নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

ওয়াসি আহমেদ

ওয়াসি আহমেদ › বিস্তারিত পোস্টঃ

জীবনের এইসব নিভৃত কুহক

০৫ ই সেপ্টেম্বর, ২০১৭ দুপুর ১:৪৩

শান্তিবাগ এলাকার একটা আড়াইতলা বিল্ডিং। সরকারি অফিসের ঘুষখোর কেরানি সুবিমল সাহা লাখ চারেক টাকা খরচ করে বাড়িটার পাঁচ তলার ভিত বানিয়েছিল, তবে পরবর্তীতে অর্থের যোগান অথবা ইচ্ছা, এই দুইয়ের কোন একটার অভাবে তা আর আকাশ ছুঁতে না পেরে ভগ্নাংশেই থেমে যায়।

আড়াইতলার দুটো ঘর ভাড়া নিয়ে রাবেয়া আর তার পিকআপ ভ্যানচালক স্বামী জামালের সংসার। বাড়ির বাইরের দেয়ালে রঙ নামক বিলাসিতার স্থান নেই, বরং ধূসর সিমেন্টের পলেস্তারা খসে পড়েছে কয়েক জায়গায়। ফাটল থেকে স্তরে স্তরে জন্ম নিয়েছে মস আর থকথকে জেলীর মতো শৈবালের প্রলেপ।

সেই সবুজ রঙ দেখেই হয়তো কোন এক দুপুরে রাবেয়ার মনে পুঁইশাক খাবার প্রচন্ড ইচ্ছা জেগে ওঠে। জানালার ফাঁক দিয়ে হাত নেড়ে রাস্তায় চলমান এক ঝাঁকাওয়ালা ব্যক্তিকে সে "এই তরকারি, এই তরকারি বলে" ডাক দেয়। অথবা এমন-ও হতে পারে, স্বামীকে কাছে না পেয়ে রাবেয়ার খুব একাকীত্ব বোধ হয়, বাড়ির আশেপাশে কথা বলার মতো কাউকে না পেয়ে সে 'জনৈক তরকারি'র' সাথে দরদামের মাধ্যমে মনের ভাব প্রকাশ করার ইচ্ছা পোষণ করে।

ঝাঁকা মাথায় হেঁটে চলা 'তরকারি'র' নাম আমরা জানি না, জানার দরকার-ও নেই। ভরদুপুরে এমন আড়াইতলা, চারতলা, ছয়তলা এমনকি নয়তলা বিভিন্ন বাড়ি থেকে গৃহবন্দী গৃহিণীরা তাকে "এই তরকারি" বলেই ডেকে থাকে। তবে তার অতীত পর্যালোচনা করলে আমরা একটা জিনিস জানতে পারি: বছর দশেক আগে সে বেঁচে থাকার জন্য ঢাকা শহরে তরকারি বেচতে এসেছিল, আর এখন সে ঢাকা শহরে তরকারি বেচার জন্যই বেঁচে আছে। তাই রাবেয়ার মুখে "এই তরকারি" ডাক শুনে সে যখন ঝাঁকা নামিয়ে ওপরের দিকে মুখ তুলে তাকায় এবং হাসিমুখে নিজের জর্দা খাওয়া লালচে কালো দাঁতের পাটি প্রদর্শন করে, তখন রাবেয়া এক আঁটি পুইশাক আর তিনটা ঝিঙের দরদামে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। বেশ কিছুক্ষণ আলোচনা করেও দুপক্ষ কোন সমাধানে আসতে না পারায়, রাবেয়া জানালার খিল আঁটকে দেয় এবং তখন জনৈক তরকারি তাকে মাতারি-গোছের কোন একটি গালি দিয়ে সেখান থেকে চলে যায়। পুইশাক না কেনার পেছনের কারণটা কি আসলে টাকার অভাব নাকি কথা বলার ইচ্ছাশক্তি ফুরিয়ে যাওয়া- এই বিষয়ে কারো ধারণা নেই।

জানালা বন্ধ করে রাবেয়া কিছুক্ষণ লাল রঙের একটা কাঁথা বোনার কাজে ব্যস্ত থাকে, তারপর চৌদ্দ ইঞ্চি টিভিতে কোন এক মেগাসিরিয়ালের দুইশ তেপ্পান্নতম পর্ব দেখে ঘুমাতে যায়। সন্ধ্যায় ঘুম ভাংগার পর জামালের জন্য ফ্রিজ থেকে একটা বেগুন বের করে চাকা চাকা করে কেটে তাতে মসলা মাখায় সে, তারপর কড়া করে ভেজে ফেলে। গরম তেলে রাবেয়ার কয়েক ফোটা ঘাম গড়িয়ে পড়ায় কড়াইয়ে ছ্যাৎ করে একটা বিকট শব্দ হয়, খানিকটা গরম তেল ছিটকে এসে রাবেয়ার বাম হাতের চিরস্থায়ী টিকাচিহ্নের ঠিক নিচে আরেকটা কালো দাগ সৃষ্টি করে।

আবার লাল কাঁথা বুননের কাজ শুরু হয়, চৌদ্দ ইঞ্চি টিভিতে অন্য আরেক মেগাসিরিয়ালের একশ চৌত্রিশতম পর্বের পুন:প্রচার হয়। রাত দশটা বারো মিনিটে জামাল ঘরে ঢুকলে তার ঘামের টক টক গন্ধের আড়ালে ভাজা বেগুনের গন্ধ চাপা পড়ে যায়। মোটা চালের ভাতের সাথে পোড়া বেগুন আর কাঁচা পেয়াজ খেয়ে জামালের পেটের ক্ষুধা মিটলেও সৃষ্টির আদিকাল থেকে তার কোষের গহীনে প্রোথিত অন্য আরেক প্রকার ক্ষুধার নিষ্পত্তি ঘটে না। বউকে ধাক্কা দিয়ে খাটে শুইয়ে নিজের প্রতাপ প্রদর্শনে ব্যস্ত হয়ে পড়ে পিক-আপ ভ্যানচালক, নীচ থেকে শামুকের মতো গুটিয়ে পড়া রাবেয়া একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে ঘরের উল্টোপাশের দেয়ালে ঝুলানো ক্যালেন্ডারের দিকে। কাগজের পাতায় ফুটে থাকা নীলাভ চোখের বিদেশি শিশু ওর মনে কিছুক্ষুণের জন্য মাতৃত্বলাভের তীব্র আকাঙ্ক্ষা জন্ম দিলেও, এক বছর আগে সদর হাসপাতালে ফেলে আসা নিজের জরায়ুর কথা ভেবে রাবেয়া চুপসে যায়। জামালের শরীরের টকটক গন্ধটা আরো প্রবল হয়ে ওঠে, ক্যালেন্ডারের ওপর থেকে একমাত্র সাক্ষী মোটাসোটা টিকটিকি প্রতিবাদের ভাষায় টিকটিক করে ডাকে। আর সেই সাথে বিছানার পাশে রাখা এলার্ম ঘড়ির মিনিট-সেকেন্ডের কাটাদুটো সশব্দে জানান দেয় সাত মিনিটের পরিসমাপ্তির।

জামাল আরেকদিকে পাশ ফিরে শোয়, তবে তার আগে রাবেয়ার হাতে একশ টাকার তিনটি ময়লা নোট ধরিয়ে বলে, "কাইলক্যা মুরগী কিন্যা রাইখো একখান। শরীরে পোরটিনের দরকার আছে, বুঝলা বউ?" রাবেয়া মুখ খোলার আগেই খুলে যায় জামালের নাক, আড়াই তলার ঘরের ভেতর বজ্রপাত হয় সারারাত।
পরদিন সকালবেলা জামাল কখন যেন তড়িঘড়ি করে বেরিয়ে যায় ঘর থেকে। পাশের বাড়ির দোতলা থেকে জনৈক ব্যর্থ কবির গমগমে কণ্ঠস্বর শোনা যায়। রোজ সকালের মতো বিরস মুখে সস্তার সিগারেট হাতে নিয়ে সে নিজমনে আবৃত্তি করে যায়; কখনও জীবনানন্দ, কখনও বিষ্ণু দে আবার কখনও শক্তি চট্টোপাধ্যায়। আজকের সকালটা অবশ্য শঙ্খ ঘোষের জন্য বরাদ্দ-

‘হাতের উপর হাত রাখা খুব সহজ নয়
সারাজীবন বইতে পারা সহজ নয়
এ কথা খুব সহজ, কিন্তু কে না জানে
সহজ কথা ঠিক ততটা সহজ নয়।’

কবির সাথে পরিচয় না থাকলেও কবিতার লাইনগুলো হয়তো রাবেয়ার মাথায় ঘুরপাক খায়, ঠিক যেমনটা স্রষ্টাকে না দেখেও তাঁর সৃষ্টির প্রতি মুগ্ধবোধ জন্ম নেয় সাধারণ মানুষের। ঝড়ো বাতাসের মতো ঝিলিক দিয়ে মাথার ভেতর কিছু স্মৃতি ঘুরপাক খায় ক্ষণিকের জন্য। স্মৃতিগুলো সংসার জীবনের বাস্তবতার কাছে ম্লান হয়ে যায় প্রতিদিন, তবুও এমন কোন কোন সকালে অজ্ঞাত কারণে সেসব ভেবে বুকের ভেতর থেকে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে।

দুপুরে আবার জানালার ফাঁক দিয়ে রাবেয়ার চুড়ি পরা হাত বেরিয়ে আসতে দেখা যায়। মহল্লার লোকেরা শুনতে পায়, জামালের বৌ ঝাঁকা মাথায় চলন্ত এক ফেরিওয়ালাকে "এই মুরগী, এই মুরগী" বলে ডাকছে।

তবে ঝাঁকার ভেতর ঠেসে রাখা জীবন্ত মুরগীদের ক্রমাগত কক্কক আর কোক্করোক্কোর আওয়াজ ছাপিয়ে নারীকন্ঠের সেই দুর্বল আর্তনাদ জনৈক 'মুরগীর' কানে পৌছায় না।

মন্তব্য ২ টি রেটিং +২/-০

মন্তব্য (২) মন্তব্য লিখুন

১| ০৫ ই সেপ্টেম্বর, ২০১৭ বিকাল ৩:২৬

আমি পোলাপাইণ বলেছেন: মানবতা মানষিকতা সুশিক্ষা বিবেক

২| ০৫ ই সেপ্টেম্বর, ২০১৭ রাত ১০:১৮

আহমেদ জী এস বলেছেন: ওয়াসি আহমেদ ,




শক্তিশালী হাতের লেখা । ষ্টাইলটা চমৎকার ...

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.