![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
আদি বাংলার ইতিহাস
(প্রাগৈতিহাসিক যুগ থেকে ১২০৫ খ্রিষ্টাব্দ) পর্ব ২২
তবে এ পরিবর্তন হতে ১০/১২ শত বছরেরও অধিক কাল প্রয়োজন হয়েছিল। বাংলার পলিময় সমতলভূমির অধিকাংশ অঞ্চল বছরে প্রায় ৬ মাস জলমগ্ন থাকত। সম্রাট আকবরের সভাসদ আবুল ফজলের মতে- ‘এই প্রদেশে গ্রীষ্মের গরম ছিল মৃদু এবং শীতকাল ছিল ক্ষণস্থায়ী। মে মাস থেকে বৃষ্টি শুরু হয়ে দীর্ঘ ছয় মাস সময় ধরে অব্যাহত থাকতো, সে সময় ভূমি থাকতো জলপ্লাবিত। ৩২ আজও এই আবহাওয়া বাংলাদেশের সাধারণ বৈশিষ্ট্য এবং বিশেষ করে উত্তর ও পূর্বাঞ্চলের নিন্মভূমিতে আবহাওয়া এভাবে বিরাজ করে।
বাংলার দক্ষিণাঞ্চল জোয়ারভাটার দেশ। দিন-রাত ২৪ ঘণ্টায় দুইবার জোয়ার-ভাটা হয়। ফলে বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলকে ভাটি অঞ্চল বলা হয়।
সাধারণত গ্রীষ্মকালের প্রারম্ভে দেশে আবহাওয়া কিছুটা অনিশ্চিত থাকে।। এ সময়ে মাঝে মধ্যেই ঝড় হয়ে থাকে; তাকে কালবৈশাখী বলে। ঝড়ের যথেষ্ট গতি থাকলেও প্রচণ্ডতা তুলনামূলক কম। এদেশে প্রচণ্ড ঝড়-বৃষ্টি হয়ে থাকে সেপ্টেম্বর ও অক্টোবর মাসে। এই ঝড় ঘূর্ণিবায়ুর আকারে তীব্র গতি নিয়ে সমুদ্র থেকে আরম্ভ হয়ে বাংলাদেশের উপকূলে আঘাত করে। এই ঝড়কে টর্নেডো বা ঘূর্ণিঝড় বলা হয়। এই ঝড়ের জন্য জলোচ্ছ্বাসের সৃষ্টি হয় এবং জানমালের ক্ষতির পরিমাণ আজও অত্যধিক। আমাদের আলোচ্য সময়ে ঝড়-জলোচ্ছাসের প্রকৃত তথ্য আমাদের কাছে পৌঁছেনি। তবে, তখনো যে মাঝে মধ্যেই ঝড়-জলোচ্ছ্বাস হতো এ আভাস ইঙ্গিত সমসাময়িক কালের ইতিহাস থেকে পাওয়া যায়। এ বিষয়ে অন্যত্র আলোচনা করা হয়েছে। আবুল ফজল ১৫৮৪ খ্রিষ্টাব্দে বাকলা সরকারে সংঘঠিত একটি ভীষণ ঝড় ও জলপ্লাবনের বর্ণনা দিয়েছেন। তার বর্ণনায়-ইলাহী অব্দের ঊনত্রিশ সালে অপরাহ্ণে তিন ঘটিকার সময় একটি প্রচণ্ড জলপ্লাবন দেখা দেয়। এর ফলে সমগ্র সরকার বানের জলে প্লাবিত হয়ে যায়।’ সে সময়ে রাজা একটি ভোজানুষ্ঠানে ছিলেন। তিনি তৎক্ষণাৎ একটি নৌকায় আরোহণ করেন, আর তার পুত্র পরমানন্দ রায় কতিপয় লোকের সঙ্গে একটি মন্দিরের চূড়ায় আরোহন করেন এবং একজন বণিক একটি চিলেকোঠায় আশ্রয় নেন। মাত্র চার ঘণ্টাব্যাপী বজ্রপাতসহ সমুদ্র-বাতাসের প্রবল ঝটিকা ও জলপ্লাবনের প্রচণ্ড প্রকোপ চলে। বাড়ি-ঘর, নৌকা সব ডুবে যায়, কিন্তু মন্দির বা চিলেকোঠার কোনো ক্ষতি না হওয়ায় সেখানে আশ্রয়গ্রহণকারী কিছু লোকের জীবন রক্ষা পায়। কিন্তু অঞ্চলের দুইশত সহস্র জীবন এই প্লাবনে বিনষ্ট হয়।৩৩ নদ-নদী ও বৃষ্টিপাত বাংলার মাটির উপর স্বাভাবিক জলসেচ ও সারের কাজ করত। ফলে অসামান্য উৎপাদন ক্ষমতা ও সমৃদ্ধিতে সহায়ক হয়েছে। আবার নদীগুলি মাঝে মাঝে তাদের গতিধারা পরিবর্তনের মাধ্যমে উত্তর ও পূর্ববঙ্গে প্রচুর বদ্ধ জলাভূমি সৃষ্টি করেছে। সেগুলি হাওড়, বাওড়, বিল-ঝিল প্রভৃতি নামে পরিচিত। দীর্ঘকাল স্থায়ী বৃষ্টিপাতও অনুরূপ জলাবদ্ধ জায়গার সৃষ্টি করত। সমসাময়িক লেখকদের বর্ণনাতে পাওয়া যায়, এই জলাবদ্ধতা চারিদিকের আবহাওয়াকে অস্বাস্থ্যকর করে তুলত এবং রোগ-বালাইয়ের জন্ম দিত। আবুল ফজল মন্তব্য করেন, ‘অতীতে বর্ষা শেষ হওয়ার পর বাতাস মহামারী উৎপাদনকারী বলে অনুভূত হত এবং এটা মারাত্মকভাবে মানুষ ও জীবনের ক্ষতি করতো।’৩৫
প্রাচীনকালে আর্যরা এদেশকে ম্লেচ্ছ, অসভ্য, দাস প্রভৃতি জনবসতির দেশ বলে আখ্যায়িত করেছিল। আবহাওয়া অত্যন্ত অস্বাস্থ্যকর বলে জানত। এদেশে কোনো আর্যসন্তান এলে তার প্রায়শ্চিত্ত করার বিধান ছিল। দেশে প্রচুর বন-জঙ্গল ও জলাভূমি ছিল বলে তৎকালীন সময়ে বন্য হিংস্র জন্তু ও সাপের বেশ উপদ্রব ছিল। বন্য জন্তুর আμমণে ও সাপের কামড়ে কোনো কোনো সময় লোকের প্রাণহানিও ঘটত। এজন্য সমাজে গুণী ও ওঝাদের একটি বিশেষ স্থান ছিল। লোকদের বিশ্বাস ছিল যে, গুনিরা মন্ত্র দিয়ে বাঘ-ভালুকের আক্রমণ থেকে এবং ওঝারা সাপের বিষক্রিয়া থেকে মানুষকে রক্ষা করতে পারে। ওঝারা সাপুড়ে নামে পরিচিত ছিল। এই সাপুড়েরা সময়ে সাপের খেলা দেখিয়ে বেড়াত। সাপখেলার একটি সুন্দর বণর্না কবি উমাপতিধরের কাব্যে পাওয়া যায়:
ক্ষুদ্রান্তে ভুজগাঃ সিরাংসি নময়ত্যাদায়
যোষামিদং ভ্রাতর্জাঙ্গলিক ত্বদানন মিলন্মন্ত্রাণুবিদ্ধং
রজঃ। জীর্ণ স্তেষ ফণী ন যস্য কিমপি
ত্বাদৃগ্ গুণীন্দ্রব্রজা কীর্ণক্ষ্মাতলধাবনাদপি ভজ্য-
ত্যানম্রভাবং শিরঃ॥
ভাই বিষবৈদ্য, তোমার মুখোচ্চারিত মন্ত্রপুত ধূলি যাদের মস্তক নত করে, সেই সাপগুলি ছোট। এই সাপটি বৃদ্ধ, যার মস্তক তোমার মত গুণিগণাধ্যুষিত পৃথিবীতে বিচরণ সত্ত্বেও এতটুকু নম্রভাব ধারণ করে না।৩৬ এমনকি সেদিনও প্রথম যুগের মুসলমান ঐতিহাসিকগণ বাংলাদেশকে প্লেগ, ম্যালেরিয়া ও অন্যান্য রোগের জন্মভূমি বলে চিত্রিত করেছেন। তাঁদের বক্তব্যে তাঁরা আর্যদের মন্তব্যের পুনরুক্তি করেছেন মাত্র। মুরদেশীয় বিখ্যাত পরিব্রাজক ইবনে বতুতার মন্তব্যে এসব কথার সমর্থন পাওয়া যায়। তিনি বলেন, খোরাসানের অধিবাসীরা বাংলাকে ‘দুজুখ-ই-পূরনিয়ামত’ অর্থাৎ ‘সমস্ত ভাল জিনিসের নরক’ বলে আখ্যায়িত করেছেন’৩৭ মধ্যভারতের অধিবাসীরা বাংলার জলবায়ু, বৃষ্টিপাত ও প্রাকৃতিক অবস্থাকে অত্যন্ত ভীতিকর মনে করত এবং কোনো উপলক্ষে বাংলাদেশে জীবনযাপন করা অত্যন্ত অপছন্দ করত।
৩২ আবুল ফজল- আইন-ই-আকবরী।
৩৩ আবুল ফজল- আইন-ই-আকবরী।
৩৪ আবুল ফজলঃ আইন-ই-আকবরী।
৩৫ আবুল ফজল: আকবর নামা- তৃতীয় খণ্ড।
৩৬ উমাবতি ধর: সদ্যুক্তিকর্ণামৃত।
৩৭ H.A. Gible- Ib-n- Battuta.
আদি বাংলার ইতিহাস (প্রাগৈতিহাসিক যুগ থেকে ১২০৫ খ্রিষ্টাব্দ) পর্ব ২১
©somewhere in net ltd.