নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

\'আমাদের চাওয়া আর পাওয়ার মাঝখানে একটা দেয়াল আছে, এর একদিকে থাকে চাওয়া,আর একদিকে পাওয়া। মুখ্য সমস্যা হল দেয়ালটা স্বচ্ছ কাঁচের\'

যাযাবর জোনাকি

‘আমাদের চাওয়া আর পাওয়ার মাঝখানে একটা দেয়াল আছে, এর একদিকে থাকে চাওয়া,আর একদিকে পাওয়া। মুখ্য সমস্যা হল দেয়ালটা স্বচ্ছ কাঁচের’

যাযাবর জোনাকি › বিস্তারিত পোস্টঃ

ডালিমকুমারের চুপকথা

০২ রা এপ্রিল, ২০১৯ সন্ধ্যা ৬:০৩


০২/০৪/২০১৯; বিকাল ৪:৪৫;
#WorldAutismAwarenessDay
মামা:
জীবনে প্রথমবারের মত মামা হওয়াটা একটু অন্যরকম ব্যাপার। এর সাথে একটা অচেনা আনন্দ এবং বিষ্ময় মেশানো থাকে। প্রথম মামা হতে কেমন লাগে এটা আসলে কমবেশি সবাই জানেন। আমিও একদিন দৈনিকের ক্লান্তিকর কাজ আর সারাদিনের উৎকন্ঠা নিয়ে বাসায় এসে ফেসবুকে ছবি দেখতে পেলাম পাতলা শাড়ির কাপড়ে পেচানো সাদা ভেটভেটা একটা বাচ্চা। আমার প্রথম ভাগ্নে। ছবির দিকে তাকিয়ে হাসতে হাসতে ভাবলাম, যাক চাঁদ আর সূর্যের মত আমিও এখন মামা হয়ে গেলাম।

ডালিমকুমার:
ওর মা শখ করে ওর নাম রাখে আহ্নাফ। আর নানা আদর করে ডাকে "ডালিমকুমার"। “ ডালিমকুমার ডালিম খায় হাতিতে চড়ে শিকারে যায়” নানার কথা বুঝুক না বুঝুক ডালিমকুমার হাসে, ফিকফিক করে হাসে। সারাদিন মা, বাবা, নানা, নানির আদরের কেন্দ্রবিন্দু ডালিমকুমার। আমি বাড়ির ছোট ছেলে হওয়ায় ক্ষনিকটা ঈর্ষা হত। মনে হত আমার জায়গাটা বহুদিন পর কেউ ফাঁকা পেয়ে, এসে দখল করে নিয়েছে। মাঝেমধ্যে ব্যপারটা ভালো লাগতো, অনেকটা রাজ্য হস্তান্তরের মত মনে হত। নিজের ভিতর ভিতর একটা গর্ব হত৷

কমলা এবং কালো বিড়াল :
ডালিমকুমার আস্তে আস্তে তার সাথে পোষা কমলা আর কালো বিড়ালগুলোর মতই বড় হতে শুরু করলো। সারা বাড়ি প্লাস্টিক আর রাবারের খেলনার গন্ধে ভরে উঠতে লাগলো। ডালিমকুমার হামাগুড়ি দেয়া শিখলো। কিন্তু নির্দিষ্ট কিছু লোকজন ছাড়া কারো কোল থেকে নামতে চাইতো না সে। অন্য অপরিচিত লোক দেখলেই ভয়ংকর কান্না শুরু করতো। সবাই লক্ষ্য করলো বাচ্চাটা একটু বেশি স্পর্শকাতর। এই ব্যাপারটা নিয়ে সবচেয়ে বেশি সচেতন থাকতো ওর মা। সচরাচর কাউকে তার বাচ্চা দিত না। ডালিমকুমার অল্প কিছু সময় ছাড়া সবসময় কোলে চড়েই থাকতো।কারো কাছে যেত না। খুবই বেশী স্পর্শকাতরতার ব্যপারটা বিরক্তিকর হলেও কেউ তেমন পাত্তা দিলো না।

আবদার:
আস্তে-ধীরে একটা সময় এলো যখন কমলা আর কালো বিড়ালগুলো এত বড় হল যে, খাবার ঘরের পাশে পাঁচিলের ওপর উঠে লেজ নেড়ে নিজেদের আবদার জানাতে শুরু করলো। ডালিমকুমারের আশেপাশের মানুষগুলোও তাদের আবদার সময়মত বুঝে নিতে চাইলো ঠিকই,
" বলতো বাবা, মা বল... মা! "
" কে এটা বাবা? বাবা? বাবা.. "
" বল নানা বল ভাইয়া.. নানা!"
ডালিমকুমার কিন্তু কথা বলে না, বলার চেষ্টাও করে না। আসলে সে কারও কথা শোনেই না যেন! সে কারও চোখের দিকে তাকায় না। তার দৃষ্টি আকর্ষণ করাটা একটা দুরহ ব্যাপার হয়ে দাঁড়ালো যেন। সমস্যাটা আরও প্রতিযোগিতায় পরিনত হল, যখন ডালিমকুমারের সাথে রাজ্যের তুলনা করা শুরু হল। রাজ্য চটপট করে কথা বলা শুরু করে দিয়েছে। ডালিমকুমার যেন রাজ্যের কাছে পরাজিত এক রাজকুমার। অনেকেই স্বান্তনা দেয়ার জন্য বলতে লাগলো “অনেক বাচ্চা দেরীতে কথা শেখে গো।” “অনেকে তো পাঁচ বছর বয়েসে কথা বলা শিখেছে, হ্যা এইতো আইন্সটাইন! সে পাঁচ বছর বয়স পর্যন্ত কোন কথা বলতে পারতো না।” কিন্তু ডালিমকুমারের আড়ালে কাজের লোকেরা বলতো “ছেলেটা কালা!”

কানাঘুঁষা:
রাজ্যের দুষ্টু দুষ্টু কথা, ওর গুট গুট করে দৌড় দেয়া, খেলনা দিয়ে খেলা নিয়ে যখন সবাই মাত হয়েগেছে তখন ডালিমকুমার পরিনত হয়েছে এক কানাঘুঁষার বিষয়ে।
" ছেলেটা তো মা বলেও ডাকতে পারে না।"
" হুম, অন্য কারো কোলে যায় না, কেমন পাগল পাগল !"
" না, না, কালা বাচ্চা শুনতে পায় না, কথা বলবে কী?"
দেখাগেল ইতিমধ্যে অনেকেই তার সাথে হাত-মুখের ইশারায় কথা শুরু করে দিয়েছে।

সারিবদ্ধ রুপকথার দেশ :
ডালিমকুমারের সে সবে কিচ্ছু এসে যায় না। সে নানার বলা ছড়া শুনে খিলখিল করে হাসে।শীতের রোদে নানীর কাছে তেল মালিশ নেয়। কোন কিছু ঘুরতে থাকলে অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে, হাত দিয়ে ঘোরানোর চেষ্টা করে,আর গভীর মনযোগ দিয়ে তার সব খেলনাগুলোকে খুবই সুন্দর করে সারিবদ্ধভাবে সাজায়। সে যেন তার নিজের রুপকথার দেশে হারিয়েছে, তার আর ফিরতে ইচ্ছা করে না।এদিকে খেলনা একটা এদিক থেকে ওদিক হলেই গগনবিদারী কান্না! দুশ্চিন্ত বাবা ইন্টারনেটে “এবনরমাল চাইল্ড বিহ্যাবিওর" নিয়ে পড়াশোনা শুরু করে দিয়েছে। অনলাইন বিভিন্ন টেষ্ট দিচ্ছে। মা ছুটে চলেছে বিভিন্ন ডাক্তারের কাছে। কোন ডাক্তার বলছে,
" যে বাচ্চা যত তাড়াতাড়ি কথা শেখে তারা তত বুদ্ধিমান "
কেউ বলছে গম্ভীর হয়ে বলছে,
" মনেহয় তর শ্রবণশক্তির সমস্যা, ওর মস্তিষ্কের স্নায়ুকোষ শব্দে সাড়া দেয় না।"
কেউ ধমক দিয়ে বলছে,
" আপনার বাচ্চাতো বুদ্ধি প্রতিবন্ধী! "
প্রতিদিন শত শত সিদ্ধান্ত আর সম্ভাবনার তীরে জড়-জড়িত মা দিন শেষে অপবাদের রক্তে রক্তাক্ত হয়ে কাঁদে। হ্যা আমাদের সমাজে সন্তানের সব অনিষ্টের দায় মা কেই নিতে হয়। রক্তাক্ত তাদের হতেই হয়।

পক্ষীরাজ ঘোড়ায় ডালিমকুমার :
আমাদের শহরে একটা সংস্কার বা কুসংস্কার আছে যে, ইন্ডিয়া গেলে যত বড় অসুখই হোক না কেন তা সেরে যায়। সাবাই ডালিমকুমার কে ইন্ডিয়া পাঠাতে পরামর্শ দিল। কিন্তু কারো কথা না শুনে ডালিমকুমার জীবনের প্রথম পক্ষীরাজ ঘোড়ায় চেপে মা-বাবা কে নিয়ে মামার বাড়ি চলে এল। সেখানে গিয়ে ডালিমকুমারের দেশটা একদম পছন্দ হল না। সারাক্ষণ শুধু চিৎকার করে কান্না! কেন সে তার আপন ভুবন ছেড়ে চলে এলো? নতুন দেশে তার এটা ওটা সেটা পরীক্ষা করানো হল। একটা দুইটা তিনটা ডাক্তার দেখানো হলো। সবাই তাকে একটা নতুন নাম দিল "অটিস্টিক"। মডারেট অটিজম। স্বপ্নের মত সুন্দর দেশটাতে ডালিমকুমারের তো আগেই ভালো লাগেনি, এবার তার বাবা মারও প্রতিটা মূহুর্ত বিষাক্ত আর অভিশপ্ত মনে হতে লাগলো।

ভুল ঠিকানা :
দেশে ফিরে বাবা শুরু করলো আবার পড়াশোনা। কি করা যাবে আর কি করা যাবে না। মা খুঁজতে শুরু করলো ডাক্তারের কথা মত স্পেশাল স্কুল আর থেরাপি। ছোট্টো শহরে এইসব কিছুই নেই।শেষে নানার পরামর্শে একটা প্রতিবন্ধী স্কুলে ডালিমকুমারকে নানার কিনে দেয়া স্কুল ব্যাগ কাঁধে, জোড় করে নিয়ে গেল তার মা। ডালিমকুমারের কিছুতেই নতুন স্কুল পছন্দ হলো না। সে যথারীতি কান্না জুড়ে দিলো। আর তার মা, অন্য বাচ্চাগুলিকে দেখে কাঁদতে কাঁদতে বের হয়ে চলে গেল নিজের কাজে। সপ্তাহে দুইবার, কখনো একবার শহর থেকে অনেক দূরে নামকাওয়াস্তে একটা থেরাপি সেন্টারে নিয়ে যাওয়া হল ডালিমকুমার কে। সেখানে থেরাপির চেয়ে ধমকা ধমকি বেশি হত। পশুর গায়ের লোম পরিস্কার করার মত করে, দায়সারা ভাবে ডালিমকুমারের গায়ে ব্রাশ বোলানো হত। এভাবেই জোরজবরদস্তি করে কিছুদিন চলার পর,ঐ প্রতিবন্ধী স্কুলের শিক্ষক ডালিমকুমারের মাকে ডেকে বললেন, যে ডালিমকুমার তো প্রতিবন্ধী না। ও এখানে খাপখাওয়াতে পারছেনা ওর কষ্ট হচ্ছে। এর চেয়ে ওর মত শিশুদের জন্য নতুন একটা স্কুল খোলা হয়েছে সেখানে নিয়ে গেলে ওর জন্য ভালো হবে।

মা-মা, মামা:
বাবা-মার কাছে সবচেয়ে বড় অভিশাপ মনে হয় সন্তানের কাছে থেকে "মা", "বাবা" ডাক না শুনতে পাওয়া। ঈশ্বরকে ধন্যবাদ যেসব বাবা মাকে তিনি এই অভিশাপে অভিশপ্ত করেননি অথবা এই আশীর্বাদ থেকে বঞ্চিত করেননি। একদিন সন্ধ্যার কথা, ছুটিতে বাসায় গিয়েছি। আত্মীয় স্বজন সবাই এসেছেন বাসায়। পারিবারিক অনুষ্ঠান চলছে। আমার বড়ফুপু এসেছেন তাঁর নাতি-নাতনিদের নিয়ে। সবাই প্রায় একই বয়েসের বাচ্চা। সবার খুব শখ ডালিমকুমারের সাথে খেলবে। তার খেলনা দিয়ে খেলবে। বাসা বাচ্চাদের কিচিরমিচিরে মুখরিত। এমন সময় হঠাৎ ডালিমকুমার তার চিরাচরিত কান্নায় চিৎকার করে উঠলো। তার মা সবকিছু ফেলে দিয়ে ছুটে গেল ডালিম কুমারের কাছে। আমি পিছে পিছে গেলাম। ঘটনা কিছুই না। অন্যবাচ্চারা ডালিমকুমারের খেলনা দখল করেছে। তাই ডালিমকুমার চিৎকার করে কাঁদছে। আমার ফুপু তাকে বোঝানোর চেষ্টা করছে, ভাইয়া-আপু তো। একসাথে খেলো সবাই। ডালিমকুমার কিছুই বোঝেনা শুধু চিৎকার করে কাঁদে। ওর মা এসে তাড়াতাড়ি করে ওকে বুকে আড়াল করে নিয়ে বাইরে হারিয়ে গেল, এমনভাবে যেন সবার সামনে থেকে কোন কলঙ্ক লুকাতে চাইছে। বাচ্চাদের আর খেলা হল না। আমার ফুপু বাকি বাচ্চাদেরকে আগলে ঘর থেকে বাইরে নিয়ে যাচ্ছে। সবার মধ্যে বড় বাচ্চাটা ফুপুকে জিজ্ঞাসা করছে,
" আহ্নাফ এইরকম কেন? ও কাঁদছে কেন? ও আমাদের সাথে খেলবেনা? " উত্তরে আমার ফুপু বললেন,
" না সোনা, আহ্নাফের অসুখ, ও খেলবেনা।"
" ওর কি অসুখ হয়েছে? ও ঔষধ খায় না? "
" আহ্নাফ প্রতিবন্ধী বাবা, ও কারও সাথে খেলে না।"
কথাগুলো ঘরের এককোনায় দাঁড়িয়ে শুনছিলাম চুপচাপ, চোখের পানি আটকে রাখতে পারলামনা! শুনেছি বাংলায় "মামা" শব্দটা এসেছে মা শব্দটার দুইবার উচ্চারণ থেকে, কথায় বলে মায়ের চেয়ে মামার ভালোবাসার টান নাকি বেশি থাকে কোথাও। তাই মা-মা দুইবার উচ্চারণ করা হয়। ক্ষনিকের জন্য উপলব্ধি করলাম টানটা আসলেই অজানা কোথাও থাকে। এত দিন টের পাইনি।

ডালিমকুমারের রাজ্য:
ডালিমকুমারের জন্য রাজ্য তো ছিলোই আগে থেকেই। বড় হওয়ার সাথে সাথে ডালিমকুমারের রাজ্য আর রাজ্যের ডালিমকুমার। একসাথে অনর্থক খেলা, হৈচৈ করা, খেলনা অদলবদল, জামা কাপড় অদলবদল , মনকষাকষি, বেড়াতে যাওয়ার সময় জুতো পড়িয়ে দেয়া এইসব কিছু বয়সে ক্ষানিকটা ছোট হলেও বাবার দেখাদেখি বেশ গুরুত্বের সাথে রাজ্য যেন ভাত্রিসুলভ আচরণেই করে দিত ডালিমকুমারের জন্য। এতদিনে ডালিমকুমার যেন একজন খেলার সাথী পেয়েছে। বিশ্বস্ত একজন। একেবারে বিশ্বস্ত হাতেগোনা কয়েকজনের মতই। খলতে খেলতে কিছুক্ষন পর পর তোতা পাখির মত ডাকে " রাজ্য, রাজ্য!"। রাজ্য কে মারলেও বলে " সরি রাজ্য, রাজ্য সরি! " মার খেলেও বলে " সরি রাজ্য, রাজ্য সরি!"

প্রয়াস:
ডালিমকুমার একসময় এলো তার ভাগ্য নির্ধারিত একটা যাদুর স্কুলে যেখানে সবাই তার মত ডালিমকুমার৷ সেখানে আছে নানান রকম খেলনা যেগুলো বাসায় নেই। আর আছে যাদুকর বন্ধু। যারা ডালিমকুমারদের খুবই ভালোবাসে। শেখায় নানান রকম যাদু। সেসব যাদু আস্তে আস্তে শিখতে শুরু করে ডালিমকুমার। যাদুর স্কুল থেকে বাসায় এসেও ডালিমকুমার সেইসব যাদু আওড়াতে থাকে নিজ মনে। এভাবেই বাবা,মা আর সেইসব যাদুকর বন্ধুদের প্রয়াসে, ডালিমকুমার শিখে ফেলে নানান রকম যাদু! যে সব যাদু বলে একটু একটু করে ডালিমকুমারের সেই রুপকথার দেশ থেকে চাইলেই সে বের হয়ে আসতে পারে আমাদের এই পৃথিবীতে।

কমলা বাই-সাইকেল ও পুরানো রুপকথার দেশ:
সেই ছোট্ট ডালিমকুমার এখন অনেক বড় যাদুকর। সে যাদুবলে বাবা, মা, বোন, রাজ্য, মামা, মামী আর সবার নাম বলতে পারে৷ ছবি আঁকতে পারে, একা একা পড়তে পারে,একা একা বাসে করে যাদুর স্কুলে যায়৷ ভালোবাসে কবিতা বলতে। একা একা আবৃত্তি করে পুরা "সোনার তরী"। মিষ্টি কন্ঠে দুপুরবেলা সবাই ঘুমিয়ে গেলে একা একা গান করে " আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি.. " পুরা গানটা। সেদিন ২১শে ফেব্রুয়ারিতে অংকন প্রতিযোগিতায় ডালিমকুমার ৩য় হয়েছে। অন্য বাচ্চা হলে হয়তো খবরটা আগেই জানতে পারতাম।কিন্তু ডালিমকুমার জন্য জানলাম অনেক পরে। গর্বে বুকটা ভরে গেল। নিজের কমলা বাই-সাইকেলটা ডালিমকুমারের খুবই প্রিয়, সে বাই-সাইকেল চালায় আবার সাইকেল উল্টো করে হাত দিয়ে সেটার চাকা ঘুরাতে ঘুরাতে মাঝেমধ্যে হারিয়ে যায় তার পুরানো রুপকথার দেশে।

রাজ্যের নতুন স্কুল :
সময়মত রাজ্য ভর্তি হয়েছে শহরের নামকরা একটা স্কুলে। রাজ্য খুবই খুশি। বাবা-মার সাথে বাজারে গেছে বই, খাতা, পেন্সিল আর স্কুল ড্রেস কিনতে। হঠাৎ রাজ্য দেখতে পায় ডালিমকুমার তার মায়ের হাত ধরে বাজারে ঢুকছে।
“আহ্নাফ!” চিৎকার করে ডাকে রাজ্য।
পরদিন স্কুলে ঢোকার সময় রাজ্য তার বাবাকে জিজ্ঞাসা করে,
“বাবা, আহ্নাফ আমার সাথে এই স্কুলে ভর্তি হবেনা?”
প্রশ্নটা অনেক কঠিন একটা প্রশ্ন। রাজ্যের বাবা কোন উত্তর দিতে পারে না। আসলে বোধকরি এই উত্তর কেউই দিতে পারবেনা।

জেনেটিক ডিজঅর্ডার :
দেড় বছর আগে আমার নিজের একটা মেয়ে হয়েছে। মিথ্যা কথা বলবো না, আমার স্ত্রী গর্ভধারণ করার পর থেকে আমি নিজেও খুব ভয়ে ছিলাম। বুদ্ধি প্রতিবন্ধী, প্রতিবন্ধী, অটিস্টিক, নিউরোলজিকাল ডিজঅর্ডার, জেনিটিক ডিসঅর্ডারের মত নিষ্ঠুর শব্দ গুলির সাথে চার বছরের একটা অসুস্থ সম্পর্ক থাকার কারনে। শুধুই অসহায় হয়ে ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করতাম। ইচ্ছা ছিলো যাইহোক ১৮ মাস বয়সে সন্তানের এই মেডিকেল টেস্ট করাবো।মেয়ের বয়েস এক বছর যেতেই দেখা হলেই আত্মীয় স্বজনের প্রথম প্রশ্ন " কথা বলতে পারে?", "ডাকলে সাড়া দেয়তো ?" "চোখের দিকে তাকায়?" " ডাক্তার দেখিয়েছো?" কোন উত্তর দেই না। শুধু ঠোঁটে একটা ফাঁকি হাসি রাখি। এখন আমার মেয়ে তার বড় ভাই ডালিমকুমারকে ডাকে " আইনাপ বাইয়া!" আর ডালিমকুমার আমার মত গলা মোটা করে বলে, “এই ঊর্জ্জা, এই ঊর্জ্জা!”

প্রদীপের নিচে অন্ধকার এবং একটি বিচ্ছিন্ন গল্প:
আজকে #world_autism_day. এখন পোষ্টার হচ্ছে, প্রচার হচ্ছে, #autism_spectrum_disorder_(ASD) এটা কোনরকম প্রতিবন্ধকতা বা অসুখ না। এটা জেনেটিক ডিজঅর্ডার বা নিউরোলোজিকাল ডিজঅর্ডার। এটাকে প্রতিবন্ধকতা বলা যাবে না। এটা একটা উপহার। এখন অনেক স্কুল হচ্ছে দেশের আনাচেকানাচে। স্পেশাল কেয়ার সেন্টার হচ্ছে। কিছুদিন আগেই আমার স্ত্রী নিজে নেপালে একটি স্কুল পরিদর্শন করে এলো। এই আমাদের দেশের এইসব স্কুল গুলিতে সরকারিভাবে অনেক উন্নতমানের বই, শিক্ষক প্রশিক্ষণ,সুযোগ সুবিধা, বিশেষ ধরনের উপকরণ সামগ্রী ইত্যাদি দেয়া হচ্ছে। এছাড়াও অনেক দেশি-বিদেশি প্রযুক্তি কোম্পানিগুলো বিনামূল্যে নানান রকম প্রযুক্তিগত সহায়তা দিয়ে আসছে, বাচ্চাদের প্রশিক্ষণের জন্য। ভালো লাগছে। কিছুদিন আগে দেখলাম 'স্টেম সেল' নামক এক জটিল এবং আমাদের কাছে প্রায় অবোধ্য প্রক্রিয়ার মাধ্যমে অটিস্টিকদের থেরাপি দেয়া হচ্ছে। এই সবই আশার কথা। এইগুলো শুনলে মা, মা-মা আশাবাদী হই। কিন্তু এত কিছুর পরও দিন শেষে অপবাদের বিষাক্ত তীর কিন্তু মা'ই বুকে আগলে নেয়। "আমার সন্তান অটিস্টিক!" পৃথিবীর এই সকল সাহসী মায়েদের জানাই করজোড়ে প্রনাম এবং শ্রদ্ধা এইভাবে নিরলস যুদ্ধ করে যাবার জন্য। এই যুদ্ধ জয়ী হওয়ার না, প্রতিদিন লড়াইটা চালিয়ে যাবার!

এটি বিচ্ছিন্ন গল্প,এ কান থেকে ও কান থেকে শোনা। একদিন ডালিমকুমারের বাবা ডালিমকুমারকে সাঁতার কাটতে নিয়ে গেছে পুকুরে, ডালিমকুমার শক্ত করে বাবার হাত ধরে পা দুটোকে নাড়িয়ে চলেছে সাঁতার কাটার ভঙ্গিতে। এমন সময় কেন জানি ডালিমকুমারের বাবার মনে হয়, " ইস! এখন যদি হাতটা ছেড়ে দিতে পারতাম, তাহলে সকল মানসিক যন্ত্রণা, গ্লানিবোধ, সামাজিক অপমান, অপবাদ থেকে নিমিষেই মুক্তি পেয়ে যাতাম!" এই চিন্তা করে বাবা আৎকে ডালিমকুমারকে বুকে জড়িয়ে ধরে পুকুর থেকে উঠে আসে। ডালিমকুমার খিলখিল করে হাসতে থাকে ফেরেস্তাদের মত। যদিও কেউ কখনও ফেরেস্তাদের দেখেনি। আচ্ছা তাঁরা কি দেখতে এই ডালিম কুমারদের মত হয়?

-যাযাবর জোনাকি
[ আমার ডালিমকুমারের জন্য দোয়া করবেন।]

মন্তব্য ৫ টি রেটিং +৩/-০

মন্তব্য (৫) মন্তব্য লিখুন

১| ০২ রা এপ্রিল, ২০১৯ সন্ধ্যা ৭:০৯

করুণাধারা বলেছেন: ডালিম কুমার এর জন্য দোয়া রইল- সমস্ত প্রতিবন্ধকতাকে কাটিয়ে, মানুষের ভালোবাসা পেয়ে, তার যেন একটা সুন্দর জীবন হয়।

খুব কষ্ট পেলাম পড়ে। আপনি লিখেছেন খুব ভালো করে। সত্যিই অটিজম আক্রান্ত শিশুর মায়ের যন্ত্রণা অন্য কেউ বোঝে না। আশার কথা এটাই যে আস্তে আস্তে মানুষ অটিজম আক্রান্তদের প্রতি সহায়তার হাত বাড়িয়ে দিচ্ছে।

আগে জানার উপায় ছিল না, কিন্তু এখন তো জেনেটিক ডিজ অর্ডারগুলো জানার উপায় আছে। আমার মনে হয় প্রত্যেকেরই সেটা জেনে রাখা উচিত এবং বৈবাহিক সম্পর্ক গড়ার আগে সেটা যাচাই করা উচিত। আমার এক আত্মীয়ের সন্তান হয়েছিল একটা জেনেটিক ডিসঅর্ডার নিয়ে। এই ডিজঅর্ডার হয়, বাবা মা দুজনেই যদি এই জিনের ক্যারিয়ার হয় তাহলে। এর চান্স প্রতি লক্ষতে ৭০ জন, খুবই কম। অথচ তারা দুজনেই এই জিন বহন করছিল, জানত না। ফলে বাচ্চাটা ডিজ অর্ডার নিয়ে জন্মালো, অসহ্য কষ্ট পেয়ে কয়েক মাস পর মারা গেল.....

পৃথিবীর সকল বাচ্চা সুস্থভাবে জন্মাক........

২| ০২ রা এপ্রিল, ২০১৯ সন্ধ্যা ৭:২১

ভুয়া মফিজ বলেছেন: সুস্থ শিশু.....সেই সাথে বড়দের মন-মানসিকতাও সুস্থ হোক।

৩| ০২ রা এপ্রিল, ২০১৯ রাত ৯:০৮

হাবিব বলেছেন: ভালো থাকুক ডালিম কুমার, দোয়া করি।

৪| ০৩ রা এপ্রিল, ২০১৯ রাত ১:২৪

অন্তরা রহমান বলেছেন: A brilliant piece of writing with loads of information and very personal viewpoint. ডালিমকুমারের জন্য হৃদয়ের গভীর থেকে আসা আদর আর ভালোবাসা। পৃথিবীর সকল ডালিমকুমারেরা ভালো থাকুক।

৫| ০৩ রা এপ্রিল, ২০১৯ সকাল ৭:০২

রাজীব নুর বলেছেন: ছট বেলায় কত ডালিম কুমারের গল্প শুনেছি!!!

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.