নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

\'আমাদের চাওয়া আর পাওয়ার মাঝখানে একটা দেয়াল আছে, এর একদিকে থাকে চাওয়া,আর একদিকে পাওয়া। মুখ্য সমস্যা হল দেয়ালটা স্বচ্ছ কাঁচের\'

যাযাবর জোনাকি

‘আমাদের চাওয়া আর পাওয়ার মাঝখানে একটা দেয়াল আছে, এর একদিকে থাকে চাওয়া,আর একদিকে পাওয়া। মুখ্য সমস্যা হল দেয়ালটা স্বচ্ছ কাঁচের’

যাযাবর জোনাকি › বিস্তারিত পোস্টঃ

A True Revolutionary Communist :কমরেড নলিনী দাস

১৭ ই জানুয়ারি, ২০২০ রাত ২:১৭


আজকের সময়টা অনেক কলুষিত।যখন গণতন্ত্র দেশ শাসনের ব্যাপারে অকৃতকার্য। আর্থ-সামাজিক ব্যাবস্থা দূর্নীতির সংক্রমণে পচেগলে যাচ্ছে। রাজনীতি শুধুমাত্র ক্ষমতাগ্রাসী এবং সুবিধাবাদীদের নতুন ব্যবসায় পরিনত হয়েছে। দেশের জনগণ ব্যক্তিস্বার্থের বাইরে অন্য যেকোনো হিতকর চিন্তা করতে অক্ষম,নানানভাবে বঞ্চিত হতে হতে তারা অভ্যস্ত। নিজেকে ব্যক্তিমালিকানাধীন দেশী বিদেশি কোম্পানিগুলোর কাছে নাম মাত্র মাসিক বেতনে বিক্রি করে দিয়েছেন বড়লোক হওয়ার আলেয়ায়। দেশে ছাত্রসমাজ তথা যুবসম্প্রদায় মাদক এবং মুঠোফোনের অলিক জগতের মোহে আবদ্ধ। ছাত্র রাজনীতি যখন লক্ষ্য , আদর্শহীন এবং ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের পদ লেহনে গা ভাসিয়ে দিয়েছে। আন্দোলন শুধু সরকার বিরোধী এবং লোক দেখানো খেলো একটা ফলহীন খেলায় পরিনত হয়েছে। তখন নতুন প্রজন্মের রাজনীতি, অর্থনৈতি, সমাজব্যবস্থা সম্পর্কে চরম উদাসীনতা দেশকে নিয়ে যাচ্ছে এক অন্ধকার খাদের দিকে। তাদের কাছে বড় স্বপ্ন মানে রাত জেগে পড়াশোনা করে, বড় হয়ে ডাক্তার হওয়া আর বড় একটা বাড়ি কিনে বারান্দায় বসে বৃষ্টি দেখা। তাদের কাছে বেশী জানা মানে ইন্টারনেটে হাজার হাজার সিনেমা, ডকুমেন্টারি আর ট্রাভেল ভ্লগ দেখা, এবং নিজেকে সবার চেয়ে জ্ঞানী মনেকরা। কী ভিষণ ছেলেমানুষী! এমন দুঃসময়ে অতীতের মহিমান্বিত সময়ের স্মৃতিচারণ করে কিছুটা আত্মতুষ্টি পাওয়া অপরাধ নয়। এছাড়া নতুন প্রজন্মকে তাদের ভুলে যাওয়া পূর্বজদের আদর্শ, দায়িত্বজ্ঞান, কর্মজীবন এবং আত্মত্যাগ সম্পর্কে সচেতন করা এই লেখার উদ্দেশ্য।

বিপ্লবী ফুটবলার :
কমরেড নলিনী দাস। ১লা জানুয়ারী, ১৯১০ সালে ব্রিটিশ ভারতের, পূর্ব বাংলার বরিশাল জেলার ভোলা মহকুমায় এক সম্ভ্রান্ত হিন্দু পরিবারে এই মহান বিপ্লবী নেতা জন্মগ্রহণ করেন। ছেলেবেলা থেকেই তিনি ছিলেন নির্ভীক, মিষ্টভাষী, ভদ্র,পরিশ্রমী, মেধাবী এবং দুর্দান্ত ফুটবল খেলোয়াড়।
১৯২৪ সাল। তখন নলিনী দাস ভোলা গভনর্মেন্ট স্কুলে ৮ম শ্রেণির ছাত্র। ফুটবলের শ্রেষ্ঠ খেলোয়াড় হিসেবে স্কুলে তিনি সুপার হিরো। সকলের প্রিয় পাত্র।এসময় ভোলা ন্যাশনাল স্কুলের শিক্ষক হয়ে আসেন শচীন কর গুপ্ত এবং মহেন্দ্র রায়। তাঁরা ভোলায় বিপ্লবী দল সংগঠনের কাজ করছিলেন। স্কুলের জিমন্যাসিয়ামে তাঁদের সাথে পরিচয় হয় নলিনী দাসের। অল্পসময়ের মধ্যেই তাঁদের একটা ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক তৈরি হয়। নলিনী দাসের বাড়িতেও তাঁদের যাওয়া আসা চলতে থাকে। এদিকে নলিনী দাসের বাড়ি থেকে এইসব ব্যাপারে ছিলো সম্পূর্ণ স্বাধীনতা। নলিনী দাসের বাড়ি ফেরার ওপরও পরিবার থেকে কোন বাধা নিষেধ ছিলো না। এইসবই ছিলো নলিনী দাসের ভালো ফুটবল খেলোয়াড় হওয়ার সুবাদে। কারণ ফুটবল খেলার জন্য তাঁকে বিভিন্ন জায়গায় যেতে হত।
নলিনী দাসের চরিত্রের একটি অসাধারণ দিক ছিলো Inborn Superiority। তাঁকে বড় থেকে ছোট সকলেই সমীহ করতেন, সকলে তাঁর মতামতের মূল্য দিতেন। খুবই অল্প সময়ের মধ্যে তিনি মানুষকে আপন করে নিতে পারতেন। ধীরে ধীরে তিনি বিপ্লবী সংগঠনের জন্য কাজ করতে শুরু করলেন। যোগ দিলেন ভোলার বিপ্লবী দল "যুগান্তর" এ। এ সময় তিনি নিয়ম করে রোজ জিমনাস্টিক ক্লাবে যেতেন, সাহিত্যমন্দিরে এসে খবরের কাগজ এবং বই পড়তেন, প্রায় সব মিটিংয়ে এ উপস্থিত থাকতেন। এভাবে নিজেকে বিকাশের মাধ্যমে কিছুদিনের মধ্যেই তাঁর চলাফেরা, কথাবার্তায় একটা বিরাট পরিবর্তন এসেছিল। তিনি ছিলেন অল্পভাষী। তাঁর গানের গলাও ছিলো চমৎকার। তিনি খুবই সুন্দর স্বদেশী গান গাইতেন। তাকে দলে বা দলের বাইরে কারো সাথে কখনো রাগারাগি বা ঝগড়া মারামারি করতে কেউ দেখেননি।

সশস্ত্র বিপ্লবী :
১৯২৮ সাল। সবদিকে সমান ভারসাম্য রক্ষা করে নলিনী দাস ফার্স্ট ডিভিশনের সাথে ম্যাট্রিক পাশ করলেন।ভর্তি হলেন বরিশাল বি.এম.কলেজের বিজ্ঞান বিভাগে।থাকার জন্য উঠলেন কলেজ হোস্টেলেই। কলেজের ফুটবল টীমে নাম লেখালেন। তখন তাঁর খেলা দেখার জন্য বেল্'স্ পার্কে ভীড় জমে যেতো। বরিশাল শহর জুড়ে তাঁর বিশাল বন্ধুবৃত্ত তৈরি হয়ে গিয়েছিল। সে-বছরই তিনি কলেজ স্পোর্টসে ৫ মাইল ম্যারাথন দৌড়ে প্রথমও হলেন। ১৯২৯ সাল, সেই সময় দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি ক্রমশই চঞ্চল হয়ে উঠছিল। ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে কিছু একটা একশনের জন্য সব বিপ্লবী দলই উদগ্রীব হয়ে উঠছিল। যুগান্তর এবং অনুশীলন নামে দুইদলের ভেতর থেকে কিছু কর্মী বের হয়ে এসে একসাথে নতুন উৎসাহে বরিশাল জেলা অস্ত্রাগার লুট করার এক দুর্ধর্ষ পরিকল্পনা এবং কার্যক্রম শুরু করে দিলেন। বলা বাহুল্য যে এই কাজের নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন নলিনী দাস। অল্প সময়ের মধ্যেই কলেজ এবং কলেজের বাইরের প্রচুর কর্মীদের টেনে নিলো এই কাজ।নলিনী দাস হোস্টেলের বাস তুলে দিলেন। শহরের ফকির বাড়ী রোডে একটা বাড়ি ভাড়া নিলেন- যাতে বাইরের কর্মীরা এসে প্রয়োজন মত থাকতে পারে। নলিনী দাস নিজে এই বাড়ি দেখাশোনা ও চালানোর দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিলেন। এদিকে পুলিশ কিন্তু তলে তলে ঠিকই তাদের পরিকল্পনার গন্ধ পেয়ে জাল পাতলেন। একে একে পুলিশের জালে ধরা পড়লেন অনেক বিপ্লবী কর্মী, তাদের জেলে ঢুকানো হল। নলিনী দাস কিন্তু নিজের দক্ষতায় পুলিশের চোখে ধুলো দিয়ে পালালেন। এক রাতের ঘটনা, অন্য একটি বাড়িতে বিপ্লবীদের গোপন মিটিং চলছে। সেখানে উপস্থিত নলিনী দাস। পুলিশ খবর পেয়ে নকল শবযাত্রী সেজে ওই বাড়ি ঘেরাও করে ফেলল। সবাই ধরা পড়ে গেল। শুধুমাত্র নলিনী দাস পুলিশের কর্ডন ভেঙে খালের জলে লাফিয়ে পড়ে পালিয়ে গেলেন।
১৯৩০ সালে গান্ধীজির অসহযোগ আন্দোলন এবং আইন অমান্য আন্দোলনের পাশাপাশি সারা ভারতবর্ষে শুরু হয়ে যায় সশস্ত্র বিপ্লবী সংগ্রাম। ২৫শে আগষ্ট ডালহৌসি স্কোয়ারে বোমা ফাটালেন বিপ্লবী অনুজ। ২৯শে আগষ্ট ঢাকা মিডফোর্ড মেডিক্যাল স্কুল পরিদর্শনের সময় বিনয় বসুর গুলিতে মারা গেল লোম্যান এবং আহত হয় হডসন সাহেব। রয়টার্স বিল্ডিংয়ে বিনয় বাদল এবং দীনেশ হত্যা করেন অত্যাচারী সিমসনকে। এদিকে নলিনী দাস সরাসরি যোগ দেন সশস্ত্র বিপ্লবী সংগ্রামে। তিনি পালিয়ে গেলেন বরিশাল থেকে ঢাকা সেখান থেকে কলকাতা।পরিকল্পনা ছিলো কলকাতার পুলিস কমিশনার চার্লস টেগার্ট সাহেবকে হত্যা-প্রচেষ্টা। আত্মগোপনে রাতের পর রাত শুয়ে কাটালেন কর্নওয়ালিস স্ট্রিটের ফুটপাতে। শেষ পর্যন্ত নভেম্বরে গ্রেপ্তার হলেন পুলিশের হাতে। কিন্তু নির্দিষ্ট কোন অভিযোগ না থাকায়, নিজ জেলা বরিশালে বিপ্লবী কর্মী হিসাবে তার নাম পুলিশের তালিকায় থাকায়,সেই বছরই বিনা বিচারে তাঁকে নিরাপত্তা বন্দী হিসেবে প্রেসিন্ডেন্সি জেলে আটকে রাখে পুলিশ এবং ১৯৩১ সালে তাঁকে হিজলী বন্দী নিবাসে পাঠানো হয়।

হিজলীর বন্দী :
১৯৩১ সাল,ডিসেম্বর মাস। হিজলীর বন্দী শিবির। মোট বন্দী সংখ্যা ১৫০ জন। তাদের মধ্যে নলিনী দাস একজন। চারিদিকে কাঁটাতারের বেড়া। উঁচু কাঠের বাক্সের ওপর বসে সিপাহীরা পাহারা দেয় সারাক্ষণ। বন্দী শিবিরে নলিনী দাসের মন টেকে না। বাইরে তখন চলছে তুমুল বিপ্লবী সংগ্রাম। নলিনী দাস বন্দী শিবিরে অল্প সময়ের মধ্যে প্রচুর বিপ্লবী বন্ধু জুটিয়ে ফেললেন। তাদের নিয়ে তিনি বন্দী শিবির থেকে পালানোর ছক কষতে লাগলেন। দেখা গেল রাতেরবেলার সিপাহীরা প্রায়ই ঘুমায়, এই সময় কাঁটাতারের বেড়া কেটে পালানো কোন ব্যাপার না। পরিকল্পনা অনুযায়ী কাজ চলল। গোপনে সাংকেতিক চিঠি গেল বাইরের বিপ্লবী দলের কাছে। তখন বন্দী শিবিরের প্রয়োজনীয় মালামাল আসতো কমলালয় স্টোর থেকে। কমলালয় স্টোরে ঘুষ দিয়ে অন্যান্য মালামালের সাথে বন্দী শিবিরে পাঠানো হল কাঁটাতারের বেড়া কাটার কাঁচি। এমন সময় ঘটলো এক বিপত্তি। বাইরে তখন বিপ্লবীরা সমানে সাহেবদের হামলা করছে, দেশীয় অত্যাচারী পুলিশদের মারছে, আহত করছে।বাইরের বিপ্লবী চরম কর্মকাণ্ডর চাপ এসে পড়ল বন্দী শিবিরের ভিতরে। হিজলী বন্দী শিবিরের আর্মস ইন্সপেক্টর সিপাহীদের ক্ষেপিয়ে তুলল বন্দীদের ওপর। পরিস্থিতি গরম হয়ে গেলে সিপাহী -বন্দী গন্ডগোল বেঁধে গেল। এক পর্যায়ে সিপাহীরা এলোপাতাড়ি গুলি চালালো বন্দীদের ওপর। শহীদ হলেন বিপ্লবী সন্তোষ মিত্র এবং তারকেশ্বর সেন।আহত হলেন আরও অনেক বন্দী। বন্ধু বিয়োগে নলিনী দাস উত্তেজিত হয়ে উঠলেন।কিন্তু ঠান্ডা মাথায় পরবর্তী পদক্ষেপ নিয়ে চিন্তা করতে লাগলেন। পালানোর প্রথম পরিকল্পনা ভেস্তে গেল। তিনি ঠিক করলেন সেই রাতেই সকল বিপ্লবীদের পক্ষে বন্দী শিবিরে কি ঘটনা ঘটেছে তার পরিপূর্ণ বর্ননা দিয়ে নেতাজি সুভাষ বোস কে চিঠি লেখা হবে। চিঠি চলে গেল নেতাজির কাছে সেই রাতেই। রাত দুইটার সময় জেলের ডাক্তার বেকার আসলেন। মোট ৩৬ জন আহত বন্দীকে পাঠালেন হাসপাতালে। পরদিন এই নারকীয় হত্যা কান্ডের কথা পত্রিকায় প্রকাশ পেল। সারাদেশের মানুষ প্রতিশোধের আগুনে এবং শোকে জ্বলে উঠলো। নলিনী দাস বন্দী শিবিরের বড় অফিসারের কাছে আহতদের সেবা করার অনুমতি চেয়ে দরখাস্ত করলেন। তাঁর আবেদন মঞ্জুর করা হল। নেপালী সিপাহীদের পাহারায় নলিনী দাস এবং আরও কয়েকজন বিপ্লবী প্রতিদিন হাসপাতালে যেতেন। একফাঁকে দলের কাছ থেকে পর্যাপ্ত টাকা হাতে এসে পৌঁছালে নলিনী দাস মদ এবং মাংস খাবার টাকা দিয়ে নেপালী সিপাহীদের হাত করে নিলেন। তারপর একদিন তাঁরা আর ফিরলেন না। সবাই মিলে হাসপাতালের জানালা দিয়ে পালালেন। বন্দী শিবিরে হৈচৈ পড়ে গেল। এদিকে নলিনী দাস তাঁর ছোট দল নিয়ে ট্রেনে চেপে হাওড়া, বেলুড় হয়ে রানীগঞ্জে এক বন্ধুর বাড়িতে গা ঢাকা দিলেন এবং পরবর্তী পদক্ষেপের পরিকল্পনা করতে থাকলেন। এই সময় তিনি রুশ বিপ্লব সম্পর্কে কয়েকটি বই পড়ে সমাজতন্ত্রের প্রতি অসীম এক আকর্ষণ এবং বিশ্বাস অনুভব করেন।

চন্দননগরের খণ্ডযুদ্ধ :
১৯৩২ সাল। ফরাসী অধিকৃত চন্দননগর।সেখানে নলিনী দাস ফেরারি হয়ে গোপনে এসে উঠেছেন একটি বাড়িতে। তাঁর সাথে আছেন আরও দুইজন ফেরারি বিপ্লবী, টেগার্ট হত্যা প্রচেষ্টা মামলার যাবজ্জীবন কারাদণ্ডাদেশ প্রাপ্ত আসামি বিপ্লবী দীনেশ মজুমদার এবং মেদিনীপুর কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে পলাতক ও ওয়াটসন হত্যা প্রচেষ্টা মামলার আসামি বীরেন রায়। পুলিশ খবরীর মাধ্যমে একসময় ঠিক খবর পেয়ে যায়। তাই তিনজন সশস্ত্র বিপ্লবী আসামি কে একসাথে ধরার মওকা লুফে নিয়ে,সময় নষ্ট না করে পুলিশ বাহিনী দিয়ে ঐ বাড়ি ঘেরাও করে ফেলে। সেদিন চন্দননগরের রাস্তায়, মাত্র ৩ জন বঙ্গবীরের সাথে পুলিশ বাহিনীর ৪ ঘন্টা ধরে গোলাগুলি চলতে থেকে। প্রথমে গ্রেপ্তার হন বীরেন রায়। এদিকে বিপ্লবীদের গুলিতে চন্দননগরের পুলিশ কমিশনার কিউ সাহেব মারা যায়। অনেক পুলিশ আহত হয়।এক সময় বিপ্লবীদের গুলি শেষ হয়ে যায়। এই সুযোগে নলিনী দাস এবং দীনেশ মজুমদার আহত অবস্থায় শেষপর্যন্ত পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়। এই ঘটনার পর কলকাতার কর্নওয়ালিস স্ট্রিটের একটা বাড়িতে তাঁরা গোপনে আশ্রয় নেন। পুলিশ খুবই দ্রুত গোপন সুত্রে এই খবর পেয়ে গেলে, রাত ১ টায় ঐ বাড়ি রেইড দেয়। অতর্কিত হামলা সামলাতে সেখানে অবস্থানরত আহত নলিনী দাস, দীনেশ মজুমদার এবং জগদানন্দ মুখার্জি পুলিশের ওপর গুলি চালায়। এতে পুলিশের আই, ডি, বি ইন্সপেক্টর মুকুন্দ ভট্টাচার্য এবং ডি,এস,পি পোলার্ড আহত হন। গুরুতর আহত অবস্থায় ধরা পড়েন নলিনী দাস, দীনেশ মজুমদার এবং জগদানন্দ মুখার্জি। পরবর্তীতে ১৯৩৪ সালে, দীনেশ মজুমদারের ফাঁসির আদেশ হয়। এদিকে নলিনী দাস এবং জগদানন্দ মুখার্জি কে যাবজ্জীবন দ্বীপান্তর দন্ডে দন্ডিত করে আন্দামানের বন্দী শিবিরে চালান দেয়া হয়।

আন্দামানে নির্বাসন:
১৯৩৪ সাল। আন্দামানের সেলুলার জেল। দুঃস্বপ্নের মত এক জেল জীবন। রাজবন্দিদের কোন সুযোগ সুবিধা নেই। নিম্ন মানের খাবার এবং থাকার ব্যবস্থা। স্থবির এক সময়, যেন কাটতে চায়না। এখানে নিজেকে মানিয়ে নেয়ার জন্য এবং হাতে সময় পেয়ে নিজেকে বিকশিত করার জন্য নলিনী দাস 'মার্ক্স-লেনিনবাদী' সাহিত্যে মননিবেশ করলেন। একাগ্রতা, ধৈর্য্য এবং নিষ্ঠার সাথে দেশের অধিকাংশ শোষিত জনগণের মুক্তি এবং শোষণহীন সমাজ গঠনের সংগ্রামের পথ হিসেবে সুনির্দিষ্ট করলেন মার্ক্সবাদী এবং লেনিনবাদের বিজ্ঞান। একজন দুর্ধর্ষ বিপ্লবী কর্মী থেকে তিনি নিজেকে ক্রমশ বিকাশিত করলেন একজন কমিউনিস্ট বিপ্লবী কর্মীতে। আর সকল বিপ্লবীদের কাছে অগ্নি যুগের একজন সার্থক পরিনতির উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হয়ে রইলেন কমরেড নলিনী দাস। আন্দামানের জেলে বিভিন্ন মতাদর্শের রাজনৈতিক বন্দী ছিলেন। তাঁদের সকলের সাথে নলিনী দাসের ছিলো অসম্ভব বন্ধুত্ব। তিনি ছিলেন সকলের প্রিয় নলিনী দা।
১৯৩৫ সালে নলিনী দাসের প্রচেষ্টায় আন্দামান জেলের ভেতরেই গড়ে উঠেছিল "Communist Consolidation "।
১৯৩৬ সালে আন্দামানের বন্দীরা জেলে অনশন ধর্মঘট শুরু করলেন। ধর্মঘটে বন্দীদের মূল দাবি ছিলো রাজবন্দিদের দেশে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে হবে এবং মুক্তি দিতে হবে ( Repatriation and Release)।নলিনী দাস এই আন্দোলনে অন্যতম ভূমিকা রেখেছিলেন। এই আন্দোলনের চাপের মুখে সরকার কিছুদিনের মধ্যেই বন্দীদের ভারতে ফিরিয়ে নিয়ে আসেন। এরপর তাঁদের স্ব স্ব প্রদেশের জেলে পাঠিয়ে দেন। নলিনী দাসকে পাঠানো হয় ঢাকা জেলে।
১৯৩৮ সালের ১৯ জানুয়ারী। বিপ্লবী কমিউনিস্ট নলিনী দাসকে নিয়ে আসা হয় কলকাতায়। ১৯৩৮ থেকে ১৯৪৬ সাল পর্যন্ত বহু রাজবন্দীদের মুক্তি দেয়া হলেও তাঁকে মুক্তি দেয়া হয়না। তিনি সহ ৩০ জনকে " ভয়ানক বিপ্লবী ব্যাক্তি " তকমা দিয়ে জেলে আটকে রাখে সরকার। এইসময় তাদেরকে আলিপুর, দমদম, প্রেসিডেন্সি ইত্যাদি জেলে স্থানান্তরিত করা হয়। কমিউনিস্ট পার্টি ও অন্যান্য বামপন্থী সংগঠনগুলি এই সকল রাজবন্দিদের মুক্তির দাবিতে আন্দোলন শুরু করেন।
১৯৪৬ সাল। অবশেষে ২য় বিশ্বযুদ্ধের দামামা, নৃশংস সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা এবং রাজবন্দিদের মুক্তির দাবিতে আন্দোলনের চাপের মুখে সরকার রাজবন্দীদের মুক্তি দেন।

সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা এবং দেশভাগ :
জেল থেকে মুক্তি পেয়েই নলিনী দাস ঝাপিয়ে পড়ে সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে আন্দোলনে। তিনি কলকাতার অন্য নেতাদের সাথে বসেন এবং সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা প্রতিরোধ কমিটি গঠন করেন। এদিকে নলিনী দাসের ভোলাতে পার্টি খুবই দূর্বল হয়ে গেছে খবর পেয়ে তিনি সময় নষ্ট না করে, ভোলা চলে আসেন। ভোলাতে তাঁর প্রত্যাবর্তন উপলক্ষে বর্ণাঢ্য এক অভ্যর্থনা অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। ভোলাবাসির এই ভালোবাসা নলিনী দাস কে সিক্ত করে। বরিশালে ফিরেই তিনি শুরু করলেন জেলা কমিউনিস্ট পার্টির কাজ। বিশেষ করে কৃষক আন্দোলন এবং সংগঠন গড়ে তোলার কাজে আত্মনিয়োগ করলেন।
১৯৪৭ সাল। আগষ্ট মাস। সাম্প্রদায়িকতার ভিত্তিতে দেশভাগ হল। ১৯৪৮ সালের ৬ মার্চ স্বতন্ত্রভাবে পাকিস্তানের কমিউনিস্ট পার্টি গঠিত হয়েছিল। পাকিস্তানের কমিউনিস্ট পার্টির শাখা হিসেবে পূর্ব পাকিস্তানের কমিউনিস্ট পার্টিও একই দিনে গঠিত হয়েছিল। তখন নলিনী দাস পূর্ব পাকিস্তান কমিউনিস্ট পার্টির সক্রিয় সদস্য হয়েছিলেন।পার্টি গঠিত হওয়ার কিছুদিনের মধ্যে তা আত্মপ্রকাশ করার সাথে সাথে পূর্ব পাকিস্তানের তদানিন্তন প্রতিক্রিয়াশীল মুসলিমলীগের সরকার পার্টির উপর তীব্র দমননীতি চালিয়ে যাচ্ছিলো। ফলস্বরূপ নলিনী দাস আবার আত্মগোপনে গিয়ে পার্টির কাজ চালিয়ে যাচ্ছিলেন। ১৯৫০ সালে নৃশংস সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা চলাকালীন নলিনী দাস ও তাঁর রাজনৈতিক বন্ধুরা বাবুগঞ্জ থানায় রাকুদিয়া গ্রামে কৃষক নেতা নজুমদ্দিন ফরাজীর বাড়িতে কৃষকদের নিয়ে সভা করছিলেন। এমন সময় দাঙ্গাকারিরা তাঁদের ওপর চড়াও হয়। কৃষক নেতা নজুমদ্দিন ফরাজী রুখে দাঁড়ান, " আমাকে খুন না করে, আমার কোন বন্ধুদের খুন করা যাবেনা!" সে বাড়ি ছেলেমেয়েরা এবং দরিদ্র মুসলমান কৃষকরাও দাঙ্গাকারিদের বিরুদ্ধে কঠোর ভাবে রুখে দাঁড়ালেন। কিন্তু কিছুতেই তাদের ফেরানো গেল না দেখে নলিনী দাস বললেন, " এ কয়েকজন কে মেরে আর কি বা হবে, তারচেয়ে তোমরা আমাদের ধরে পুলিশের হাতে তুলে দাও, পুরস্কার পাবে।"। দাঙ্গাকারিরা নলিনী দাস, কৃষক নেতা নজুমদ্দিন ফরাজী সহ আর সকল নেতা, কর্মীদের গ্রেফতার করে পুলিশের হাতে তুলে দিলেন। তাঁদের নামে মিথ্যা মামলা দায়ের করা হল। ১০ বছরের কারাদণ্ড দেয়া হল। আদালত নলিনী দাস কে মুক্তি দিলেও কোর্টের গেট থেকে তাকে আবার গ্রেফতার করা হল। ১৯৫৪ সালে মুসলিমলীগের শোচনীয় পরাজয়ের পর শের-ই-বাংলা এ কে ফজলুল হকের কৃষক শ্রমিক পার্টির অন্যতম নেতা আবু হোসেন সরকারের নেতৃত্বে যে মন্ত্রিসভা গঠিত হয়। সে মন্ত্রী সভা ১৯৫৫ সালে একবারে সমস্ত কমিউনিস্ট নেতাদের মুক্তি দেন এবং আন্ডারগ্রাউন্ড কমিউনিস্ট নেতাদের উপর থেকেও হুলিয়া প্রত্যাহার করেন। কিন্তু একমাস পরে পুলিশ ধর্মঘটে উস্কানি দেওয়ার অভিযোগ এনে আবার সব কমিউনিস্ট নেতাদের গ্রেফতার করার আদেশ দেয়। নলিনী দাস আবারও জেলে যান কোন প্রকার মামলা ছাড়াই। এর কিছু দিন পর আওয়ামী লীগ সরকার গদিতে বসার সাথে সাথে সকল কমিউনিস্ট নেতাদের আবার মুক্তি দেয়া হয়। এবার নলিনী দাসও মুক্তি পেলেন। মুক্তি পেয়ে তিনি বরিশাল জেলার কমিউনিস্ট পার্টির সম্পাদক নির্বাচিত হন। এরপরে দুই বছর তিনি জেলার বিভিন্ন গ্রামে গ্রামে কৃষকদের সংগঠন করে, কর্মীদের সাথে দফায় দফায় মিটিং করে, একটা কথাই বার বার বলেছিলেন, আর বেশি সময় পাওয়া যাবেনা। দলকে খুবই দ্রুত শক্তিশালী করে তুলতে হবে।

সামরিক অভ্যুত্থান, পলাতক জীবন এবং মুক্তি যুদ্ধ :
১৯৫৮ সালে বাংলাদেশের বুকে নেমে এসেছিল আইয়ুব খানের সামরিক সন্ত্রাস। এই শাসন চলে ছিল ১২ বছর। এই ১২ বছর নলিনী দাস পলাতক জীবন যাপন করে ছিলেন। গ্রাম থেকে গ্রামে। কখনো গৃহশিক্ষক সেজে, কখনো বা আত্মীয়র বেশ ধরে ক্ষেতে কাজ করে। এই সব কিছুর মধ্যে তিনি তাঁর পড়াশোনা, লেখালেখি এবং পার্টির দিক নির্দেশনা ঠিকই দিয়ে গেছেন।
১৯৭১ সালে যখন মুক্তি যুদ্ধ শুরু হয়। তখন তিনি পূর্ব পাকিস্তান কমিউনিস্ট পার্টি নাম বদলে বাংলাদেশ কমিউনিস্ট পার্টি নাম দিলেন। মুক্তি যুদ্ধে তিনি অংশ গ্রহণ করলেন সোৎসাহে। কখনো মাঝি সেজে মুক্তি বাহিনীর রশদ পৌঁছে দিতেন। কখনো বা দিনমজুর হিসেবে তাদের মাঝে উপস্থিত হয়ে নানান দিক নির্দেশনা এবং উৎসাহ দিয়েছেন। চিরতরুণ নলিনী দাস চরকির মত ঘুরেছেন মুক্তি বাহিনীর ছাউনি গুলোতে। ইছামতীর পাড়ে হাসনাবাদের শিক্ষা শিবিরে গেরিলা প্রশিক্ষণ নিচ্ছিলেন হাজার হাজার বরিশালের তরুন। তাদের প্রশিক্ষক ছিলেন মেজর জলিল। নলিনী দাস কে দেখে তিনি আনন্দে বুকে জড়িয়ে ধরলেন। তারপর বললেন তরুণ গেরিলাদের উদ্দেশ্যে কিছু বলতে বললেন। নলিনী দাস সকল কে দল মত নির্বিশেষে সাম্রাজ্যবাদী শাসন এবং শোষণ থেকে বাংলাদেশ কে মুক্তির জন্য আহবান জানালেন। বললেন " দমে যেও না, লড়ে চল! বিপ্লবের জন্য যা প্রয়োজন তা শিখতে হবে এবং করতে হবে। বৈষম্যহীন এবং শোষণ মুক্ত সমাজ গড়ে তুলতে হবে। " তাঁর বক্তব্যে গেরিলারা উজ্জীবিত হয়েছিল।

টি.বি এবং জীবন অবসান :
সারাজীবনে আহত,পলাতক জীবন আর অমানবিক জেল নির্যাতন তাঁর শরীরটাকে ভেতর থেকে ভেঙে দিয়েছিল। ৭০ বছরের জীবনে ২৩ বছর কেটেছে ব্রিটিশ ভারতের এবং পূর্ব পাকিস্তানের জেলে।প্রায় ২১ বছর কেটেছে পলাতক জীবন। ১৯৮১ সালে তিনি তাঁর লক্ষাধিক টাকার পৈতৃক সম্পত্তি ট্রাস্টি তে দান করে, কলকাতা চলে যান চিকিৎসার উদ্দেশ্যে। সেখানে দীর্ঘদিন রোগে ভোগার পর ১৯৮২ সালে ১৯শে জুন বেলা ১২:৪৫ মিনিটে তিনি মৃত্যু বরণ করেন। শেষ হয় একজন সত্যিকারের বিপ্লবী কমিউনিস্ট নেতার রোমাঞ্চকর জীবন। তিনি সারাজীবন সাম্প্রদায়িকতা এবং দ্বিজাতিতত্ত্ব ঘৃণা করতেন। তিনি একটি বৈষম্যহীন এবং শোষণ মুক্ত সমাজ গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন। আজকের এই দুর্দিনে এই বিপ্লবী কমরেড কে শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করি।

মন্তব্য ২ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (২) মন্তব্য লিখুন

১| ১৭ ই জানুয়ারি, ২০২০ রাত ৩:০৭

অনল চৌধুরী বলেছেন: এইসব আজন্ম বিপ্বীর কথ এখন আর কেউ শুনতে চায় না।
শাহরুখ-ঋত্ত্বিক-বিবার-গোমেজে-ফেসবুক ইন্টারনেটে সবাই অঅসক্ত।
তাই তো দেশের এতো অধ:পতন।
আমার লেখা অগ্নিযুগ(২০০২) উপন্যাসটা ঢাকার বিপ্লবীদের নিয়ে লেখা ,এখন পড়ে দেখছি,তার অনেককিছুই নলিনী দাসের সাথে মেলে।

২| ১৭ ই জানুয়ারি, ২০২০ রাত ৮:২০

রাজীব নুর বলেছেন: ক্ষমতাবানদের হাতে এই সব কমরেডরা মারা পড়েছেন।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.