নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

\'আমাদের চাওয়া আর পাওয়ার মাঝখানে একটা দেয়াল আছে, এর একদিকে থাকে চাওয়া,আর একদিকে পাওয়া। মুখ্য সমস্যা হল দেয়ালটা স্বচ্ছ কাঁচের\'

যাযাবর জোনাকি

‘আমাদের চাওয়া আর পাওয়ার মাঝখানে একটা দেয়াল আছে, এর একদিকে থাকে চাওয়া,আর একদিকে পাওয়া। মুখ্য সমস্যা হল দেয়ালটা স্বচ্ছ কাঁচের’

যাযাবর জোনাকি › বিস্তারিত পোস্টঃ

মায়া

০২ রা ফেব্রুয়ারি, ২০১৬ রাত ৮:১৬

শীতের কোমল রোদের মতই হলুদ ,কিছুটা বেশীই উষ্ণ রোদ জানালার কাঁচ, সাদা পর্দা ভেদ করে পাশের সাদা বিছানাটায় পড়ছে। কক্ষ তাপমাত্রা প্রায় শরতের ভোরের মত করে সুনিয়ন্ত্রিত। সোনা রোদ বিছানা থেকে যেন সারা ঘরে বিচ্চুরিত হচ্ছে। সাদা ছোট ঘরটা উজ্বল হলুদাভ হয়ে উঠেছে। বিছানার পায়ের দিকের ধাতব শীতল কিছু তাঁর পায়ের কোন একটা আঙুল স্পর্শ করে আছে, তিনি ঠিক ধরতে পারছেন না যে নির্দিষ্ট কোন আঙুল এটা। তিনি পর্দার ফাঁক গলে জানালা দিয়ে কাঁচের ওপারের ঝকঝকে নীল আকাশ আর একটু সাদা মেঘ দেখতে পাচ্ছেন,এর জন্য তাকে কোন প্রকার কষ্ট করতে হচ্ছেনা, তাঁর মাথাটা ঠিক ওইভাবেই কাত করে রাখা আছে। যিনি বিছানায় সটান হয়ে শুয়ে আছেন, তাঁর নাম ইঞ্জিনিয়ার জহির আহমেদ। হ্যা তিনি নিজের নাম মনে করতে পারছেন এ ব্যাপারে কোন প্রকার সন্দেহ নেই কারন জ্ঞান ফেরার পর থেকে প্রত্যেকবার ঔষধ দেয়ার সময় এক অথবা একেক জন চৈনিক নার্স (কারন জহির সাহেব তাদের কে আলাদা করে চিনতে পারছেন না, সবাইকে মনে করছেন একই জন) এসে জিজ্ঞেস করছেন "can you please confirm me your name sir? " জহির সাহেব প্রত্যেকবার ঘুম জড়ানো কন্ঠে উত্তর দিচ্ছেন "Engineer Johir Ahmed " নার্স উত্তরে প্রতিবার বলছেন "very Good Mr.Ahmed, are you feeling any pain?" জহির সাহেব ঘোরের মধ্যে উত্তর দিচ্ছেন "No, but feeling something cold at my feet" নার্স হেসে উত্তর দিচ্ছে “don’t worry, it’s ok”.

ইঞ্জিনিয়ার জহির আহমেদ সমাজের একজন উঁচুশ্রেণীর মানুষ, তিনি তাঁর কর্ম জীবন শুরু করেন একজন সরকারি প্রকৌশলী হিসাবে, পরবর্তিতে বিভিন্ন বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে উপদেষ্টা হিসেবে বেশ কিছুদিন কাজ করেন এবং পরিশেষে নিজেস্ব ভূসম্পত্তি ব্যাবসায় বেশ অর্থকড়ি করেছেন। স্ত্রী, এক মেয়ে এবং এক ছেলে নিয়ে তাঁর সুখের সংসার। সম্প্রতি তাঁর হৃদরোগ দেখা দেওয়ায় চিকিৎসার উদ্দেশ্যে তিনি সিঙ্গাপুর আসেন, এখানে আসার পর জানতে পারেন তাঁর ফুসফুস এবং হৃদয়ের অবস্থা বেশী সুবিধের নয়, তাঁর Pulmonary hypertension (PH) হয়েছে, এই রোগের তেমন কোন চিকিৎসা এখন পর্যন্ত বের হয়নি। জহির সাহেব আসলে দীর্ঘদিন ধরে এই অসুখে ভুগেছেন,কাজ পাগল মানুষ বলে শারীরিক সমস্যা গুলিকে খুব একটা পাত্তা দেননি,কিন্তু শেষের দিকে যখন বারবার একটু বেশী পরিশ্রমেই অজ্ঞান হয়ে পড়ে যাচ্ছিলেন,তখন খানিকটা মৃত্যু ভয়ে তিনি চিকিৎসকের কাছে যান।এই অসুখের কারনে তাঁর হৃদয় এবং ফুসফুস প্রায় অকেজো হয়ে এসেছিল,কোন উপায় নেই দেখে চিকিৎসকরা সিদ্ধান্ত নেন জহির সাহেবের হৃদয় এবং ফুসফুস দুটোই প্রতিস্থাপন করার, প্রথমে খরচ শুনে জহির সাহেব রাজি না হলেও পরে তিনি রাজি হন। তিনি কেন জানি এই ৬০ বছর বয়েসেও বাঁচার মায়াটা কে দূরে ঠেলে দিতে পারেননি।শুক্রবার দিনে তাঁর অস্ত্রোপচার হয়,আস্তে আস্তে সব কিছুই জহির সাহেবের মনেপড়ছে, তিনি পর্দার ফাঁক গলে কাঁচের জনালা দিয়ে তাকিয়ে আছেন বাইরের দিকে।

বাইরে অনেক রোদ এখন, আকাশের নীলটা আরেকটু গাঢ় নীল হয়েছে, এখন আর কোন মেঘ দেখা যাচ্ছেনা,ঘরের ভেতরে অনেক ঠান্ডা,বাইরে রোদের তেজ বোঝার উপায় নেই,তাই রোদটা দেখে আরামই লাগছে। জহির সাহেব জটিল চিন্তায় মগ্ন হলেন, চিন্তার বিষয় ‘জীবন-মৃত্যু’। তিনি ইহকালে কোনদিন এইসব দার্শনিক চিন্তাভাবনায় মশগুল হননি, বরাবরই তিনি খুবই বাস্তববাদী লোক,সৎ,দয়ালু কিন্তু কোনদিন কোন ক্ষেত্রে তিনি আবেগ কে প্রশ্রয় দেননি,আজ এইসব চিন্তা করছেন কারন এই ছাড়া এখন তাঁর করার মত কোন কাজ নেই। তিনি চিন্তা করছেন এইসব কিছুর শুরু হয়েছে তাঁর প্রথমবার অজ্ঞান হয়ে পড়ে যাওয়ার পর থেকে,প্রথমবার যখন ব্যাপারটা ঘটে তখন তিনি একতলা সিড়ি দিয়ে উপরে তাঁর অফিসে যাচ্ছিলেন,তাঁর মনে হচ্ছিল তিনি অনেক হাঁপিয়ে উঠেছেন, এমনিতেই সারাদিন অনেক পরিশ্রম গেছে, স্বাভাবিক ভাবেই তিনি মনে করলেন আরেকটু, তারপর অফিসে বসে বিশ্রাম নিবেন সব ঠিক হয়ে যাবে, মনের জোড়ে তিনি শরীরটা কে টেনে নিতে চাইলেন, কিন্তু শরীর শুনলো না মনের কথা,তাঁর দম বন্ধ হয়ে আসতে শুরু করল,আস্তে আস্তে সব অন্ধকার হয়ে এলো...যখন জ্ঞান ফিরলো তখন মনে হল গভীর ঘুম থকে তিনি আস্তে আস্তে জেগে উঠছেন,কানের কাছে অনেক মানুষের ফিসফিসানি,মূখে ঠান্ডা মেঝে আর নাকের নিচে তীব্র ব্যাথা অনূভব করলেন,শরীরটা অনেক ক্লান্ত মনে হচ্ছিল তাঁর কাছে,এই জ্ঞান হারানো আর ফেরার মাঝখানের কোন স্মৃতি নেই। এই সম্পূর্ন ব্যাপারটা তিনি মেনে নিতে পারেননি,শরীর আগেও অনেক খারাপ হয়েছিল, কিন্তু সবসময় পরিস্থিতি বুঝে শরীর কথা শুনেছে,কোনদিন অবাধ্য হয়নি,একবার যুবক বয়সে প্রকল্প চলাকালীন সময়ে তাঁর বসন্ত হল,তখন অল্পকিছু দিন হয় তিনি চাকরীতে যোগ দিয়েছেন,ছুটি নিলেন দুপুরে,রাত নয়টায় বাস, এদিকে গা কাঁপিয়ে প্রচন্ড জ্বর আসছে, কোথাও যাওয়ার যায়গা নেই, কি করবেন বাসস্ট্যান্ডে একটা চেয়ারে একভাবে বসে রইলেন বাকি সময়টুকু,তারপর ৬ ঘন্টার বাস যাত্রা করে বাড়ী ফিরেছিলেন, শরীর অবাধ্য হয়নি সহ্য করেছিল মনের কথা মত।সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয় ঐ জ্ঞান হারানোর সময়টুকু তাঁর কোন স্মৃতি নেই,কল্পনা নেই বা স্বপ্নের মতোও কিছুই নেই, ফাঁকা,শুধুই ফাঁকা!

জহির সাহেব আবার মূল চিন্তার ধারায় ফিরে এলেন,এই যে জীবন, জীবন কী? এই জীবন ব্যাপারটা জন্ম-মৃত্যুর মত দুইটি বন্ধনী দ্বারা আবদ্ধ,কার্যতই প্রথম বন্ধনীর আগেও অজানা শেষ বন্ধনীর পরেও।একটি শিশু জন্ম নেয়,জন্ম নেয়ার সম্পূর্ণ প্রক্রিয়াটি আবেগময় একটি ঘটনা, জন্মনেয়া মাত্রই শুরু হয় মায়ার খেলা।তবে মৃত্যু কি? মৃত্যু কি ঐ জ্ঞান হারানোর সময়টুকুর মতই এক বিশাল ফাঁকা,একটা শেষ,একটা অসীম ফাঁকা? তিনি কোন এক বইয়ে পড়েছিলেন লাইনটা এখনও মনে আছে ‘Some infinities are bigger than other infinities’ সে রকম হতে পারে ‘Some nullities are bigger than other nullities’যেমনটা বলা হয়ে থাকে সৃষ্টির শুরুতে কিছুই ছিল না, সব ফাঁকা,ছিল আদি-অন্তহীন এক নিঃস্বতা।

মৃত্যু চিন্তায় তাঁর মনেপড়ে গেল ছেলেবেলার এক স্মৃতি, তখন তাঁর বয়েস কত আর হবে ৪-৫ বছর, একদিন শীতের রোদ মাখা এক সকালে তিনি তাঁর বাড়ির উঠানে বসে গরম পায়েশ খাচ্ছিলেন, এমন সময় দেখলেন একটা বিড়াল তার তিনটা ছানা নিয়ে উঠানে এসে দাঁড়াল, তিনি সাহস করে উঠে গিয়ে বিড়াল গুলি কে পায়েশ খেতে দিলেন,পায়েশ খেয়ে বিড়াল গুলি তাঁর ন্যাওটা হয়ে গেল, তিনটির মধ্যে একটা সাদা-কালো বিড়াল ছানা তাঁর খুবই প্রিয় ছিলো, প্রায় সবসময় তিনি সেটাকে কোলে নিয়ে থাকতেন,অথবা বিড়াল ছানাটা তাঁর পায়ে পায়ে ঘুরতো। একদিন গৃহ শিক্ষকের সামনে তিনি পড়ার টেবিলে সেই বিড়ালটাকে টেনে তুললেন, গৃহ শিক্ষক ছিলেন বয়স্ক মানুষ,তিনি জহির সাহেব কে খুব স্নেহ করতেন।বিড়ালটার দিকে তাকিয়ে দেখে তিনি জহির সাহেব কে বললেন, ‘বাবা জহির,তুমি যদি বিলাইডারে পুষতেই চাও,তাইলে ওরে গোসল দেয়াওনা ক্যান, ওর গায়ে দুনিয়ার নোংরা, তোমার অসুখ করবে তো!’ শিক্ষকের কথা শুনে ছোট্ট জহিরের মাথায় নতুন এই কান্ড করার ভুত চেপে গেল। শিক্ষক চলে যেতেই তিনি বদনাতে করে পানি নিয়ে এসে বিড়ালছানাটার গায়ে ঢেলে দিলেন, শীতে ঠান্ডা পানিতে বিড়াল গা ঝেড়ে দৌড়ে পালালো। তারপর দুপুর গড়ায়, সন্ধ্যা নামে,রাত আসে, ছোট্ট জহির তাঁর পোষা বিড়ালছানাটাকে আর খুঁজে পান না, মুখ দিয়ে শব্দ করে ডাকেন,কোন সারা নেই , ছোট্ট জহিরের মন খারাপ হয়ে যায় , এক সময় তিনি কাঁদতে কাঁদতে তাঁর মাকে গিয়ে বলে এই ঘটনা , তাঁর মা তাঁকে শান্তনা দেয় যে সকাল হলেই তাঁকে বিড়াল ছানা খুঁজে দেবে। পরদিন সকালে জহির সাহেবের আর তাঁর বড় ভাই আসাদ মিলে বিড়ালছানা টাকে খুঁজতে শুরু করে , এক সময় আসাদ বৈঠক খানার খাটের নিচে থেকে একটা পুরান খবরের কাগজ টেনে বের করে আনেন, খবরের কাগজের ওপর টানটান হয়ে পড়ে আছে বিড়াল ছানাটি , তার মুখে ঐ খবরের কাগজ থেকে কামড়িয়ে নেয়া একটুকরো কাগজ, ছোট্ট জহির বিড়ালছানার গায়ে হাত বুলিয়ে দেন,বিড়ালছানার গা ঠান্ডা, গায়ে কিছু পিঁপড়াও ঘুরে বেড়াচ্ছে, জহির মুখ দিয়ে শব্দ করে বিড়ালছানাটাকে ডাকেন, পাশ থেকে তাঁর বড় ভাই প্রায় ফিসফিস করে বলে ‘ধুর বোকা,বিলাইডা মইরা গ্যাছে না!’। মৃত্যুর সাথে জহির সাহেবের সেই প্রথম পরিচয়! সাথে সাথে মনের ভেতর তৈরী হল একটা ভয়,মায়ার সম্পর্ক চিরতরে ছিন্ন হওয়ার একটা ভয়! যদিও পরে অনেকেই তাঁকে বলেছিলেন যে মৃত্যর পরেও এক জগৎ আছে, কেউ বলেছিলেন জান ফিরে জন্মায়, কিন্তু তিনি বুঝে গিয়েছিলেন প্রত্যেক ক্ষত্রেই মায়ার এই ঊভয়মুখী সম্পর্ক ছিন্ন করতেই হয়।

বাইরের ঝুম বৃষ্টি নেমেছে, এদেশের বৃষ্টিতে আকাশ কালো মেঘে ছেয়ে যায় না, দিনের আলো কিছুটা থাকতেই ঝুম বৃষ্টি নেমেছে।আজ কি বার মনে করার চেষ্টা করলেন জহির সাহেব পারলেন না, এখন সময় দুপুর না বিকেল তাও জহির সাহেব ধরতে পারছেন না। তিনি যেন এক বিভ্রমের মধ্যে পড়েছেন, এই বিভ্রেমের মাঝেও একটা মায়া আছে, এই সুন্দর পৃথিবী নানান বিভ্রম তৈরী করে,তার পর মায়ায় জড়িয়ে ফেলে, আর যখন এই মায়ার সম্পর্ক ছিন্ন করার সময় হয়,তখন ভয় হয়, মনেহয় ভয়টা সেই আদি-অন্তহীন এক নিঃস্বতার।জহির সাহেব কাঁদছেন,তাঁর মাথায় একটা গান ঘুরছে ,
‘ও হো জীবন, জীবন রে,
ছেইড়ে যাসনে আমায়।
তুই জীবন ছাড়িয়া গেলে,
পাব কোথায় নতুন জীবন রে..’
এমন সময় একজন নার্স এসে জিজ্ঞেস করলেন "can you please confirm me your name sir?" জহির সাহেব কান্না জড়ানো কন্ঠে উত্তর দিলেন "Engineer Johir Ahmed " নার্স উত্তরে বললেন "very Good Mr.Ahmed, are you feeling any pain?" জহির সাহেব উত্তর দিলেন "yes! yes! I want to see my daughter”

মন্তব্য ২ টি রেটিং +১/-০

মন্তব্য (২) মন্তব্য লিখুন

১| ০২ রা ফেব্রুয়ারি, ২০১৬ রাত ১০:০৪

মনিরা সুলতানা বলেছেন: বেশ গোছানো এবং মন ছুঁয়ে যাওয়া লেখা
লেখায় ভালোলাগা ....

২| ০৯ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৬ রাত ১১:৪৫

পুলহ বলেছেন: গল্প যতই এগিয়েছে, ভালো লাগা তত বেড়েছে। শেষদিকটা খুব সুন্দর।
লেখকের জন্য শুভকামনা :)

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.