![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকদের মধ্যে ক্ষমতা ও স্বার্থের দ্বন্দ্বের কারণেই অচল অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে বলে দাবি করছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মকর্তা কর্মচারি ও সাধারণ শিক্ষার্থীরা। তারা বলছেন, ভিসির পদত্যাগ হলেও বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শিক্ষকদের আন্দোলন পিছু হঠবে না। ক্ষমতা ও স্বার্থের কারণে এর আগেও বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকদের আন্দোলন হয়েছে।
তারা বলেছেন, এ বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকদের একটি অংশের মধ্যে রাজনৈতিক মতাদর্শ, ব্যক্তি হিংসা ও ক্ষমতার লোভ বেড়ে যাওয়ায় শিক্ষাদান থেকে শিক্ষকরা সরে গিয়ে আন্দোলনে সক্রিয় করে তুলছেন।
সাধারণ শিক্ষার্থীরা বলছেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য নয়, স্বার্থের জন্য শিক্ষক আন্দোলন চলছে। নতুন ভিসি আসলেও সমস্যার সমাধান হবে না। গত ২০ মাসে বিশ্ববিদ্যালয়ে বেশ কয়েক দফা শিক্ষক আন্দোলন হয়েছে। যার বেশিরভাগই শিক্ষকদের স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিষয়ের। শিক্ষকদের আন্দোলনের পেছনে বেশি সময় ব্যয়ের কারণে শিক্ষা কার্যক্রমে ব্যাপক নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে।
বিশ্ববিদ্যালয় সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলছেন, গত বছরের ১২ জানুয়ারি ইংরেজি বিভাগের শিক্ষার্থী ও ছাত্রলীগ কর্মী জুবায়ের আহমেদ প্রতিপক্ষ গ্রুপের হাতে নিহত হলে তত্কালীন ভিসি অধ্যাপক শরীফ এনামুল কবিরের বিরুদ্ধে পদত্যাগের দাবি উঠে। এ দাবির সাথে সাথে তত্কালীন প্রশাসনের দীর্ঘদিনের অনিয়মের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর প্রত্যয়ে মাঠে নামে "শিক্ষক সমাজ"র ব্যানারে সাধারণ শিক্ষক ও "সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে জাহাঙ্গীরনগর"র ব্যানারে সাধারণ শিক্ষার্থীরা। তারা বিভিন্ন দফায় আন্দোলন করে অধ্যাপক শরীফ এনামুল কবিরকে পদত্যাগে বাধ্য করেন।
গত বছরের ২০ মে নতুন ভিসির দায়িত্ব নেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক অধ্যাপক মো. আনোয়ার হোসেন। দায়িত্ব গ্রহণ করেই ভিসি প্যানেল নির্বাচনের ঘোষণা দেন তিনি। এরপর তিনি নির্বাচিত ভিসি হিসেবে মনোনয়ন পান।
এদিকে বাইরের বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ভিসি নিয়োগ হওয়ায় প্রথম থেকেই শিক্ষকদের বিভিন্ন গ্রুপ মনঃক্ষুণ্ন ছিল। তাছাড়া ভিসি হওয়ার জন্য দৌড় ঝাঁপ করা শিক্ষকরা প্রথম থেকে মেনে নিতে পারেননি নতুন ভিসি অধ্যাপক মো. আনোয়ার হোসেনকে। এরপর বিভিন্ন দাবি সামনে নিয়ে এসে শিক্ষক সমিতির ব্যানারে আন্দোলনে নামে শিক্ষকদের বিভিন্ন অংশ। ভিসি বিরোধী আন্দোলনে যোগ দেয় বিএনপি পন্থি শিক্ষকরা। শুরু হয় বিবৃতি প্রদান, লিফলেট বিতরণ, সংবাদ সম্মেলন, মানববন্ধন, মৌন মিছিল ও ক্লাস পরীক্ষা বর্জনের মতো কর্মসূচি।
অপরদিকে তিন মাস আগে এই বিশ্ববিদ্যালয়ে নতুন করে প্রোভিসি ও ট্রেজারার নিয়োগ দেয়ার পর পদ প্রত্যাশীরা পদ না পেলে চলমান আন্দোলন আবার চাঙ্গা করে তোলে। সবশেষে শিক্ষক লাঞ্ছনার বিচারকে কেন্দ করে ভিসির পদত্যাগ দাবিতে ক্লাস বর্জনের কর্মসূচি দেন তারা। পরে ১৯ জুন ভিসিকে ক্যাম্পাসে 'অবাঞ্ছিত' ঘোষণা করে ২০ জুন থেকে অনির্দিষ্টকালের জন্য প্রশাসনিক ভবন অবরোধ করে 'শিক্ষক সমিতি'। এ ঘটনার ৪১ দিন পর তিন শিক্ষক ও এক শিক্ষার্থীর রিটের পরিপ্রেক্ষিতে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক কার্যক্রম চালু রাখতে ভিসি, প্রোভিসি, রেজিস্ট্রার ও প্রক্টরকে নির্দেশ দেয় উচ্চ আদালত। এসময় শিক্ষক সমিতির ব্যানার বাদ দিয়ে 'সাধারণ শিক্ষক ফোরাম' ব্যানারে আন্দোলন শুরু করেন শিক্ষকরা।
আন্দোলনের নেপথ্যে: ভিসি হিসেবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষককে প্রথম থেকেই মেনে নিতে পারেননি ভিসি পদ প্রত্যাশী শিক্ষকরা। তত্কালীন ভিসি অধ্যাপক শরীফ এনামুল কবির পদত্যাগ করলে ভিসি হতে দৌড় ঝাঁপ শুরু করেন আওয়ামীপন্থি বেশ কয়েকজন শিক্ষক। সে সময় শিক্ষক সমিতির এক সাধারণ সভায় নিয়োগটি পুনর্বিবেচনা করার জন্য রাষ্ট্রপ্রতিকে অনুরোধও করা হয়। তখন থেকেই অধ্যাপক আনোয়ার হোসেনকে ভিন্ন দৃষ্টিতে দেখতে থাকেন শিক্ষকদের মধ্যে ভিসি পদ প্রত্যাশীরা।
দায়িত্বগ্রহণ করেই ৭৩ এর এ্যাক্ট অনুযায়ী ভিসি প্যানেল নির্বাচনের ঘোষণা দিয়েছিলেন অধ্যাপক আনোয়ার হোসেন। আর এ ঘোষণার বিরোধিতা করে মেয়াদোত্তীর্ণ ডিন, সিন্ডিকেট, সিনেট সদস্য ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ ীয় ছাত্র সংসদ (জাকসু) নির্বাচনের দাবি জানায় শিক্ষকদের তত্কালীন সংগঠন সম্মিলিত শিক্ষক পরিষদ। পরে হাইকোর্টের রিটের প্রেক্ষিতে গত বছরের ২০ জুলাই ভিসি প্যানেল নির্বাচনে ভিসি হিসেবে নির্বাচিত হন অধ্যাপক আনোয়ার হোসেন। এসময়ও সপ্তাহব্যাপী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক ভবন অবরোধ করে রাখা হয়। আর এ ভিসি প্যানেল নির্বাচনের বিরোধিতার মধ্যে দিয়েই শিক্ষকরা অধ্যাপক আনোয়ার হোসেনের বিপরীতে অবস্থান নেন।
যে অভিযোগ ওঠানো হয়েছে : শিক্ষকদের দেয়া অভিযোগের মধ্যে রয়েছে ছাত্র-পুলিশ সংঘর্ষ ও শিক্ষার্থী মৃত্যুর ঘটনায় ক্যাম্পাসে ভাংচুরের নেপথ্য অপরাধীদের বিচার না করা, গণমাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয় সম্পর্কে মর্যাদাহানিকর বক্তব্য প্রদান, শিক্ষক সমিতির দাবির মুখে একবার পদত্যাগের ঘোষণা দিয়ে পুনরায় তা প্রত্যাহার, শিক্ষক লাঞ্ছনার ঘটনায় প্রহসনের বিচার, শিক্ষকদের সম্পর্কে অশালীন ও কুরুচিপূর্ণ মন্তব্য, অযোগ্য প্রার্থীকে পদোন্নতি দেয়ার প্রচেষ্টা, ভর্তি কার্যক্রমে অনিয়ম, প্রক্টোরিয়াল বডির সম্পূর্ণ পরিবর্তন না করা এবং সিন্ডিকেট সভায় নির্বাচিত সদস্যকে অপমানিত করা ইত্যাদি।
এর মধ্যে গত বছরের ২ আগস্ট বিশ্ববিদ্যালয়ে এক ছাত্রলীগ কর্মীকে কুপিয়ে আহত করার ঘটনায় বিশ্ববিদ্যালয়ের মীর মশাররফ হোসেন হলের এক ছাত্রকে গ্রেফতার করতে গেলে পুলিশের সাথে শিক্ষার্থীদের সংঘর্ষ বাধে। এ ঘটনায় দোষীদের শাস্তি প্রদানে ব্যর্থ হওয়ার অভিযোগ উঠে ভিসির বিরুদ্ধে। এছাড়া এ বছরের ১২ ফেব্রুয়ারি এম্বুলেন্সের অভাবে পরিসংখ্যান বিভাগের এক শিক্ষার্থীর মৃত্যুর ঘটনার অভিযোগ উঠলে ক্যাম্পাসের শিক্ষার্থীরা ব্যাপক ভাংচুর চালায়। এ ভাংচুরের ঘটনাকে জামায়াত-শিবিরের হামলা বলে মন্তব্য করলে ভিসি অধ্যাপক আনোয়ার হোসেনের বিরুদ্ধে শিক্ষকরা অবস্থান নেন।
চার ভিসির পদত্যাগ: বিভিন্ন আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে এ পর্যন্ত মোট চার জন ভিসি পদত্যাগ করেছেন। এরা হলেন অধ্যাপক কাজী সালেহ আহমদ, অধ্যাপক আলাউদ্দিন আহমেদ, অধ্যাপক জসিম উদ্দিন আহমদ এবং সর্বশেষ অধ্যাপক শরীফ এনামুল কবির।
ছাত্রদল নেতা হাফিজের বহিষ্কারকে কেন্দ করে ১৯৯৩ সালে সিন্ডিকেট নির্বাচন চলাকালে শিক্ষক ক্লাবে শিক্ষকদের উপর হামলা চালায় জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের নেতাকর্মীরা। সে হামলার জের ধরে পদত্যাগ করেন অধ্যাপক কাজী সালেহ আহমদ।
১৯৯৮ সালে ধর্ষণ বিরোধী আন্দোলন এবং ভর্তি ফি বৃদ্ধির প্রতিবাদে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের মুখে তত্কালীন আওয়ামী লীগ সরকার ভিসি পদ থেকে সরিয়ে দেন অধ্যাপক আলাউদ্দিন আহমদকে। সে আন্দোলনে অগ্রগণ্য ছিলেন তত্কালীন প্রোভিসি অধ্যাপক আবদুল বায়েস।
পরবর্তীতে ভিসি হন অধ্যাপক আবদুল বায়েস। ২০০১ সালে বিএনপি ক্ষমতায় এসে ১৯৭৩ সালের অধ্যাদেশ লঙ্ঘন করে নির্বাচিত ভিসি অধ্যাপক আবদুল বায়েসকে সরিয়ে অধ্যাপক জসিম উদ্দিন আহমদকে নিয়োগ দেন। এতে করে বিএনপিপন্থি শিক্ষকদের মধ্যেই গ্রুপিং তৈরি হয়ে যায়।
অধ্যাপক মুস্তাহিদুর রহমানের নেতৃত্বে বিভিন্ন মতাদর্শের শিক্ষকদের আন্দোলনের মুখে ভিসি প্যানেল নির্বাচন দিলে পরাজিত হয়ে পদ ছাড়তে বাধ্য হন অধ্যাপক জসিম। সর্বশেষ ২০১২ সালে শিক্ষক নিয়োগ ও শিক্ষার্থী জুবায়ের নিহত হবার ঘটনায় তীব্র আন্দোলনের মধ্যে পদত্যাগ করতে বাধ্য হন অধ্যাপক শরীফ এনামুল কবির।
সংশ্লিষ্টদের বক্তব্য
ভিসির পদত্যাগ দাবিতে শিক্ষকদের চলমান আন্দোলনের অংশ হিসেবে গত বুধ ও বৃহস্পতিবার ধর্মঘটের ডাক দেয় সাধারণ শিক্ষক ফোরাম। গত বুধবার সকাল ১১টা থেকে ভিসিকে তার নিজ কার্যালয়ে অবরোধ করে রেখেছেন আন্দোলনকারী শিক্ষকরা। সাধারণ শিক্ষক ফোরামের আহ্বায়ক অধ্যাপক হানিফ আলী বলেন, ভিসি যতক্ষণ পর্যন্ত না পদত্যাগপত্রে স্বাক্ষর করছেন ততক্ষণ পর্যন্ত আমাদের অবরোধ অব্যাহত থাকবে।'
ভিসি অধ্যাপক আনোয়ার হোসেন বলেন, 'বর্তমান সংকট নিরসনে রাষ্ট্রপতির হস্তক্ষেপ কামনা করছি।'
©somewhere in net ltd.