![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
এই বাড়িতে বিকেলেই আঁধার নামে। চারিদিক কেবলি শব্দহীন। শোঁ শোঁ কিছু শব্দ। বাগানের নারকেল পাতা থেকে ভেসে আসছে। এখানে আমি থাকতে পারবো না। ঝনঝন করে কাঁচা থালার শব্দটা কানে বেজে উঠলো। কেউ কথা বলছে না। বলবে নাতো। মুরোদ আছে নাকি? মরদের মুরোদ থাকে। কতো বলি, এই কবুতরের গুয়ে ভরা আঁন্ধা পুরানো বাড়ি। ঘরের পরে ঘর। দোতালায় ছাদে যেতে গেলে তক্ষক তেড়ে আসে। ওদিকে বাড়ির বাগানে গুঁইসাপ লকলকায়। কি লাভ? এখানে কি লাভে মানুষ থাকে? এই ভরা ধরা পচা জীবনে কোথায় কি আছে? একটাও শব্দ নেই। মরলো নাকি লোকটা ওঘরে। একটা উঁকি টের পেয়ে ওঠে আসে অজিত মাষ্টার। হালকা পাতলা গড়ন। পরণে সাদা লুঙ্গি। হাতাওয়ালা গেঞ্জিটাও একটু ময়লা। ধুয়ে দিতে ভুল গেছে আজো। চোখে পুরু লেনসের চশমা। হাতে একখানা মোটা বই। আয়ুবের্দীয় চিকিৎসা বিজ্ঞান। বাইরে এসে চোখে পড়লো, একটা মোড়ায় বসে পায়ে রক্ত নিয়ে বসে আসে তার স্ত্রী। এই অল্প বয়সেই যেনো আঁধারে ভরা দুটো চোখ। মাথার পাশের শিরা ধরে নিচু মুখে যেনো ভাঙ্গা মেঝে কামড়াচ্ছে। কি হলো এমন? অসুখ নেই তো? শুনেই মাইগ্রেনের ব্যথাটা চাড়া দিয়ে উঠলো। হঠাৎই উঠলো। এভাবে কি চলে? কিভাবে চলবে? একটা বাচ্চা ছিলো তাদের। বছর দু’ আগে। অজানা এক জ্বরে মরে গেছে। অজিত বাচ্চাটা পেয়ে বেশ একটু নড়েচড়ে বসেছিলো। বাগান পেরিয়ে কোলে করে রাস্তার মোড়ে নিয়ে যেতো। সেখান থেকে সামান্য হাঁটলেই চা এর একটা দোকান। সেই বাবার আমলের। রাসু কাকা আর তার বুড়ি বৌটা বসে। কখনো দু’ জনেই থাকে। কখনো একাকী থাকে। কাকা গঞ্জে যায়। টোস্ট আর কনফেকশনারী বিস্কিট পাওয়া যায়। কলা পাওয়া যায় ভালো। সকালে কিছু লুচি ভাজে কাকীমা। গরুর দুধের চা । এখানেই অজিতের ক্ষনেকের আড্ডা। বাচ্চা কোলে বসতো। কাকীও কোলে নিতো। আহা রে জমিনদারের পুত আমার। কাকী বলতো। বাগানের একটু কোণ বেচলেই শহরে বাড়ি কিনতে পারবে বাবা অজিত। মাস্টারি করো। বয়েস তো এখনো অল্প রে বাবা। এই গাঁয়ে আঁধার পচা জীবনে মা মাসি কেউ নেই তোমার। কি লাভ এখানে থেকে। বউটা কাঁদে একা। টাউনের গোয়াল পট্টির মেয়ে। মামাবাড়ি হলেও তো টাউনের মেয়ে। শুনেছি , প্রতিটা সিনেমা দেখা তার সখ ছিলো। দেখতে কালো হলেও টাউনে তার চোখের টান দেখে বিয়ে করা লোকের অভাব ছিলো না। এখানে কি আছে বলো? বাচ্চা হয়েছে। এখন টাউনে একটা বাড়ি কিনে চলে যাও। পরে এগুলো বেচে দিও। বাচ্চার ভবিষ্যত কি এখানে হবে রে বাবা? এসব শোনে অজিত মাষ্টার। গাঁ এর সরকারী প্রাইমারী স্কুলের হেড মাষ্টার সে। ওদিকে শহরে কমুনিষ্টদের সাথেও তার একটু আধটু উঠাবসা। এই পচা বাসি আর আচারের চটকা জীবন তো জীবন নয়। সকলের একসাথে বেঁচে থাকার নাম জীবন। এই যে গাঁ। এখানে লেখাপড়া কিছু শিখে রাসু কাকীর দুটো ছেলেই রাজশাহী শহরে মিউনিসিপালিটির কেরাণী হলো। ভালো বেতনই তো পায়। শহরে খুপরি ঘর ভাড়া করে থাকে। তবু তো নিজের পায়ে দাঁড়ালো। লেখাপড়া সার্বজনীন হলেই জ্ঞান বুদ্ধি আসবে। ভবিষ্যত প্রজন্ম তৈরি হবে। ছেলেদের সাথে মেয়েরাও পড়ছে। গত বছর তো তাদের স্কুলের দুটি ছেলে , দুটি মেয়ে বৃত্তি পেয়েছে। এখানে একটা হোমিওপ্যাথি ডাক্তার আছে। একজন গ্রাম্য চিকিৎসক অমর কাকা আছেন। তাদের দেয়া ঔষধে তো রোগও সারছে বেশ। তো এখানে অসুবিধে কোথায় কাকী? রাসু কাকী কথাটা শুনে চুপ থাকলো একটু। পরে বললো, আমাদের কথা ভাবলে তো শুধু হবে নারে বাবা। বৌটা একা। ঐ অবোধের মা টা তোমাকে আর কতোকাল টানবে? সেও তো চোখে দ্যাখে না। এই বাচ্চার জন্য তো একটা বারো চৌদ্দ বছরের মেয়ে রাখতে হবে। কাপড় ধোয়া, এতোবড় বাড়ি ঝাড় দেয়া আরো কতো কাজ। বাবার রেখে যাওয়া এতোবড় বাড়ি আর বাগানটা কার জন্যে শুনি? এখন তো এটা তোমার ছেলের জন্যে। যাও বাবা , বউয়ের খায়েস। টাউনে গিয়ে বাসা ভাড়া করে বদলী নাও। আমরা তো নেই রে বাবা। নেহাত ইণ্ডিয়াতে যেতে পারিনি বলেই এইখানে থাকা। নইলে আর কি থাকতাম। এইসব বেচে খুঁচে তুমিও যাও গে কোলকাতা। অঢেল টাকা পাবে বেচে। রাসু কাকী বাচ্চা কোলে নিয়ে সন্ধ্যেবেলা বাগান দিয়ে ফিরছিলো। সেই পুরানো বটগাছ থেকে তক্ষকটা ক্যাঁ ক্যাঁ করে ডেকে উঠছিলো। ফেরার পথে রাসু কাকী বাচ্চার বুকে একটু থু থু ছিটিয়ে অমঙ্গল দূরও করেছিলো। তারপরও আঁধার নামার মুখে ছেলে নিয়ে বাড়ি ঢুকতেই শোনে , এটা কোন কাজ হলো? এতোবড় বাগান পেরিয়ে সন্ধেবেলা বাচ্চা নিয়ে কেউ বাড়ি ফেরে। ভগবান। ভগবান। গাঁইয়াকে বোঝাবে কে এসব? পরের দিন জ্বর এলো ছেলে অসিতের। সে জ্বর দিনে থাকে না দিনে অসিত সারা বাড়ি খেলে বেড়ায়। বুড়িটা সামলাতে চেষ্টা করে। কয়েকটি কিশোরীকে বলা আছে। তারা এসে কাজ ফেলে বাচ্চা নিয়েই পড়ে থাকে । বাড়ি পরিস্কার হয়। বাগানে গোটা চল্লিশ নারকেল গাছ ছাড়াও মেহেগুনি শাল আর পাকুর মিলিয়ে তো গোটা তিরিশ গাছ আছে। বেশ কিছু বুড়ো আম গাছও আছে। পরিচর্যা করার লোকটা এখন আর পারে না। ডাব বেচেই তো বাগান পরিস্কারের টাকা পাওয়া যাবে। কিন্তু অজিতের বাপ নাকি গাঁয়ের লোককে ডাব বিলিয়ে গেছে। অজিতও তাই করে। তো টাকা আসবে কোথা থেকে? অজিতের বাবার সম্পদ এটা নয়। দাদুর সম্পদ। তার দাদুর ব্যবসা ছিলো। দাদনের টাকায় পোদ্দার বাড়িতে লোক গমগম করতো। অজিতের বাবা জেলা কমুনিষ্ট পার্টির একজন ছোটখাটো নেতাও ছিলো। দাদনের ব্যাবসা না করে অজিতকে আদর্শ ছেলে বানিয়ে স্কুলে চাকুরী দিয়ে স্বর্গে গেছেন। অজিত এখন বাপের জায়গায় বসেছে। ফলে পড়তি দিকেই যাচ্ছে সব। তিন বছর আগে ব্যবসার বদলে বাঁধা কয়েকটা টাকা দিয়ে বাড়ি মেরামত, পরিষ্কার, ভাঙ্গা বিশাল প্রাচীর মেরামত, মালী বা অন্যান্য সব খরচ একসাথে হয় না। এদিকে অজানা অনেক কারণেই বাচ্চার মায়ের বুকে দুধ আসে না। ফলে কৌটার দুধ লাগে। কোথায় পাওয়া যাবে এসব? রাসু কাকীর কথা মতো বাগানের একটি কোনার মাত্র আটকাঠা জমি বেচে দিলেই তাদের জীবন পার হয়ে যাবে। এখন শহর বাড়ছে। এদিকে জমির দালাল ঘোরাঘুরি করছে। অনেক টাকার অফার। পশ্চিম কোনের আটকাঠা জমিটা চল্লিশ লাখ। পূবে তিরিশ লাখ। কম তো নয়। ব্যাঙ্কে রেখে খাবি যে সুদ পাবি, তাতেই সব হবে। অজিতের ঐখানেই আপত্তি। সে সুদ আর দাদনের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করছে। সমবন্টনের রাজনীতিতে বিশ্বাস করে সে। রাসু কাকী বলে, হ্যাঁরে অজিত, তোর কাকা কইছে, ঐটা সুদ না, ঐটা লাভের অংশ। এসলামী ব্যাংকে টাকা থ গে। ফের গায়ে ফোস্কা পড়ে। তার মানে তাকে জমিটা বেচতেই হবে। সে বিশ্বাস করে, একবার টাকার স্বাদ পেলে তার বর্তমানেই গোটা বারো বিঘার বাউন্ডারী দালালে ভেজিয়ে নেবে। লোভটা বড়ই খারাপ। এই ঘরটুকু থাকলেই চাকুরী বাদে দুটো টিউশনিতেই তার ছেলেকে সে দুধেভাতে মানুষ করতে পারতো। সেটাই তাঁর জন্যে উত্তম পন্থা ছিলো। সে পন্থাতেই সে গোটা বাউন্ডারীতে আগাছা জন্মিয়ে টিউশনি নিয়ে তিনটে ঘর পরিষ্কার করে বাড়িতে থাকতো। কিন্তু ছেলের জ্বরেই বিপত্তি হলো তার। দিনে ডাক্তার জ্বর পায় না। রাতে জ্বর কেঁপে আসে। ঝাড়ফোক, হোমিওপ্যাথিতে কুড়িদিন পার করার পর অসিত খাবার বন্ধ করে দিতে লাগলো। এখন মাথাও তোলে না। একদিন ঘোড়াগাড়ি করে বাচ্চাকে তোয়ালেতে জড়িয়ে হাসপাতালে নিলো সে । সাথে বৌ। সাতদিন আর সাতরাতে যমে ডাক্তারে টানাটানি করার পর অসিতটা চলে গেলো। বৌ শীলা চুপ করে দেখলো সব। প্রথমেই আনলে সাতদিনে এই এন্টিবায়োটিকে বাচ্চা ভালো হয়ে যেতো। টাইফয়েড়ের চুড়ান্ত অবস্থায় আনলেন। আরে মাষ্টার, এর চে আয়রবেদীয় চিকিৎসাঅনেক ভালো ছিলো। সবই শুনতে হয়েছিলো তাকে। শীলা একা বাড়িতে ফিরতে চায়নি আর। তার মামারা তাকে জোর করেই ঐ ঘোড়াগাড়িতে তুলে দিলো। বৌটা তারপর থেকেই একা বকে যায়, এ বাড়িতেই মানুষ নামের কেউ নাই? কবুতুর, সাপ, তক্ষক, ঘুঘু কুকুর বিড়াল আর কুপির আলোতে বাঁচা যায় আর? পা দিয়ে গল কল করে রক্ত পড়ছে। হাতে অয়োর্বেদীয় বইটার কোথায় সেই প্যারাটা আছে যেখানে অসিতকে বাঁচানোর ঔষধটা তৈরি করা যেতো। কালচিরে কপুর কাতের জন্যে গুল্মলতা নিমপাতা, বিটলবন , গাছের গুড়ো, চন্দন, আরো কতো কি যে আছে। মেনথলের সাথে কি দিলে হতো? রক্ত ঝরেই যাচ্ছে, শীলা তাকিয়ে তাকিয়ে মাথা চেপে দেখছে। ধীরে ধীরে মাথাটা নেমে আসছে। খবর পেয়ে রাসু কাকী এসে বললো, ওরে অজিত, একে যে বাস্তসাপে কেটেছে রে। আর ঐখানে সে ফের কোপ বসিয়েছে। এইভাবে শীলা চলে গেলো ।
অজিত মনে মনে বললো, একদিন গোটা মানবজাতিকেই সিজোফ্রেনিয়া রোগে ধরবে।
মড়ক শুরু হয়ে গেলো ।
©somewhere in net ltd.