![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
মনের বাগিচা পায়ে দলে হালের অবার্চীন, মুখোশের অন্তরালে তারা মরুয়তে দীন
রুদ্রের লাটাইয়ের আঘাতে চন্দ্র যখন চিতকার করে মাটিতে অজ্ঞান হয়ে পড়ে যায় তখন সবাই ঘুড়ি ফেলে ছুটে আসে। আর রুদ্র ভয়ে দৌড়ে পালিয়ে যায়। চন্দ্রকে ধরাধরি করে সবাই বাড়িতে নিয়ে আসে। চন্দ্রের জ্ঞান তখনও ফেরে নি, কপাল দিয়ে রক্ত ঝরছে। চন্দ্রের এমন অবস্থা দেখে সবার মধ্যে হুলুস্থুল কান্ড বেধে যায়। কেউ যায় ডাক্তার ডাকতে, কেউ পানি নিয়ে আসে, আর এক জন চন্দ্রের কপাল কাপড় দিয়ে শক্ত করে বেধে দেয়। চন্দ্রের মা ফারিয়া খাতুন কেদে চোখ ফুলে তোলেন। চন্দ্রের মুখে পানি ছিটা দিলে চন্দ্র চোখ মেলে তাকায়। কপালে হাত দিয়ে ব্যাথায় হাউমাউ করে কান্না শুরু করে দেয় চন্দ্র। কাপড় দিয়ে কপাল ভালো করে বাধলেও রক্ত পড়া বন্ধ হয় নি। রক্তে কাপড় লাল হয়ে ভিজে উঠেছে। ডাক্তার করিম শেখ চলে আসেন একটু পড়েই। কাপড় খুলে কাটা জায়গাটা ভালো করে দেখে করিম শেখ বলেন- সেলাই দিতে হবে। একটা ব্যাথা কমানোর ইঞ্জেকশন দিয়ে উনি কাটা জায়গাটা সেলাই করে ভালো করে ব্যান্ডেজ করে দেন। তারপর কিছু ঔষুধ দিয়ে বিদায় নেন।
রুদ্রর উপরে সবাই ভিষন ক্ষেপে গেছে। রুদ্রর বাবা মাহমুদ উদ্দিন ছেলেকে ধরে আনার জন্য বাকি ছেলেদেরকে পাঠিয়ে দিলেন। কিন্তু পুরো গ্রাম তন্নতন্ন করে খুজেও রুদ্রকে পাওয়া গেলো না। সবাই এক সময় বিফল হয়ে ফিরে এলো। কেউ ভাবতে পারেনি রুদ্র জঙ্গলের ভিতরে ঢুকতে পারে। তাই জঙ্গলের দিকে কেউ গেলোই না। রাতে চন্দ্রের জর এলো। ওকে জলপট্টি দেয়া হলো। রাত ধিরে ধিরে গভির হলো। সবাই ভেবেছিলো রাত হলে রুদ্র নিজেই চলে আসবে। কিন্তু ও এলো না। এবার সবাই ওর জন্য উল্টো অস্থির হয়ে পড়লো। রুদ্রর মা ফারহানা বেগম সারা রাত কেদে চললেন। সকাল থেকে আবার খোজা শুরু হলো। থানায় মিসিং কমপ্লেইন করা হলো। বোরহান উদ্দিন অত্র এলাকায় ভিষন প্রভাবশালি ছিলেন। তাই পুলিশও তাদের সর্বশক্তি নিয়োগ করলো। জঙ্গলের ভিতরেও আজ ঢোকা হলো। কিন্তু তারা যখন মন্দিরের কাছে ছিলো তখন রুদ্র ছিলো নদির ধারে। আর তারা যখন নদির ধারে গেলো তখন রুদ্র অন্য পথ দিয়ে মন্দিরে ফিরে এসেছিলো। তাই রুদ্রকে ওরা কেউ দেখতে পায় নি। আশপাশের গ্রামও তন্নতন্ন করে খোজা হলো। ঠাকুর পাড়ায় প্রতি বৈশাখে সপ্তাহে দুই দিন করে পুরো মাস বৈশাখি মেলা হয়। সে মেলাতেও খোজা হলো। কিন্তু রুদ্রকে কোথাও পাওয়া গেলো না। কেউ কিছু বলতেও পারলো না।
রুদ্রর মা নাওয়া খাওয়া ছেড়ে দিয়েছেন। ওনার একটাই কথা- আমার ছেলেকে এনে দাও। যেভাবে পারো ওকে খুজে বের করো।
বোরহান উদ্দিনও ভিষন চিন্তায় পড়ে গেলেন। অন্য ছেলেদের চেয়েও রুদ্র তার কাছে বেশি গুরুত্বপুর্ন। কারন চন্দ্রের সাথে একমাত্র রুদ্রকেই মানায়। বাকি ছেলেরা চন্দ্রের চেয়ে অনেক বড়। তাদের কারো সাথে চন্দ্রের বিয়ে দেয়া যায় না। বোরহান উদ্দিন লক্ষ্য করেছেন, রুদ্র অন্যদের চেয়ে আলাদা। অল্প বয়সেই ওর বুদ্ধি সবাইকে হার মানিয়ে দিয়েছে। সব দিক বিবেচনা করে রুদ্রের সাথেই চন্দ্রের বিয়ে মনে মনে ঠিক করে রেখেছেন উনি। এখনো কাউকে বলেন নি। কারন উনি আরো কিছুটা সময় নিয়ে রুদ্রকে পর্যবেক্ষন করতে চেয়েছিলেন। সেই রুদ্রের যদি কিছু একটা হয়ে যায় তাহলে সর্বোনাশ হয়ে যাবে। রুদ্রের কিছু একটা হলে শুধু যে ওরই ক্ষতি হবে তা নয়, চন্দ্রেরও ক্ষতি হবে। চন্দ্রের জন্য রুদ্রর মতো ছেলে দিতিয়টি পাওয়া সম্ভব নয়। কাচারি ঘরের বাহিরে অস্থির হয়ে পায়চারি করছেন বোরহান উদ্দিন। আজ চার দিন হচ্ছে কিন্তু রুদ্রকে এখনো খুজে পাওয়া গেলো না! কোথায় গেলো ছেলেটি? চন্দ্র বোরহান উদ্দিনের পাশেই ছিলো। এখনো ওর কপাল থেকে ব্যান্ডেজ খোলা হয় নি।
হঠাত চন্দ্রের কথা শুনে চারদিকে তাকিয়ে আশ্চার্য হয়ে বললেন বোরহান উদ্দিন- কোথায় রুদ্র?
চন্দ্র আবার ঘুরির দিকে আঙ্গুল তুলে বললো- ওই যে দাদা ভাই ছোট ভাইয়া।
চন্দ্রের আঙ্গুল আকাশের দিকে দেখে অবাক হলেন বোরহান উদ্দিন। রুদ্র আকাশে কিভাবে থাকবে! তারপরেও ওর আঙ্গুল অনুসরন করে আকাশে তাকালেন। দেখলেন আকাশে একটি ঘুরি উড়ছে আর চন্দ্র সে ঘুরিটাকেই দেখাচ্ছে। বোরহান উদ্দিন কিছু বুঝলেন না। সস্নেহে নাতনিকে কাছে টেনে বললেন- ওটা তো ঘুরি!
চন্দ্র এবার বিজ্ঞের মতো বললো- ওটা ছোট ভাইয়ার ঘুরি। ওই উড়াচ্ছে।
বোরহান উদ্দিন আবারও অবাক হয়ে নাতনিকে বললেন- কিভাবে বুঝলি?
চন্দ্র আবারও বিজ্ঞের মতো বললো- ছোট ভাইয়া লাল কাগজ দিয়ে ঘুরি বানায়। আর লেজ দেয় অনেক বড়। অত বড় লেজ আর কেউ দেয় না।
এবার ভালো করে ঘুরির দিকে তাকলেন বোরহান উদ্দিন। চন্দ্র ঠিকই বলছে। ঘুড়িটার কালার বোঝা না গেলেও লেজ ঠিকই বোঝা যাচ্ছে। বিশাল লেজ। বোরহান উদ্দিনের মন খুশিতে নেচে উঠলো। এবার হয়তো রুদ্রকে খুজে পাওয়া যাবে। অদুরে নাতি রুমনকে দেখতে পেয়ে তিনি হাক ছাড়লেন- রুমন! রুমন! এদিকে আয়।
রুমন রুদ্রর বড় ভাই। নানার ডাক শুনে ছুটে এলো। রুমন কাছে আসতেই বোরহান উদ্দিন ওকে ঘুরিটা দেখিয়ে বললেন- সব ছেলেকে নিয়ে খুজে বেড় কর ঘুরিটা কে উড়াচ্ছে। ওটা মনে হয় রুদ্রর কাজ।
রুমনও দেখলো ঘুরিটা। ওর মনও খুশিতে নেচে উঠলো। হ্যা, এই ঘুরিটাই তো রুদ্র সেদিন উড়াচ্ছিলো! কিন্তু আজ এটা রুদ্রই উড়াচ্ছে নাকি অন্য কেউ? মনে মনে আল্লাহকে বললো- হে আল্লাহ! ঘুড়িটা যেন রুদ্রই ওড়ায়।
কিছুক্ষনের মধ্যেই ছেলেদের একটা দলকে নিয়ে ঘুরির উদ্দেশ্যে বেড়িয়ে পড়লো রুমন। জেদ করে ওদের সাথি হলো চন্দ্রও।
নদির ধারে একটা মাটির ঢিবির উপরে বসে মনের সুখে ঘুরি উড়াচ্ছিলো রুদ্র। বাতাস একটু বেশি। ঘুরির সুতো টানটান হয়ে আছে। ভিষন ক্ষুধা পেয়েছে। নাহ্! এভাবে ফলমুল খেয়ে কয়দিন আর থাকা যায়? ও ঠিক করলো আজ গোপাল ঠাকুরের কাছে ভাত চাইবে। কিন্তু তরকারি কি চাইবে? গরুর গোসত ওর প্রিয়। কিন্তু সেটা তো ঠাকুরকে বলা যাবে না। হিন্দুরা গরুর গোসত খায় না। অন্য কিছুর গোসত চাইবে কি? কিংবা মাছ? কিন্তু হিন্দুদের খাওয়া দাওয়া বিষয়ে তেমন কিছু জানে না ও। যদি ভুলভাল কিছু চেয়ে বসে তাহলে ধরা পড়ার সম্ভাবনা আছে। তার চেয়ে সবজি জাতিয় কিছু চাওয়াই ভালো হবে। পাট শাক ওর প্রিয়। পাট শাকের সাথে ডাল। হ্যা, পাট শাক আর ডালই চাইবে ও। সাথে কাচা মরিচ। এবার একটু খেতে হবে। ঘুড়িটা মাটির ঢিবির ওপরে ছোট একটা গাছের সাথে বেধে খাবারের সন্ধানে যাওয়ার জন্য ঘুরে দাড়ালো ও। আর সাথে সাথেই চমকে উঠলো। ওর সামনে বড় ভাই রুমন আর চন্দ্র দাড়িয়ে। তাদের পিছনে সব কয়টা মামাতো ভাই যুদ্ধাংদেহি ভাব নিয়ে আছে। ও পালাতে ধরলেই সবাই ওকে ধরে ফেলার জন্য প্রস্তুত।
রুমন বললো- এভাবে পালিয়ে আছিস কেন? তোর জন্য মা খাওয়া দাওয়া ছেড়ে দিয়েছে। শুধু কাদছে। সবাই টেনশনে মরে যাচ্ছে।
চন্দ্র রুদ্রর হাত ধরে বললো- বাড়ি চলো ছোট ভাইয়া। তোমাকে কেউ কিছু বলবে না।
রুদ্র চন্দ্রের কপালে ব্যান্ডেজ দেখে বললো- কতখানি কেটেছে রে?
এবার রুদ্রর মামাতো ভাই ফারহান এগিয়ে এসে চন্দ্রের পক্ষ হয়ে জবাব দিলো- অনেকখানি কেটেছে। দুইটা সেলাই দিতে হয়েছে। সেদিন তোকে পেলে কেউ তোর আস্ত রাখতো না। ওকে ওভাবে কেন মারতে গেলি?
রুদ্র অনুতপ্ত হয়ে বললো- এতোটা লাগবে বুঝতে পারি নি।
রুমন একজনকে ঘুড়ির সুতো গুটিয়ে নিতে বললো। তারপর রুদ্রকে বললো- এ কয়দিন কোথায় ছিলি?
বাড়ি ফিরতে ফিরতে সব কিছু খুলে বললো রুদ্র। রুদ্রর সাহস দেখে সবাই অবাক হলো, আবার গোপাল ঠাকুরের বোকা বনে যাওয়াতে সবাই মজাও পেলো। রুদ্রকে দেখে ফারহানা বেগম ছুটে এসে ছেলেকে জড়িয়ে ধরলেন। ছেলেকে ফিরে পাওয়ার খুশিতে কেদে কেদে বুক ভাসালেন। বাড়ির ছোট বড় সবাই রুদ্রকে ঘিরে ধরলো। সবারই এক প্রশ্ন- এ কয়দিন ও কোথায় ছিলো? রুমন সবাইকে জানিয়ে দিলো এ কয়দিন রুদ্র কোথায় ছিলো আর গোপাল ঠাকুরকে কিভাবে ও বোকা বানিয়েছে। ফারহানা বেগম সব শুনে আতকে উঠলেন। ছেলেকে বললেন- এ সব কেন করতে গেছিস? যদি তোর কিছু একটা হয়ে যেতো?
বোরহান উদ্দিন গম্ভির ভাবে রুদ্রকে বললেন- এভাবে কাউকে বোকা বানানো তোর উচিত হয় নি।
এরপর এক জনকে পাঠিয়ে গোপাল ঠাকুরকে ডেকে আনলেন বোরহার উদ্দিন। ঠাকুরকে কাচারি ঘরে বসিয়ে সব কিছু খুলে বললেন। তারপর বললেন- তোমার সাথে রুদ্র যা করেছে সেটা ওর উচিত হয় নি। ও ছোট, তুমি কিছু মনে করো না।
ঠাকুর কোন কথা বললেন না। মাথা নিচু করে বেড়িয়ে গেলেন। কিছু দিন পরে শোনা গেলো গোপাল ঠাকুর কাশি চলে গেছেন।
একদিন বোরহান উদ্দিন তার চার ছেলে, মেয়ে এবং মেয়ে জামাইকে ডেকে তার ইচ্ছের কথা জানালেন। বললেন- একমাত্র রুদ্রই চন্দ্রের জন্য উপযুক্ত। ওর মতো সাহস আর বুদ্ধি আমাদের অন্য কোন ছেলেদের মধ্যে নেই। অন্যান্য ছেলেদের চেয়ে ওর বয়সই চন্দ্রের সব চেয়ে কাছাকাছি। তাই তোমাদের কারো অমত না থাকলে রুদ্রর সাথে চন্দ্রের বিয়ে দিতে চাচ্ছি। তোমরা কি বলো?
বাবা বোরহান উদ্দিনের কথার উপরে কেউ কোন কথা বলতে পারেন না। আর উনি যা বলছেন সেটাই সবচেয়ে যুক্তি সঙ্গত। চন্দ্রের জন্য রুদ্রর চেয়ে উপযুক্ত ছেলে আর কেউ হতে পারে না। সবাই সানন্দে বোরহান উদ্দিনের কথায় রাজি হয়ে গেলেন। এরও কিছু দিন পরে ধুমধাম করে চন্দ্রের সাথে রুদ্রর বিয়ে হয়ে গেলো। ঠিক হলো দুজনের লেখা পড়া শেষ হলে আর একটা অনুষ্ঠান করে তাদের সংসার জিবন শুরু করে দেয়া হবে।
চলবে.....
পর্ব - ০৬
পর্ব - ০৮
চন্দ্র উপন্যাসের ভুমিকা ও পর্ব সমুহের সুচিপত্র
©somewhere in net ltd.