![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
আদি বাংলার ইতিহাস
(প্রাগৈতিহাসিক যুগ থেকে ১২০৫ খ্রিষ্টাব্দ) পর্ব ২৩
গৌড় দখল করার পর বাদশাহ হুমায়ুন অমাত্য জাহিদ বেগকে বাংলার শাসনকর্তা নিযুক্ত করেন। সমৃদ্ধিশালী সুবার এরকম একটি উচ্চ পদে নিযুক্তির জন্য সম্রাটের নিকট কৃতজ্ঞতা প্রকাশ না করে জাহিদ বেগ বাদশাহকে উদ্দেশ্য করে বলেন, “জাঁহাপনা কি আমাকে মারার জন্য বাংলা অপেক্ষা উত্তম জায়গা আর খুঁজে পাননি।” ৩৭
এমনকি সম্রাট আকবরের শাসনকালের প্রথমদিকে মোঘল সৈন্যরা বাংলার চাকুরি করতে পছন্দ করত না, যদিও তাদেরকে দ্বিগুণ বেতন দেয়া হয়েছিল। অনুমান করা হয়, অস্বাস্থ্যকর জলবায়ুর কারণে গৌড় ও পাণ্ডুয়ার জাঁকজমকপূর্ণ শহরগুলো পর্যন্ত মোঘল রাজপ্রতিনিধি এবং রাজকর্মচারীগণ কর্তৃক পরিত্যক্ত হয়েছিল। ১৫৭৫ খ্রিষ্টাব্দে খান খানান মুনিম খানের সুবাদারির সময়ে গৌড়ে ব্যাপকভাবে প্লেগ রোগের প্রাদুর্ভাব ঘটে। সমস্ত অঞ্চল মারাত্মকভাবে আক্রান্ত হয়। এই মহামারীতে বহুসংখ্যক মোঘল সেনাপতি, সৈনিক ও রাজকর্মচারীর মৃত্যু হয় এবং সুবাদার গৌড় থেকে তান্ডায় সুবাবাংলার রাজধানী স্থানান্তরিত করেন। ৩৮
অবশ্য এটা ছিল একটি মহামারীতে আক্রান্ত হবার সময়। সব সময়ে সমস্ত বাংলার জলবায়ু অস্বাস্থ্যকর ছিল, এটা বোধ হয় ঠিক নয়। বাংলা সম্পর্কে আর্যদের উক্তি এবং পরবর্তীকালে মোঘলদের ধারণা সঠিক বলে মনে হয় না। বিশেষ করে গৌড়ের জলবায়ু এতটা অস্বাস্থ্যকর হলে সেখানে শতবর্ষের অধিককাল বঙ্গের রাজধানী থাকার কথা নয়। গৌড় শুধু রাষ্ট্রের রাজধানীই ছিল না, প্রাচীন যুগের শেষ কাল থেকে মধ্যযুগের প্রারম্ভিক কাল পর্যন্ত গৌড় একটি সমৃদ্ধিশালী শহর ছিল এবং এর পরিচিতি ছিল সমস্ত উত্তর ও মধ্যভারতে। উৎখননের ফলে অনেক ঐতিহাসিক তথ্য বেরিয়ে এসেছে। আজকাল জানা যায় যে, অনেক প্রাচীনকাল থেকেই বাংলা অনেক উন্নত জাতিগোষ্ঠীর আবাসস্থল ছিল। তারাই গড়ে তুলেছিল তাম্রলিপ্ত, চন্দ্রকেতুগড়, পুণ্ড্রবর্ধন, গঙ্গাবন্দর এবং এমন আরও অনেক শহর ও বন্দর। এই শহর ও বন্দরের সঙ্গে পৃথিবীর বহু দেশ ও জাতির ব্যবসায়িক আদান-প্রদান ছিল। বাংলার অনেক অঞ্চলই শিল্পসমৃদ্ধ অঞ্চল হিসেবে প্রাচীনকালে বহির্বিশ্বে পরিচিত ছিল। পাল এবং সেন আমলে বাংলার রাজধানী গৌড়ে যে কৃষ্টি-সংস্কৃতি, শিল্প-সাহিত্য, জ্ঞান-বিজ্ঞানের চর্চা হতো তা তৎকালীন মধ্য ভারতের জন্যও উপেক্ষা করার মতো ছিল না। সভ্যতার এই স্তরে উন্নয়ন নিশ্চয় একটি অঞ্চলের দূষিত আবহাওয়ার লক্ষণ হতে পারে না। বিদ্যাকরের সুভাষিত রত্নকোষ শ্রীধরদাসের সদ্যুক্তিকর্ণামৃত, কবি ধোয়ীর পবনদূত, কবি জয়দেবের গীতগোবিন্দম এবং বিভিন্ন পুরাণ গ্রন্থ এ যুগেই রচিত হয়েছিল। এ মুক্ত চিন্তা-চেতনা ও গভীর মননশীলতার পরিচায়ক যা দূষিত আবহাওয়ার ফসল হতে পারে না।
সম্রাট হুমায়ুন কিছুদিন গৌড়ে বাস করেছিলেন। তিনি কয়েক মাস এই সুন্দর শহরে অবস্থান করেন এবং স্নিগ্ধ জলবায়ু ও সুন্দর পরিবেশে এত বেশি মুগ্ধ হন যে, তিনি এই শহরের নামকরণ করেন জান্নাতবাগ বা স্বর্গ। সুলতান বলবনের পুত্র নাসিরউদ্দিন বুগরাখান বাংলার বিশুদ্ধ জলবায়ু ও সবুজ বৃক্ষরাজির সমারোহ এত ভালবাসতেন যে, তিনি দিল্লির সম্রাট হওয়ার চেয়ে বাংলার শাসনকর্তা থাকা অধিক পছন্দ করেছেন। আবুল ফজলের বর্ণনায় প্রকাশ পায় যে, বাংলার জলবায়ু যতটা অস্বাস্থ্যকর বলে বর্ণিত হয়েছে, বাস্তবিকপক্ষে ততটা খারাপ ছিল না। বৃষ্টিপাতের পরে মহামারী সৃষ্টিকারী জলবায়ুর কথা বলতে গিয়ে এই মোঘল ঐতিহাসিক আরও জানিয়েছেন যে, “বর্তমান শাহানশাহের আমলে এই অশুভ আবহাওয়ার অবসান হয়েছে।” এতে বোঝা যায় যে, জলবায়ুর পরিবর্তন হচ্ছিল। আর এই পরিবর্তন নিশ্চয় হঠাৎ করে হয়নি। দেশের জলবায়ু উন্নত করার জন্য সম্রাট আকবরের কাছে নিশ্চয় কোনো ঐন্দ্রজালিক ক্ষমতা ছিল না। নদ-নদী, বৃষ্টিপাত ও জলাভূমিসমূহ তখনও একই রকম ছিল। তা হলে কিভাবে এই অসাধারণ শুভ পরিবর্তন ঘটে ?
৩৭ আবুল ফজলঃ আইন-ই-আকবরী।
৩৮ আবুল ফজল: আকবর নামা- তৃতীয় খণ্ড।
আদি বাংলার ইতিহাস (প্রাগৈতিহাসিক যুগ থেকে ১২০৫ খ্রিষ্টাব্দ) পর্ব ২২
©somewhere in net ltd.