নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

\'আমাদের চাওয়া আর পাওয়ার মাঝখানে একটা দেয়াল আছে, এর একদিকে থাকে চাওয়া,আর একদিকে পাওয়া। মুখ্য সমস্যা হল দেয়ালটা স্বচ্ছ কাঁচের\'

যাযাবর জোনাকি

‘আমাদের চাওয়া আর পাওয়ার মাঝখানে একটা দেয়াল আছে, এর একদিকে থাকে চাওয়া,আর একদিকে পাওয়া। মুখ্য সমস্যা হল দেয়ালটা স্বচ্ছ কাঁচের’

যাযাবর জোনাকি › বিস্তারিত পোস্টঃ

ব্যবসা ( গল্প)

২৪ শে নভেম্বর, ২০১৮ রাত ৩:৩৩



১.
“ বারির সাহায্যে যথা গৃহ দহ্যমান
সযতনে গৃহিগণ কররে নির্বান
ধীর শাস্ত্রজ্ঞানী, বুদ্ধিমান বিচক্ষণ
তেমতি শোকেরে সদা করেন দমন।
বায়ুবেগে তুলারাশি উড়ি যথা যায়,
প্রজ্ঞাবলে শোক তথা শীঘ্র লয় পায়।
কর্ম্মবশে যাতায়াত করে জীবগণ ;
কেহ মরে, কেহ করে জনম- গ্রহণ।
এই মাতা, পিতা, এই সোদর আমার,
হেন জ্ঞানে সুখে মগ্ন নিখিল সংসার।”

আজ হাটবার। বিজু আজকে তার গরু গাড়িটি ফুলতলি হাটের বটগাছ তলায় লাগিয়েছে। সন্ধ্যা নেমেছে অনেক্ষণ হল, ক্ষিধে পেটে মোচড় দিয়ে জানান দিচ্ছে রাত বাড়তির দিকে। গৌরাঙ্গ সুর করে গাঁথা বলে চলেছে।বিজু এক মনে চোখ বন্ধ করে করতালে তাল দিচ্ছে, মাঝে মাঝে শ্রোতাদের গোনার চেষ্টা করছে। আজ শ্রোতাদের সংখ্যা মাত্র পাঁচজন। দেশ থেকে ভক্তিভাব কি সব উঠে যাচ্ছে নাকি! মনেমনে ভাবে বিজু। আজকে অমাবস্যা, একেবারে দম বন্ধ করা ভেপসা গরম পড়েছে। বৃষ্টির কোন নামগন্ধও নেই। এই বটতলায় মাঝেমাঝে যা একটু বাতাস ছাড়ছে। দূরে একটা বড়ই গাছে জোনাকিরা মেলা বসিয়েছে। সব দোকানিরা তাদের হিসাব মিলিয়ে, মালামাল গুটিয়ে ঝাপড়া বন্ধ করে হাটের রাস্তা ধরে ফিরতি পথে হাঁটা দিচ্ছে। কেউ যাচ্ছে বাড়ির দিকে কেউ, মদের ঠেকার দিকে। এদের মধ্যে একজনকে কে দেখা গেল একটা ছোট ছালা বগলদাবা করে এসে, গৌরাঙ্গর দিকে দুইবার প্রনাম ঠুকে বসলো গরুগাড়ির সামনে। এখন বিজুর মনে হচ্ছে কপাল কিছুটা খুলেছে।

বিজু বিহারী।গরিব ঘরের ছেলে। ছোটবেলা থেকে ইচ্ছা ছিল ব্যবসা করবে।কিন্তু টাকার অভাবে করতে পারেনি। অন্য কোন কাজও তার দ্বারা হয়ে ওঠেনি। বাপটা মরে যাওয়ার পর, এক গৃহস্থ বাড়িতে গোয়ালে কাজ পেয়েছিল, কিন্তু তার মহাজনি মেজাজের কারনে টিকতে পারেনি। বিজুর বয়স কত আর হবে দুইকুড়ি। দশ বছর আগে ঘুরতে ঘুরতে নদীয়ার এক গৌড় নিতাইয়ের আশ্রমে সে একরাতের জন্য আশ্রয় নিয়েছিল । বিজু গৌরাঙ্গ কে সেখানেই খুঁজে পায়। তখন গৌরাঙ্গের বয়স কত আর? সবে গোঁফের রেখা ফুটেছে । মাথা ভর্তি কোঁকড়ানো চুল। ফর্সা ধবধবে গায়ের রঙ। হাত নেই, পা নেই, চোখটাও বোজানো। ঠিক যেন সাদা ধবধবে একটা মাংস্পিন্ড যার শুধু মাথা আছে। জন্মের পর বিকলাঙ্গ শিশু দেখে, কেউ ফেলে রেখে গিয়েছিল গৌর নিতাইয়ের এই আশ্রমে। কিন্তু ভগবানের কি লীলা! এই ছেলের মাথা দিয়েছেন পরিস্কার। আশ্রমে থেকে রামায়ণ গাঁথা, মহাভারত, কীর্তন সবকিছু শুনে শুনে একেবারে মুখস্থ। আর কি মধুর মেয়েছেলের মত তার গলা! গোলাপি ঠোঁট দুইটি নেড়ে নেড়ে যখন গাঁথা পড়ে তখন সবাই একমনে শোনে। চোখ পানিতে ছলছল করে ওঠে সবার। সেই রাতে বিজুও শুনেছিল তার কীর্তন। শোনার পর বিজুর মনে একটা ফন্দি আসে। তার মনে হয় গৌরাঙ্গ একটা সোনার ডিম পাড়া হাঁস। রাত গভীর হলে, আশ্রমের সবাই যখন ঘুমিয়ে পড়ে তখন বিজু একটা ছালার বস্তায় গৌরাঙ্গকে ঢুকিয়ে নিয়ে আশ্রম ছেড়ে পালিয়ে যায়।

কুপির আলোটা নিভিয়ে, বটতলায় চুলো জ্বেলে, ভাতের হাড়ি চাপিয়ে দিল বিজু। ভাতের ভেতরেই মিষ্টি কুমড়া সিদ্ধ হচ্ছে। গাড়ির ভেতর থেকে দুইটা শুকনো লঙ্কা, মরিচ, পেয়াজ, নুন আর সরিষার তেলের শিশিটা নিয়ে চুলোর পাশে বসলো বিজু। গত দশ বছর ধরে এই গরুর গাড়ির ভেতরেই বিজুর সংসার।এই গাড়িতে করেই বিজু গৌরাঙ্গকে নিয়ে চলেছে গ্রাম থেকে গ্রামে, হাট থেকে হাটে। সন্ধ্যায় একটু জনবহুল জায়গা দেখে বিজু গাড়ি ভেড়ায়। তারপর কুপি বাতির আলোয় শুরু হয় গৌরাঙ্গর গাঁথা পাঠ,কীর্তন অথবা মহাভারত কথা। সাথে বিজু করতাল বাজায়। আজ মেজাজ ভালো নেই বিজুর। আজ নগদ লক্ষী মাত্র দু’আনা। আর আধা সের মোটা চাল, একটা মিষ্টি কুমড়া আর দুটি কাঁচা কলা দিয়েছে শ্রোতারা। আজ পর্যন্ত বিজু নগদ কামাই থেকে জমিয়েছে মোটে কুড়ি টাকা। এছাড়া গরু আর গাড়িটা তার সম্পদ। সে এটা চুরি করেছিল এক গ্রাম থেকে। এটা বেচে দিলে হয়তো আরও কিছু পয়সা পাবে। কিন্তু এই টাকা দিয়ে ব্যবসা হবেনা। প্রতিবছর বর্ষার সময় ধান্দায় ভাটা পড়ে। সে সময় একটা অসুখবিসুখ হলে একেবারে হাগার মত পয়সা বের হয়ে যায়। সামনে বর্ষা মৌসুম আসছে। বিজু মাথা চুল্কায়। গোঁফে একটা পাক দেয়। এই ধান্দা এভাবে চললে কতদিনে যে সে নিজের ব্যবসা শুরু করবে ভগবান জানে!
“ বিজুদা ”
“ হাঁ বল, ক্যায়া হুয়া? পেচ্ছাপ করবি ? রুক্কে রাখ থোড়া সা, হামি আসছে। ”
বিজু ভর্তার লঙ্কা, পেয়াজ, নুন, তেল মাড়াই করে থালা দিয়ে ঢেকে রেখে, গৌরাঙ্গ কে গরুরগাড়ির থেকে কোলে করে নামিয়ে নিয়ে ঝোপের দিকে যায়। এরপর উবু হয়ে বসে গৌরাঙ্গের লীঙ্গটা বাঁ হাতে একটু উঁচু করে ধরে। গৌরাঙ্গ পেচ্ছাব করতে থাকে৷ বিজু একপাশে মুখ ফিরিয়ে রাখে।

পানিতে ভালো করে হাত মুখ ধুয়ে বিজু খেতে বসে। মিষ্টি কুমড়ার ভর্তা আর ভাত। খেতে খেতে বিজু আবার মনে মনে হিসাব শুরু করে। দুইটা লোকের খাওয়া খরচ, নতুন চকচকে ধুতি, চন্দন, ধুপ, কুপির তেল অনেক খরচা। শ্রোতারা তো চাল, আলু, ডাল, লাউ, কুমড়া দিয়েই খালাস। আরে বাপু তেলটা তো কেও দেয় না, নগদ পয়সা লাগে কিনতে। নগদ পয়সা এত কম হলে চলবে কি করে? খাওয়া শেষ করে বিজু হাত ধোয়। তারপর গৌরাঙ্গের খাবার পাতে তুলতে থাকে। ঝামেলার কি আর শেষ আছে? এই গৌরাঙ্গকে খাওয়াও, হাগাও, মোতাও, চান করাও, দাঁড়ি কামিয়ে দাও!
“ ক্যায়া রে ঘুম আসি গেছে ক্যায়া? লে হাঁ ক্যার”
“ না, ক্ষিদে যা লেগেছে, কই দাও…”
২.
“..... তারপর তিনি দুইজনকে ধীরে ধীর নিজের স্বপ্নের কথা বলতে লাগলেন। স্বপনে তিনি প্রকৃতির বুকে কুন্তী আর মাদ্রীকে সম্ভোগ করার বর্ণনা দিলেন। মহারাজের উত্তেজক স্বপ্নের বর্ণনা শুনে কুন্তী আর মাদ্রী দুইজনেই যৌনউত্তেজিত হয়ে পড়ল। তারা মহারাজের চওড়া লোমশ বক্ষে নিজেদের কোমল ওষ্ঠের চুম্বন এঁকে দিতে লাগল। মহারাজা পান্ডুর লিঙ্গটিও সম্পূর্ণ ভাবে উত্তেজিত হয়ে দন্ডায়মান হল। সেটি তাঁর পোশাকের নিচে একটি পর্বতের সৃষ্টি করল। তা দেখে……”

আজকে শ্রোতা একটু বেশি। ছেলে বুড়ো সব মিলে জনা পনের হবে। বিজুর আজকে কাজ নেই। আজ মহাভরতের গপ্পো হচ্ছে। বিজু দূরে একাটা নারিকেল গাছে গা এলিয়ে দিয়ে কল্কেতে একটা টান দিল। নাক মুখ দিয়ে ভরভর করে ধুয়া ছেড়ে, গলা মোটা করে নিজে নিজেই বলল, “ হর হর মহাদেব!” আকাশে একটু মেঘ করে এসেছে, মেঘলা বাতাস বইছে। সারা রাজ্যের সুখ বিজুর গায়ে এসে ভর করলো যেন। মাথাটা বন বন করছে। এই সময় হঠাৎ তার শরীরে কামের বান ডাকলো। সে আজ সকালে সদাই করতে গিয়ে শুনেছে এই বাজারের শেষের দিকে জামিলা সুন্দরী নামে নতুন নটী এসে ঘর তুলেছে। তার সেখানে যেতে ইচ্ছা করে। সে লোলুপ দৃষ্টিতে গল্পে মুগ্ধ শ্রোতাদের দিকে তাকায়, তারপর কল্কেতে আবার লম্বা টান দিয়ে বলে উঠে,
“ বম ভোলে!”
৩.
কাল রাতে বর্ষা নেমেছে ঢেলে। আজকে প্যাঁচ প্যাঁচে কাদা আর মাথার অপর ঘাম ঝড়ানো রোদ। গরুর গাড়িটা নদীর ধারে আটকে গেছে। তাই বাধ্য হয়ে ওখানেই আস্তানা। বিজু সদাই করে ফিরছে তার গাড়ির দিকে। এখানে হাটটা একেবারে নদীর ধারে। রোদে ঘেমে নেয়ে একেবারে একাকার অবস্থায় বিজু হঠাৎ গাছ তলায় একটা ভীড় দেখে থমকে দাঁড়ায়। একটু কাছে যেতে সে ব্যাপারটা ভালো করে লক্ষ করে। একটা লোকের মাথায় সাদা পাগড়ী, হাতে লাঠির ওপর একটা টিয়া পাখি।লোকটার সামনে অনেক গুলি ভাঁজ করা কাগজ। সামনে ভীড় করা লোকগুলি এক আনা পয়সা করে দিচ্ছে পাগড়ীওয়ালার হাতে। পাগড়ীওয়ালা টিয়া পাখিটাকে নামিয়ে দিচ্ছে সামনে ভাঁজ করে রাখা কাগজের দিকে৷ ওর মধ্যে থেকে টিয়া পাখি একটা ভাঁজ করা কাগজ ঠোটে করে নিয়ে উড়ে গিয়ে লাঠির ওপর বসছে। পাগড়ীওয়ালা সেই কাগজ খুলে খদ্দেরের ভাগ্য পড়ে শুনাচ্ছে। বিজুর চোখ চকচক করে ওঠে। সে তাড়াতাড়ি করে নদীর ধারে গিয়ে কাঁদায় আটকানো গাড়িটা টেনে তোলে। তারপর গৌরাঙ্গকে চান করিয়ে, নিজে চান করে, দুপুরের খাবার খেয়ে অধীর আগ্রহে সন্ধার অপেক্ষা করতে থাকে। বিকাল গড়িয়ে সন্ধ্যা হলে সে এগিয়ে যায় ওই গাছ তলার দিকে। বিজু পাগড়ীওয়ালাকে দেখতে পায় তার তল্পিতল্পা গুটাতে। বিজু তার টাকা-পয়সার থলিটা হাতে নিয়ে বাজিয়ে আত্মবিশ্বাস বৃদ্ধি করে নেয়। তারপর পাগড়ীওয়ালার সাথে দেনদরবার করতে বসে। অনেক দরকষাকষি করে শেষমেশ বিজু নগদ আট টাকায় ভাগ্য লেখা কাগজ সহ ওই টিয়া পাখিটা কিনে বিজয়ীর বেশে তার গাড়ির কাছে ফিরে আসে।
“ আজকে তো বৃষ্টি নেই, বিজুদা আজ কীর্তন হবে না?”
“ না, তুই সুয়ে থাক।”
“ তুমি কি টিয়া পাখি কিনেছ? ডাক শুনলাম?”
“ নেহি রে, ও গাছে আছে।”
“ কিন্তু সকালে তো ছিলো না?”
“ তাং মাত কার..”
বিজু গাড়ি থেকে নেমে গিয়ে নদীর ধারে বসলো। বেশ কয়েকদিন বর্ষার জন্য তার ধান্দা বন্ধ ছিল।তারমধ্যে গৌরাঙ্গের জ্বর ধরেছে। সে এক দৃষ্টিতে নদীর পানির দিকে চেয়ে থাকলো। কালো পানি মাঝখানে থেকে থেকে পাক খাচ্ছে। হঠাৎ তার কি মনে হল সে মাটির একটা বড় দলা তুলে নদীর মাঝখানে ছুড়ে দিল। নিমিষেই মাটির দলাটি নদীর স্রোতে বিলীন হয়ে গেল।
রাতে ভাত চুলোয় চাপিয়ে দিয়ে, বিজু গুন গুন করে কোন বিহারী গানের সুর ভাঁজছিল। আজ আকাশে মেঘ নেই। কাঁসার থালার মত পূর্নিমার চাঁদ উঠেছে। চারিদেকে ঝিঁঝিঁ পোকা আর ব্যাঙের ডাক ছাড়া আর কিছুই শোনা যাচ্ছেনা। হাটের লোকজনও সব যে যার মত চলে গেছে। বিজু কল্কেতে দুইবার টান দিলো।
“ বিজুদা।”
“ পেচ্চাপ?”
“ পেটের ভিতর মোচড় দিচ্ছে , মাথা যন্ত্রণায় ছিঁড়ে যাচ্ছে গো।”
“ চল হাগবি, একবার হেগে এলেই দেখবি মাথা ঠান্ডা, জ্বর ভি নেমে যাবে।”
বিজু গৌরাঙ্গকে কোলে করে নিয়ে নদীর দিকে নেমে গেল। অনেক্ষণ চারিদিকে ঝিঁঝিঁ পোকা আর ব্যাঙের ডাক ছাড়া কিছুই শোনা গেল না। শুধু দুইবার গাড়ির মধ্যে থেকে টিয়া পাখিটা ডেকে উঠলো আচমকা। বেশ কিছুক্ষন পর বিজু ভিজে গায়ে গরুগাড়ির কাছে ফিরে এসে গা মুছতে লাগলো। চুলোয় ভাত মনেহয় হয়ে এসেছে।



মন্তব্য ৩ টি রেটিং +১/-০

মন্তব্য (৩) মন্তব্য লিখুন

১| ২৪ শে নভেম্বর, ২০১৮ রাত ৩:৩৭

স্বপ্নের শঙ্খচিল বলেছেন: নিমিষেই মাটির দলাটি নদীর স্রোতে বিলীন হয়ে গেল।
....................... এভাবে মানুষের মনও হারায়ে যায় ।

২| ২৪ শে নভেম্বর, ২০১৮ সকাল ১০:১১

আহমেদ জী এস বলেছেন: যাযাবর জোনাকি,




চমৎকার ঝরঝরে একটি গল্প এবং মর্মান্তিক ও ।

৩| ২৪ শে নভেম্বর, ২০১৮ সকাল ১১:৩৯

রাজীব নুর বলেছেন: সত্য কথা বলি উপরের কবিতাটা কিছুই বুঝি নি।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.