য স্যারের ক্লাস চলছে আয়া এসে বলল, হেড স্যার আমাকে তাঁর অফিসে ডাকেন। আমার তো কলিজা শুকিয়ে গেছে। ভয়ে ভয়ে স্যারের অফিসে গেলাম। স্যার একা অফিসে ছিলেন। আমাকে দেখে লাইব্রেরীর একটা আলমেরী ছিল সেটা খুললেন। আমাকে ডেকে বললেন, ''এই আলমেরির ভিতর যত বই আছে কোনটা কোনটা কাজে লাগবে নিয়ে যা। এইবার আমাদের অন্তত একটা জিপিএ-৫ চাই''। আমি স্যারের দিকে অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে আছি। স্যার ভাল ভাবেই জানত খুব বেশি বই কেনা আমার সামর্থ্যের বাইরে। সেই লাইব্রেরীর বুক শেলফে হয়তো আমার কাজে লাগে এমন বই খুব বেশি ছিল না। কিন্তু যে অগাধ বিশ্বাস-নির্ভরতায় স্যার আমাকে একা গোপনে ডেকে পাঠিয়েছেন তা ভেবে আজও আমি গর্বিত। যে আস্থার হাত আপনি আমার মাথার উপর রেখেছিলেন তার স্পর্শ আমি আজও অনুভব করি।



আমাদের ইংরেজী দ্বিতীয় পত্র নিতেন আপনি।আমরা খুব ছোট তখন থেকেই দেখতাম আপনার ছাত্র-ছাত্রীদের ভীড়। আপনার মত একজন ইংরেজীর শিক্ষক আমরা পেয়েছিলাম যার শ্রেষ্ঠত্ব একবাক্যে সবাই স্বীকার করে নেয়। ২০০৪ সালের S.S.C থেকে নতুন সিলেবাস কমিউনিকেটিভ ইংলিশ। সেই সময় অনেক শিক্ষকই বুঝে উঠতে পারছে না কিভাবে শুরু করবে। কিন্ত আমাদের কোন সমস্যা হয় নি। আপনার ক্লাসে আমরা সবচেয়ে ফাঁকি দিয়েছি তাতে কোন সন্দেহ নেই্। ফাঁকি দেয়ার পরও যা শিখেছি তাই বা কম কি! আজ যখন আমার কোন কলিগ আমার দ্রুত ইংলিশ বুঝতে না পেরে আবার রিপিট করতে বলে অথবা একটু ধীরে বলার অনুরোধ করে তখন আপনার সেই ডায়ালগ ক্লাসের কথা মনে পড়ে। সপ্তাহে একদিন ডায়ালগ ক্লাস হত। আপনি ক্লাসে ঢুকেই আমাকে ডেকে সামনে নিয়ে আসতেন। বিভিন্ন বিষয়ের উপরে ডায়ালগ হত, ১০ বছর আগে যে ভিত গড়া হয়েছে তা কখনই টলে নি। এমন অসংখ্য ভিত যে কারিগর গড়ে দিয়েছে, তাঁর আজ অবসর মেনে নেয়া যায় না।



স্কুল হয়তো তার নিয়মেই চলবে। কিন্তু হেড স্যার নামক শব্দটি শুনলেই কেন জানি আমাদের মস্তিষ্কে শুধু আপনার ছবিই ভাসে। সেই খয়েরি-সাদা টাইয়ের সাথে গোল্ডেন ক্লিপ। স্যার আপনার সেই চিরায়ত ছবিটি নিয়ে আপনার অসংখ্য ছাত্র আপনার শুভ কামনায় থাকবে। তাদের মস্তিষ্কে-মননে-চিন্তুা-চেতনায় আপনি আজীবন হেডস্যার হয়েই থাকবেন। সারা জীবন আমাদের অসংখ্য বেয়াদবী সহ্য করেছেন। আমরা দুঃখিত স্যার। আমাদের শেষ বেয়াদবীটাও ক্ষমা করে দিয়েন,আপনি চলে যেতে চাইছেন তা কিন্তু হবে না। আমরা আপনাকে জোর করে হেডস্যার করে রাখলাম। আমাদের প্রত্যেকের মনের ভিতর একান্ত যে স্কুলটি আছে, সেই স্কুলের প্রধান শিক্ষকের পদ থেকে আপনার কোন অবসর নেই্।



ইতি

আপনার স্নেহধন্য

মন্তব্য ০ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.