নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০

রাজা সরকার

আমি একজন সামান্য লেখক।

রাজা সরকার › বিস্তারিত পোস্টঃ

ফিরে দেখা পথরেখা।

২১ শে নভেম্বর, ২০২৪ বিকাল ৪:৩৮

হাজেরা খাতুন।
রাজা সরকার

সনটা কত হবে ১৯৫৭/৫৮---ওয়ান টু তে পড়ি। গ্রামের ফ্রি প্রাইমারী স্কুল । পড়াশোনায় ডাব্বা টাইপের। অথচ ইশকুলে ভর্তি হওয়ার আগে পড়াশোনা নিয়ে একটা ব্যাপক উৎসাহ ছিল। দাদা দিদিদের পেছন পেছন স্কুলে যেতাম একগাদা পুরনো বই বগলে নিয়ে। কিন্তু ভর্তি হওয়ার পর স্কুলটা আর সুবিধাজনক লাগলো না। স্কুলে যাওয়ার সময় হলেই আজ পেটে ব্যথা, কাল পায়ে ব্যথা করে কাটাই। বাইরবাড়িতে বসে বসে আরো ছোট যারা, তাদের সঙ্গে খেলা। বাইরবাড়ির সামনে দিয়েই গেছে আমাদের স্কুলে যাওয়ার রাস্তা। ছেলে মেয়েরা স্কুলে যায়। কেউ কেউ জিগায় ---কীরে ইশকুলও যাইতে না ? আমি উত্তর দেই না। চুপ করে থাকি। ক্লাসে ফার্স্ট হয় পশ্চিম পাড়ার মেয়ে হাজেরা খাতুন। সেও যায়। আমায় দেখে মিটিমিটি হাসে। জিগায়--কীরে অহনো মাডিত গড়াইতাছস্‌--- ইশকুলও যাইতে না? ( কীরে এখনও মাটিতে গড়াচ্ছিস, ইশকুলে যাবি না?)
আমি উত্তর দেই না। হাজেরা ও তার সঙ্গীরা আমার অবস্থা দেখে খিল খিল করে হাসে। হাসতে হাসতে চলে যায়। অন্য যে কেউ জিগাইলে যেমন তেমন। কিন্তু হাজেরা জিগাইলে ব্যাপারটা খুবই লজ্জার। খেলার তালে ওদের আসার সময়টা খেয়াল করিনি বলে অনুশোচনা হয়। মন খারাপ নিয়ে খেলতেই থাকি। মনে মনে হাজেরা খাতুনকে বকি, বলি--অত জিগানোর কী আছে ইশকুলে যাওয়া নিয়া---নিজে ভালো ছাত্র তো----। আবার ভাবি, কী ভাবে ও এত ভালো ছাত্র হয়! কী ভাবে অংকে একশর মধ্যে একশ পায়। বানান ভুল করে না। পরীক্ষার ফল বের হলে কী সুন্দর হাসতে হাসতে বাড়ি ফেরে। সেদিন আর আমার দিকে তাকায় না পর্যন্ত। আমি তার বেণী দুলিয়ে তর তর করে বাড়ি ফেরার দৃশ্য দেখি। আর আমার মুখে নেমে আসে রাজ্যের বিষাদ । তখন দৃশ্যমান কিছুই আর ভালো লাগে না। ফিরতে ফিরতে মনে হয়, কত কত কৈফিয়ত তলব যে আমার জন্য বাড়িতে অপেক্ষা করে আছে, কে জানে! শুধু কি কৈফিয়ত তলব---মাঝে মাঝে প্রহারও জুটে যায় কত অবলীলায়। তখন মনে হত আহা, যাদের পড়ালেখা, পরীক্ষা---এই সব নাই, তাদের মত জীবন আমার কেন হয় না !!

এই ভাবেই স্কুলের পরীক্ষার সূত্রে আমার লাঞ্ছনা আর হাজেরার খাতুনের ফার্স্ট হওয়া আমার কাছে ক্রমে দুঃস্বপ্ন হয়ে উঠে। তার উপর আমার ঠাম্মা, যাঁর প্রশ্রয়ে আমার ইশকুল কামাই বা সন্ধেবেলা পড়তে বসলেই ঘুম পাওয়াটা সহজ হয়ে যেত, তিনিই মাঝে মাঝে বলতেন,'---হাজেরা মাইয়াডা একটা মাইয়া হইয়া ফাস্টো হয় আর তুই বেডা অইয়া কী করছ---যা অর পা ধুইয়া জল খা গা।'
এত চরম অপমান ! মাইয়া বইলা আরো অপমান বেশি গায়ে লাগার কথা ! কিন্তু আমার মনে বেশিটা আর লাগে না। বরং মনে প্রশ্ন জাগে, মাইয়া অইছে তো কী অইছে ! আমি বেডা অইছি তাতেই বা কী অইছে !

ঠাম্মা যে সেই সময়ের সামাজিক ধারণা অনুসারে পুরুষকে নারীর থেকে অনেক শ্রেষ্ঠ মনে করেন, তার রহস্যের জট সেই বয়সে আর খুলতে পারি না। বেডা অইয়াও আমার পড়তে ভালো লাগে না। ইশকুলে যাইতে মন চায় না। পড়তে বসলে ঘুম পায়। পরীক্ষার সময় কপালে দইয়ের ফোঁটা নিয়ে ইশকুলে যাইতে আমার খুব লজ্জা করে। হাজেরার সামনে পড়ার ভয়ে আমি বাড়ির থেকে বেরিয়েই কপালকে দই মুক্ত করে ফেলি। ফলে পরীক্ষার প্রশ্ন বরাবরই আমার কাছে খুব কঠিন মনে হয়। ফলে ফার্স্ট হওয়া দূরে থাক, ভালো ভাবে পাশ পর্যন্ত করতে পারি না! খুব দুষ্টুমি করলে ঠাম্মা একটা কথা বলতেন---'এই দিন দিন নারে, আরো দিন আছে'। উনি আমাদের ক্রীড়াপ্রিয়তাকে উদ্দেশ্য করেই হয়তো কথাটা বলতেন যে, সামনের দিন কিন্তু খুব কঠিন আসছে। পড়, পড়াশোনা ঠিক মত কর। কিন্তু সেই সব দিনে আমাদের এইসব নীতিকথা দিয়ে ভেজানো যেত না। যতক্ষণ না পিঠে মা বা বাবার রুক্ষ প্রহার নেমে আসতো। কিন্তু যত যাই হোক হাজেরাকে আমি আমার মানসপট থেকে কিছুতেই সরাতে পারছিনা।

ক্লাস ফাইভ পর্যন্ত আমরা শেষ এক ক্লাসেই পড়েছি। ততদিনে আমাদের শরীর মন আরো কিছুটা পোক্ত হয়েছে। আমরা সবাই এক আধটু লম্বা হয়েছি। হাজেরাও যেন বড় হয়েছে। শান্ত হয়েছে। গায়ের শ্যামলা রঙ উজ্জ্বল হয়েছে। আমিও যেন আর ততোটা ঈর্ষাও করি না তাকে। হাজেরার ফার্স্ট হওয়া মেনে নিয়েছি। তাতে আমার কোনো অসুবিধা হয় নি। তার পা ধোয়া জল খাওয়ার দরকার হয় নি। ঠাম্মাও বোধহয় আর বলেননি সে-কথা। শিশুমন কৈশোরের রহস্যচোখে তখন সবকিছু দেখতে চাইছে । ফাইভের পরীক্ষায় হাজেরা খাতুন যথারীতি ফার্স্ট হয়েছে। আমিও খুব খারাপ করিনি। আমাদের সমাজ ফ্রী প্রাইমারী স্কুলে পড়া এখানেই শেষ হয়ে গেল। ফলপ্রকাশের দিনই হাজেরাকে বোধ হয় শেষ দেখলাম। মনে হয় সেটা ১৯৬২ সাল। হাই স্কুলে পড়ার জন্য আমি নেত্রকোণায় চলে এলাম। এসে দত্ত হাই স্কুলে ভর্তি হয়ে গেলাম ক্লাস সিক্সে। একটা বড়সড় দৃশ্যান্তর ঘটে গেল। গ্রামের পানাপুকুর থেকে উঠে আমি নেত্রকোণার টলটলে জলের বড় দিঘির পাড়ে চলে এলাম। নেত্রকোণা দিয়েই শুরু হলো আমার শহরবাস।

এরপর ঘটে যাবে অনেকানেক ঘটনা। অনেকের মত আমার পৃথিবীও ওলোটপালট হয়ে যাবে। চেনা পৃথিবীটা আর চেনা থাকবে না। নেত্রকোণা থেকে কখনো গ্রামের বাড়িতে ফিরলেও তাড়িত সময়ের ঝাপটায় অচেনা পৃথিবীর সঙ্গেই কথা হয়। তারমধ্যে হাজেরা খাতুন আসে না। এরমধ্যেই একদিন দেশান্তর ঘটে গেল আমার। অতঃপর ১৯৬৪ সাল থেকে পশ্চিমবঙ্গের শিলিগুড়িতে । কৈশোর পেরিয়ে ক্রমে বয়ঃসন্ধি। সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে চলে শরীর। টের পাই সময়ের গতিময়তা । পেছনে পরে থাকে নীরবে ফোটা ফুলের মত শৈশব, খেলার সাথি, পড়ার সাথিদের ম্লান মুখ। বিস্মরণের ঢেউয়ে তারা টিকবে কি টিকবে না ভেবে যেন মাঝে মাঝে উঁকি দেয় মানস পটে। সেইখানে কেন জানি একটি একটি আবছা মুখের নির্বাক চাহনি, শেষপর্যন্ত যেন থেকেই যায়।


কমবেশি পঞ্চাশ বছরের ব্যবধান। আমি ষাটোর্ধ। পাসপোর্ট করেছি। পরিহাসের মতো সেই পাসপোর্ট হাতে করে নিজের জন্মস্থানে গেছি বেড়াতে ২০১৪ তে। সেখানেই ঘুরতে ঘুরতে এসে একদিন দাঁড়িয়েছি সেই পশ্চিম পাড়ায়। পাড়াটির নাম অমৃতপুর ওরফে আমিত্তিপুর। এই পাড়ার দুজনই আমার সঙ্গে পড়তো। একজন শামছুদ্দিন, যে কিছুদিন আগে মারা গেছে। আরেকজন হাজেরা খাতুন। সেদিন সঙ্গে আমার পরিণত বয়সের যুবক ভাগিনেয়, যে মাঝে মাঝে বলছে--মামা এই পাড়ার আর কার কার কথা তোমার মনে আছে? সামনে পাড়ার চায়ের দোকান। জমজমাট ভিড়। ছোট বড় বয়সের আড্ডারত ক্রেতা সব পাড়ারই । ভাগনে আমাকে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছে কারো কারোর সঙ্গে। অর্ধ শতাব্দীর অন্তর ঘটে গেছে। শ্রীমন্তপুর আর আমিত্তিপুর পাশাপাশি গ্রাম। আমাদের বাড়িটা তখন বড়বাড়ি নামে খ্যাত ছিল। বাবার নাম, বড় দাদাদের নাম ইত্যাদি বয়স্কদের সকলেরই মনে পড়ছে । কিন্তু ছোট্ট এগার বার বছরের পড়াশোনায় অমনোযোগী বালকটির কথা মনে কী করে থাকে! না থাকাই স্বাভাবিক। তখন ওই বয়সের না হলেও এক ডজন বালক ছিল আমাদের বড়বাড়ির। বড়বাড়ি বলতে মূল চার শরিকের ঘরবাড়ি। যা বাড়তে বাড়তে একটা গ্রামের প্রায় অর্ধেক ছিলাম তখন আমরাই ।

তখন সবার সামনে হাজেরার কথাটা বলতে খানিক সংকোচ হচ্ছিলো। কিশোরী হাজেরা ফার্স্ট হয়। আর আমার ঠাম্মার 'বেডা বেডি' (পুরুষ নারী) তত্ত্বের জন্য আমার শৈশবের লজ্জা যেন মুখ দেখায়। তবুও নামটা বললাম। চিনতে পারলো না কেউ। পাঁচ দশকের ব্যবধানে গ্রামের সেই ছবিটিও আর নেই। তবে চায়ের দোকানে আমাকে বসিয়ে ভাগনে তার পরিচিতজনদের জিজ্ঞেস করে করে কিছুক্ষণের মধ্যেই খোঁজ নিয়ে আসলো। খোঁজ পাওয়া গেল যে হাজেরার অনেককাল আগে বিয়ে হয়ে গেছে। বিয়ে হয়ে গ্রাম থেকে সে চলে গেছে অনেকদিন আগে। প্রায় চল্লিশ বছরের বেশি সময়। ওদের পরিবারের নিকটজন আর কেউ এই গ্রামে থাকে না। খবরাখবর শুনে পুরোটাই একটা বিচ্ছেদী সুর হয়ে গেল যেন। হতাশ হলাম। থাকলে এতদিন সেও আমার মত ষাটোর্ধই হতো। দেখলে কি চিনতে পারতো? মনে করতে পারতো কি গুটি গুটি পায়ে হেঁটে যাওয়া প্রাইমারী ইশকুলের দিনগুলোর কথা ! কী জানি মানুষের হয়তো আমার মতো পুরানো কথা কুড়নোর বদ অভ্যাস নেই। কিন্তু এড়ানো গেল না ভাসা ভাসা চোখের কিশোর কিশোরীদের । সবার অলক্ষ্যে টের পেলাম টুপ টুপ করে পথপার্শ্বের বড়ই (কুল) গাছ থেকে লাফিয়ে পড়তে লাগলো সেই কিশোর কিশোরীরা আমার সামনে। রিণ রিণে গলায় কেউ যেন বলতে লাগলো ---অহনঅ খেলতাছস--- ইশকুলঅ যাইতে না---হি হি।

ফিরছিলাম বাড়ির দিকে। সম্বিত ফিরল ভাগ্নের ডাকে। মামা চিন্তা করুইন্যাযে---তাইনের খোঁজ আমি বাইর করবামই। ভাগ্নের কথা শুনে আমি সামান্য হাসলাম। মনে মনে ভাবলাম এই বয়সে হারিয়ে যাওয়া অংশটাই তো বেশি। কী হবে আর খুঁজে !

হাজেরা খাতুন এই মুহূর্তে একটি নাম মাত্র। ধুলো মাটি নিয়ে খেলার দিন থেকে অনেক দূরের একটি নাম। অথচ কী অদ্ভুত, সুদীর্ঘ এই সময় পরিক্রমণের শেষে এসে তাকেই খুঁজি। কেন খুঁজি, আমি কি আর তাকে চিনি? মুখও তো মনে নেই। বালিকা বয়স থেকে তাঁর মহিলা হয়ে ওঠার কাল---এই সংসার জীবনের আবর্তে তাঁরও কি আর শৈশবের কথা মনে রাখার ফুরসত ছিল ! আর থাকলেই বা কি, কিছুই জানা নেই বা জানার উপায়ও নেই।

ইতিহাস কি জানে! মানুষের অলিখিত ইতিহাসের কি সংগ্রহ আছে কোনো! সেরকম কোনো ইতিহাসের কাছে কি কোনো সাক্ষ্য আছে তাঁর ! তাও জানা নেই। প্রচলিত মান্য ইতিহাসের কাছে হয়তো দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর সময়, সময়ান্তরের মূল্য আছে। মূল্য আছে প্রভাবী, খ্যাতিমান ব্যক্তিত্বদের। আমি সামান্য মানুষ। হতভাগাও বটে। জন্মের মাটি যারা হারিয়ে ফেলে তারা তো হতভাগাই। ইতিহাসের ধুলোমাটির মত দেশান্তর, দৃশ্যান্তর, ও সময়ান্তরের চিহ্নগুলো আঁকড়ে থাকা শ্যাওলার মত---এ এক নিগূঢ় জন্মান্তরের মত।

হাজেরারও হয়তো এই সকল অতিবাহিত আবর্তের ভেতর নতুন করে জন্ম হয়েছে। তাই রিণ রিণ করে আমারো যেন তাকে ডাকতে ইচ্ছে হচ্ছিলো। কিন্তু ওই যে লজ্জা---। ওই যে অর্ধশতকেরও বেশি সময়, অনেক বাঁক, অনেক দৃশ্যান্তর, জন্মান্তরের পরও---একই রকম---।লজ্জার কি কোনো বয়স নেই---! অথচ জানতে ইচ্ছে হচ্ছিলো কোনোদিন ওই দক্ষিণ বরাবর দিগন্তজোড়া শস্যক্ষেতের কোথাও কি আমরা অনামী ঘাসের বীজের মতোই ঝরে পড়েছিলাম ! থেকে গিয়েছিলাম ! কখন, কোন মুহূর্তে, কেনই বা! আজ এই এক আশ্চর্য সমাপতনের মত কেনই বা আমি আজ এই পশ্চিম পাড়ায় দাঁড়িয়ে---সময়ের পাতা উলটে উলটে আমি কি সেই দিকেই চলে গেলাম যার প্রায়শই কোনো হিসেব থাকে না।

ক'দিন পর ভাগ্নের কথা।---মামা, লইন আইজ আফনেরে তাইনের লগে কথা কওয়াইয়া দিয়াম। এই কথা-বলিয়ে দেয়াটা যে সে এমন কর্তব্য হিসেবে নিয়েছে আগে বুঝিনি। গত ক'দিন মনে হয় আমার থেকে ও-ই বেশি হাজেরা খাতুনের কথা ভেবেছে । যেহেতু সে এখানকার আশৈশবের বাসিন্দা, তাই তার চেনাশোনা অনেক। উপরন্তু শিক্ষক হওয়ার দরুন সামাজিক শ্রদ্ধা সম্মান তার স্বাভাবিক অর্জনের মত। আর সেই সুবাদেই সে এই ক'দিনের মধ্যে সন্ধানসূত্রটি আবিষ্কার করে ফেলেছে। সেই সন্ধানসূত্র হলো স্থানীয় বাজারের একটি ওষুধের দোকানের মালিক;যে হাজেরার বোনপো হয় । যথা সময়ে তাই মামাসহ সে আজ সেখানে উপস্থিত। যুবক বোনপো হাসিমুখে আমাকে একটু মনযোগ দিয়ে দেখলো ও আপ্যায়ন করলো। হয়তো মনে মনে ভাবলো আমার বয়স্কা খালার সাথে এই বয়স্ক মানুষটির কী কথা থাকতে পারে ! ভাগ্নে হয়তো তাকে বলেছে বৃত্তান্তটা। বৃত্তান্ত যাই হোক বা বাল্যকালের ইশকুলের সাথীই হোক, এতকালের কথা কেউ মনে রাখে!! বোনপোরও যেন বিষয়টায় কিছুটা উৎসাহ আছে মনে হলো।

বয়সের কারণে আমি সেখানে মুরুব্বি। তাই আমাকে সেই দোকানে বসতে দেয়া বা এক কাপ চায়ের ব্যবস্থা নিষেধ সত্ত্বেও তারা করে ফেললো। অতঃপর চলতে লাগলো ফোনের পর ফোন । একসময় শোনা গেল বোনপো বলছে---আরে না না মুরুব্বি মানুষ----ইন্ডিয়া ইন্ডিয়াত্তন আইছে---হ হ শ্রীমন্তপুর---আরে কী কইন---না না। এরকম কথা চলতে একসময় বোনপো সফলও হলো এবং হাসিমুখে ফোনটা আমার দিকে বাড়িয়ে বললো---নেন আঙ্কেল, কথা কন খালার লগে।

ফোনটা হাতে নিয়ে আমি কিছুটা নার্ভাস ফিল করলেও এদের সামনে আর ইতস্তত করলাম না। যথাসম্ভব স্মার্ট হয়েই জিজ্ঞেস করলাম---হ্যালো, হাজেরা খাতুন?
---হ, আফনে কেডা? একটু ভারি ও হাস্কি গলা। বোঝা গেল আমাদের উভয়েরই বয়স বেড়েছে।
---আমার নাম বললে তো এখন আর চেনা যাবে না। আমি শ্রীমন্তপুরের, বড়বাড়ির, আমরা একসঙ্গে সমাজের ইস্কুলে পড়তাম । সমাজের ইস্কুলের কথা মনে আছে?
---হ হ সমাজের ইশকুলের কথাত মনে আছে, কত আগের কথা---
---হ্যাঁ, অনেক আগের কথা
---আফনেরে ত চিনতাম পারতাছি না
---চেনার বা মনে রাখার সুযোগ কোথায়---প্রায় পঞ্চাশ বছর আগের কথা---আমার ডাক নাম ছিল 'ভুনু'---মনে থাকার কথা না। যাই হোক, তোমার নাম আমার বেশ মনে আছে 'হাজেরা খাতুন'। ক্লাসে ফার্স্ট হতে প্রতিবার মনে আছে? আমাদের বাড়ির সামনে দিয়েই তো স্কুলে যেতে প্রতিদিন--
---হ হ একটু একটু মনে পড়তাছে---আফনে কি অহনও শ্রীমন্তপুরেই থাহেন---কথা শুইনা যেন কেমন মনে হয়--
---ঠিকই বলেছ---তবে আমাকে 'আফনে' করে বললে তো হাজেরার সঙ্গে কথা বলছি বলে মনে হচ্ছে না
---অ আইচ্ছা আইচ্ছা---
---আমি তো এখন কলকাতায় থাকি। দেশ ছেড়ে গিয়েছিলাম ১৯৬৪ সালে, ক্লাস সিক্স পাশ করার পর। সমাজের ইশকুলের পর একবছর নেত্রকোণায় পড়েছিলাম। ক্লাস ফাইভের পর বোধহয় আমাদের আর দেখা হয় নাই।
---হ হ কেমন যেন লাগতাছে---সবই কেমন আবছা মনে অইতাছে---তোমার এত কথা মনে আছে কিবায়---মুখ তো মনে নাই ভাই
---ঠিকই, আমারও খুব আবছাই মনে হয়
---এত আবছা মুখ মনে লইয়া বইয়া রইছ---আমার খুঁজ করতাছ ভাই---কেমন যেন মনে অইতাছে--
---আমি তো ভাবছিলাম আমিত্তিপুর গেলেই তোমার খোঁজ পাব আর দেখা করে আসব।
---না রে ভাই অনেকটা দূরেই আমার বিয়া অইছিল---অহন তো এই ছুডু মাইয়ার বাড়িত আছি---অর সন্তান অইছে---মাইয়া সন্তান
---বাহ্‌ , খুব ভালো---তোমার ছেলেমেয়ে ক'জন
---আমার চাইর ছেলে আর দুই মাইয়া---চাইর ছেলে পড়ালেখা শেষ কইরা চাকরি করে---বিয়াও দিছি। বড় মেয়ে ঢাকায় থাকে স্বামী পোলাপান লইয়া। আমার স্বামীর ইন্তেকাল অইছে বছর পাঁচেক অইল---অহন তো আমার খালি ঘুরন--- আইজ এর বাড়ি, কাইল ওর বাড়ি---এই ত ছুডু মাইয়ার বাচ্চা হওনের সময় আইছি--- টাঙ্গাইল।
---আমিত্তিপুরে আর আসনা?
---না, আর যাওন হয় কই। অনেকদিন আগে একবার গেছিলাম---আমরার ত কেউ তেমন নাই ওইহানে---
---হ্যাঁ, তোমার খোঁজ নিতে গিয়ে আমিও তাই শুনছি
---হায় আল্লাহ--তুমি আমিত্তিপুরে গিয়া আমার খুঁজ করছ----আহারে---
---হ্যাঁ--আমি ভেবেছিলাম যে তুমি আমিত্তিপুরে না থাকলেও অন্তত খোঁজটা পাওয়া যাবে
---আইচ্ছা আইচ্ছা---ভালাই করছ----তা তোমার পরিবারের কথা কও শুনি---
---আমার এক-ই মেয়ে। বিয়ে হয়ে গেছে। বিদেশে থাকে স্বামীর সঙ্গে---
---নাতি নাতনি---
---নাই এখনও
---আর বউ
---হ্যাঁ, আমার এক বউ--
---হা হা হা --কও কি----আরও আছিল নাহি !!
---না না রসিকতা করলাম---
---বউরে নিয়া আইছ নাকি
---হ, নিয়াই আইছি---আইবা নাকি একবার এইবর---দেখা সাক্ষাৎ হইত
---না রে ভাই, ইচ্ছা থাকলেও উপায় নাই---তুমার দেহি এইহানকার ভাষা মনে আছে---
---হ্যাঁ, কিছু কিছু আছে---সবটা না পারলেও---দেখা হলে না হয় এই ভাষাতেই কথা কইতাম---
---নারে ভাই---আফশোস---অহন কি আর মন চাইলেই যাওন যায়---সংসারের বান্ধন---ছেলে মেয়ের----
---যাক্‌, ভালো লাগল শুনে যে আসতে না পারলেও তোমার ইচ্ছাটা আছে--
---ইচ্ছা তো থাকেই---কতকিছু ইচ্ছাইতো আছিল---অহন এই যেমন তোমার লগে কথা---কথা কইতাছি---মানুষটারে মন নাই---ভুইলা যাওয়া মানুষটারে দেখতাম---কোনোদিন কি ভাবছিলাম কোন যুগে সমাজের ইস্কুলে পড়ছিলাম---তুমি মনে করায়া দিলা---কী যে ভালা লাগছে শুইনা---
---যাক, আজ অন্তত কথাটা যে বলতে পারলাম এটাই আমার অনেক পাওয়া
---হ, উপরওলার দোয়া থাকলে বলা তো যায় না একদিন সাক্ষাৎও হইয়া যাইতে পারে
---ভালো বলছ, আশা করেই তো এতকাল পরে দেখা না হোক, কথা ত হলো--কী বল !
---হ ঠিকই---আইচ্ছা ভাই অহন ফোন রাখি---বাইচ্চাকাইচ্চারা বড় হৈ চৈ লাগাইছে
--ঠিক আছে, ঠিক আছে, খুব ভালো লাগলো তোমার সঙ্গে কথা হওয়াতে। ভালো থেক।

আমার কথা শেষ হওয়ার আগেই বোধ হয় ফোন কেটে গেল।

এদিকে ভাগ্নে আর বোনপোয়ের দুজনের দুই জোড়া চোখ যে এতক্ষণ আমার উপর নিবদ্ধ ছিল বুঝিনি। স্মিত হাসির পর বোনপো জিজ্ঞেস করলো---কথা হইল আঙ্কেল?
---হ্যাঁ হইল তো কথা।
---এতদিনের কথা আফনের মনে আছে কেমনে?
এর তো কোনো উত্তর হয় না। তবুও বললাম---আমার মত তোমার বয়স হলে দেখবে তোমারও মনে আছে কিছু কিছু।
---খালা কি আফনেরে চিনতে পারল
---পরিষ্কার করে চিনতে পারা তো সম্ভব নয়---প্রায় পঞ্চাশ বছরেরও বেশি সময়--তবে ধারনা করে নিতে পারলেন বলে মনে হলো।
---খালার সাথে বলতে গেলে অহন আমরারই তো দেখা হয় না---খালি কারুর বিয়েশাদী লাগলে কখনও কোথাও হঠাৎ দেখা হইয়া যায়।
---ঠিকই---
---আইচ্ছা আঙ্কেল একটা কথা জিগাই---আফনেরা দেশ ছাইড়া গেলেনগা ক্যান---থাকলে ভালা অইত না?

এই প্রশ্নের উত্তরের বদলে ফিরে আসার সময় আমি হাসলাম।
বললাম--- তুমি ছিলে বলেই কথা বলা গেল--অনেক ধন্যবাদ তোমাকে, ভালো থেক।


মন্তব্য ২ টি রেটিং +১/-০

মন্তব্য (২) মন্তব্য লিখুন

১| ২১ শে নভেম্বর, ২০২৪ সন্ধ্যা ৬:২১

রাজীব নুর বলেছেন: কেউ ইচ্ছা করে দেশ ছাড়েনি। দেশ ছাড়তে বাধ্য হয়েছিলো।

২১ শে নভেম্বর, ২০২৪ রাত ৯:২২

রাজা সরকার বলেছেন: বলেছেন: অনেক বছর পর ব্লগে এলাম। আপনাকে বেশ চেনা মনে হলো। আপনার মন্তব্য খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। ভালো থাকবেন।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.