নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
আমি মানুষের কথা বলি। মানবতার কথা বলি। স্বপ্ন দেখি সমৃদ্ধ বাংলাদেশের। নিরাপদ একটি ভূখন্ডের।
আত্মহত্যা সমস্যাটি শুধুমাত্র বাংলাদেশে নয়। বিশ্বব্যপি এ সমস্যাটি বিরাজমান। তবে এটি এমনই এক সমস্যা যা সমন্বিত কর্মসূচি পালনের মাধ্যমে অনেকটাই কমিয়ে আনা সম্ভব। এটা সত্য স্থান ভেদে সমস্যাটির কারণ আলাদা তবে ষাট ভাগ আত্মহত্যার মুলে কিন্তু একটিই কারণ আর তা হল বিষণ্ণতা। আর এই বিষণ্ণতা নামক রোগটিও নিরাময়যোগ্য। বিষণ্ণতা থেকে মুক্তির রয়েছে উন্নত চিকিৎসা ব্যবস্থা। তাহলে কেন এতদসংখ্যক লোক প্রতিবছর আত্মহত্যার পথ বেছে নেয়, প্রশ্নটি এসেই যায়। সেই সাথে বিষণ্ণতার মুলে কি কারণ সেটিও খুঁজে বের করা প্রয়োজন।
এটা অস্বীকার করার উপায় নেই যে আমরা একটি পরিবর্তিত সময়ের মধ্য দিয়ে যাচ্ছি। যার ফলে সমাজে নানাবিধ সমস্যা তৈরি হচ্ছে যার সফলভাবে উত্তরণ সকলের পক্ষে সম্ভব নয়। এ ক্ষেত্রে যারা ব্যর্থ হচ্ছেন তাদের পাশে এসে দাঁড়ানোর কথা যে পরিবারের। সেই পরিবারটিই যখন বিভ্রান্ত তখন আর উত্তরণের পথ থাকল কোঁথায়?
আমরা পরিবর্তিত পরিস্থিতির সাথে খাপ খাইয়ে নিতে অনবরত ছুটে চলেছি। এই ছুটে চলাটা যদি হত সকল নিয়ে তাহলে হয়ত পরিস্থিতিটা একটু অন্যরকম হত। যদিও সে ক্ষেত্রে গতিটা একটু কম থাকত কিন্তু আমরা একে অপরের পরিপূরক হতে পারতাম। আর সেটি করতে হলে যে ছাড় দেয়ার মানসিকতা প্রয়োজন সেখানেই মূল ঘাটতিটা লক্ষ করা যায়। আমরা প্রত্যেকেই বড় বেশী বৈষয়িক হয়ে গেছি। নিজের লাভলোকসানের হিসেবটা এত বেশী করি যে অন্যের কথা ভাবার সময়ই পাইনা। বৃদ্ধ মা-বাবা একলা হয়ে পড়েছেন, শিশু-কিশোররা একলা হয়ে পড়েছে, তরুণ-যুবারা নিজেদের মধ্যে ডুবে থেকে একলা হয়ে পড়েছে। কর্মজীবীরা যন্ত্রমানবে পরিণত হয়ে একাকীত্বের পথ বেছে নিয়েছেন। এই যে একলা চলা, একলা থাকা, একলা বাঁচার স্পৃহা আমাদের সব্বাইকে একা করে দিয়েছে। স্বাভাবিকভাবেই সবাই আবার একাকীত্ব ঘোচাতে অস্বাভাবিক পথ বেছে নিয়েছে। যাকে অনেক বেশী সহজ করে দিয়েছে তথ্যপ্রযুক্তির সহজলভ্যতা। এমনকি অনেকের মাঝে থেকেও এখন আমরা আলাদা ভুবনে বাস করছি। একই পরিবারের পাঁচ সদস্য খাবার টেবিলে বসেছেন। দেখা যায় কারো হাতে মোবাইল, কারো আইপড, কেউ বা ল্যাপটপের মাধ্যমে অন্য কোথাও চলে গেছে। যদিও শারীরিকভাবে সবাই একই টেবিলে অবস্থান করছিল। অর্থাৎ কারো সাথে কারো ভাব বিনিময় হচ্ছে না।
মা-বাবা অফিস নিয়ে ব্যস্ত, সন্তান লেখাপড়ায়। মোবাইল ছারা কেউ কারো খোজ পর্যন্ত নিতে পারছে না। মা-বাবা যখন বেড়িয়ে যান সন্তান তখন ঘুমোচ্ছে। তারা যখন বাসায় ফিরছে সন্তান তখন ইউনিভার্সিটিতে। যখন সে বাসায় ফিরছে ততক্ষণে মা-বাবা ক্লান্ত শরীরটি এলিয়ে দিয়েছে বিছানায়। সন্তানের সুখ দুঃখ আনন্দ বিস্বাদের সাথে মা-বাবা একাত্ম হবার সুযোগই পাচ্ছেন না বা সেই সুযোগটি তারা তৈরির চেষ্টাও করছেন না।
এই সন্তানের বিষণ্ণতা দায় পরিবার কি এড়াতে পারে? একটি ছেলে বা মেয়ে যখন বিষণ্ণতায় ভুগতে শুরু করে সেটা কিন্তু পরিবারের অন্যান্য সদস্য বিশেষ করে মা বাবার চোখে পড়ার কথা। তার স্বাভাবিক জীবন যাপনে ছন্দপতন তারা কতটুকু খেয়াল করেছেন? কেন শুরুতেই এর প্রতিকারের ব্যবস্থা করছেন না। এই উপেক্ষাও কখনো কখনো সন্তানকে আত্মহত্যায় উব্দুদ্ধ করে।
অভিভাবকের অসচেতনতা, সন্তানের সাথে মা-বাবার দূরত্ব, তাকে পাত্তা না দেয়া, আক্রান্ত ব্যক্তিটির প্রতি সহনশীলতার পরিবর্তে রুঢ় আচরণ ইত্যাদি একটি মানুষকে খুব সহজেই আত্মহত্যায় উৎসাহী করে তুলতে পারে। এর সাথে যখন যোগ হয় আর্থ-সামাজিক নানাবিধ সমস্যা, একাকীত্ব, আত্মহত্যার উপকরণের সহজলভ্যতা তখন এই সমস্যাটি সমাজে ব্যাপকভাবে লক্ষ করা যায়।
আত্মহত্যা যখন একটি সামাজিক সমস্যায় পরিণত তখন আমাদের গণমাধ্যমও একেবারে দায় এড়াতে পারে না। কারণটি হল, একটি মানুষ আত্মহননের পথ বেছে নিলে তাঁর প্রতি সহানুভূতির উদ্রেক হওয়াটা স্বাভাবিক হলেও আমরা যদি এর প্রতিকার নিয়ে চিন্তিত হই তাহলে আত্মহত্যাকারীর প্রতি সহানুভূতি প্রদর্শন না করাই যুক্তিযুক্ত। আমি আজ পর্যন্ত কোন প্রিন্ট মিডিয়ায় আত্মহত্যা জনিত খবরের সাথে আত্মহত্যাকারীর পরিবারের প্রতি সমবেদনা জ্ঞাপন পূর্বক দুটি লাইন দেখতে পাইনি। বরং দেখা যায় প্রতিবেদক এর কারণ অনুসন্ধান করতে গিয়ে এমন কিছু বিষয় তুলে আনেন যেটি অন্যান্য অনেকের সাথেই মিলে যায়। যা অনেক ক্ষেত্রে একই মানসিকতার অন্যান্য মানুষকেও আত্মহত্যায় উব্দুদ্ধ করে তোলে। একটি সংবাদ পরিবেশনের ক্ষেত্রে একজন প্রতিবেদক এর ফলাফল সম্পর্কে একেবারেই দায়িত্বশীলতার পরিচয় দেবেন না তা তো হয় না। যদিও ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় এ নিয়ে ইদানীং কিছুটা আলোচনা শোনা যায় তবে সেটি সামান্যই।
উদাহরনস্বরুপ বলা যায় উত্তরা, ঢাকায় সাংবাদিক দম্পতির দুই সন্তানের আত্মহননের প্রতিবেদনটির কথা। যেখানে প্রায় প্রতিটি পত্রিকায় এসেছে কিভাবে দুই ভাই-বোন আত্মহত্যা করেছে, কেন করেছে। অথচ এর ফলে তাঁদের মা সহ অন্যান্য স্বজনদের যে অবস্থা হয়েছে সেই হৃদয় বিদারক অবস্থার তেমন কোন বর্ণনা আসে নি। আমার কথা হল। মা-বাবার আলাদা থাকা, কাজের চাপে সন্তানদের মায়ের কম সময় দেয়ার ঘটনা আমাদের দেশে অসংখ্য। এখন এই স্টোরিটি কি তাদের দিক নির্দেশনা দিচ্ছে যে তোমরা যারা এই সমস্যায় ভুগছ তাদের জন্য এটা একটি সমাধান হতে পারে! অথচ এই একই ঘটনার পরবর্তীতে ভুক্তভোগী মায়ের অবস্থা তাদের অন্যান্য স্বজনদের অবস্থাকে যদি উপজীব্য করে প্রতিবেদন প্রকাশ করা হত তাহলে হয়ত কিছু সংখ্যক ছেলে-মেয়েও(আত্মহত্যাপ্রবন) এটা নিয়ে নতুন করে ভাবার অবকাশ পেত। এমন কি এই পথ থেকে সরেও আসতে পারত।
ঠিক একই ভাবে আমরা দেখি পরীক্ষায় আশানুরূপ ফলাফলের কারণে, ইভ টিজিংয়ের স্বীকার হয়ে অনেকে আত্মহত্যা করে। উভয় ক্ষেত্রেই দেখা যায় পরিবারের অসতর্কতাই এর জন্য প্রধানত দায়ী। আমার সন্তানকে আমি সারাটা জীবন কেন এটা শেখাই যে, যেভাবেই হোক ভাল ফলাফল করতে হবে নয়ত সব বরবাদ হয়ে যাবে। আমি তো এটাও শেখাতে পারতাম, “চেষ্টা করতে হবে এগিয়ে যেতে হবে কোন কারণে পড়ে গেলে উঠে পুনরায় উঠে দাড়াতে হবে। এটাই জীবন। আশানুরূপ ফলাফল করতে না পেরে যখন সে এমনিতেই বিধ্বস্ত তখন তাঁর উপরে মানসিক নির্যাতন না চালিয়ে বরং তাঁর পাশে দাঁড়ানো, তাকে সাহস যোগানোই আদর্শ অভিভাবকের দায়িত্ব। আমরা কি সে দায়িত্ব পালন করতে পারছি?
যখন আমার মেয়েটি ইভ টিজিংয়ের স্বীকার হয় আমি তাকে কতটা সাহস যোগাতে পারছি? আমি তাকে কেন বোঝাতে পারছি না এত সামান্যতেই ভেঙ্গে পরলে চলবে না বরং আরও বেশী দৃঢ়তার সাথে এগিয়ে যেতে হবে। বর্তমানটাই তোমার একমাত্র জীবন নয় সামনে সুবর্ণ সকাল অপেক্ষায়। আমরা তাকে সে সময়ের স্বপ্নটিই তো দেখাতে পারছি না বা চাচ্ছি না। এ ব্যর্থতার দায় অভিভাবকদেরই।
একইসাথে আমরা আমাদের সন্তানদের কতটা নিজস্ব বলয়ের বাইরে ভাবতে শিখিয়েছি সেটাও ভাবা দরকার। একজন মানুষ যদি প্রকৃতই দায়িত্ববান হয়ে বেড়ে ওঠে। যদি সে এটা উপলব্ধি করতে শেখে যে তাঁর জীবন, তাঁর ভাল মন্দ শুধুমাত্র তাঁর জন্যই নয়। জীবনের উদ্দেশ্য শুধুমাত্র নিজেকে নিয়ে ব্যাপৃত থাকা নয়। বাবা-মা, ভাই-বোন সংসারের অন্যান্য সকল সদস্যের প্রতি তাকে দায়িত্ববান হতে হবে। পরিবার তাকে সাধ্যমত দিয়েছে এটা ফিরিয়ে দেয়া তার কর্তব্য। আর সেটাই মানুষের ধর্ম। তাহলে সে কি করে নিজের সামান্য অপূর্ণতার যেরে বা বঞ্চনার গ্লানি থেকে আত্মহত্যার মত ভয়ংকর স্বার্থপরতার পথটি বেছে নিতে পারে? আত্মহত্যাকারীকে আমি স্বার্থপর এবং অকৃতজ্ঞ এই জন্যই বলব, কারণ সে শুধুমাত্র নিজের বঞ্চনার কথাই ভাবে অপরের প্রতি দায়িত্বকে তুচ্ছ জ্ঞান করে।
আত্মহত্যা মহাপাপ এটা যেমন আমাদের সন্তানদের বোঝাতে হবে তেমনি তাকে দায়িত্ব সচেতন করে গড়ে তোলাটাও জরুরী।
পরিশেষে বলব সচেতন হতে হবে আমাদের অভিভাবকদের। ঘোচাতে হবে সন্তানের সঙ্গে দূরত্ব। গণমাধ্যমকে হতে হবে অনেক বেশী দায়িত্বশীল।
এছাড়াও রাষ্ট্রীয়ভাবে কিছু ব্যবস্থা গ্রহণ প্রয়োজন। যেমন পাঠ্যপুস্তকে আত্মহত্যার কুফল সম্পর্কিত নিবন্ধ সংযোজন, প্রতিটি কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে কাউন্সিলিংয়ের ব্যবস্থা। হাসপাতালগুলোতে হট লাইন স্থাপন যেখানে যে কেউ ফোনে নিজের হতাশার কথা জানাতে পারবে এবং প্রতিকার পাবে। সভা সেমিনার এর মাধ্যমে জনসচেতনতা তৈরি করতে হবে। তবে সবথেকে বেশী জরুরী অভিভাবকদের সচেতন হওয়া। আপনার সন্তান আপনার সম্পত্তি, দেশের সম্পত্তি। তাকে সুস্থ সুন্দরভাবে বেড়ে উঠতে দিন। জীবনে অর্জিত সকল সম্পদ যে সন্তানকে ঘিরে সে-ই যদি আত্মাহুতির পথ বেছে নেয় তাহলে সব কিছুই তো বৃথা। বিষয়টি নিয়ে ভাবুন, ভেবে সিদ্ধান্ত নিন। কোনটি বেশী জরুরী সন্তান না সম্পদ।
[email protected]
©somewhere in net ltd.