নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
দুঃখের কবিতাই শ্রেষ্ঠ কবিতা। ভালোবাসা হলো দুঃখ, এক ঘরে কবিতা ও নারী।
আকাশযাত্রা - এখানে প্রথম পর্ব - অবতারণা
দ্বিতীয় পর্ব - রামালার প্রেম
রামালা স্কুলজীবন থেকেই গানে নাম করেছিল। স্কুলের যে-কোনো কালচারাল ফাংশানে ওর গান ছিল মূল আকর্ষণ। শুধু আমাদের স্কুলেই না, অন্যান্য স্কুলেও ওকে আমন্ত্রণ করে নিয়ে যাওয়া হতো, আর থানা সদরে সম্মিলিত ফাংশনগুলোতে ওর জন্য শুধু আমরা সহপাঠীরা না, আমাদের পুরো স্কুলই গৌরব বোধ করতো।
স্কুল সেকশন পেরিয়ে যখন কলেজে উঠলো রামালা, ওর নামডাক আরো বহুগুণ বেড়ে গেল। স্থানীয় ক্লাবগুলোতে মাঝে মাঝে শহর থেকে বড়ো শিল্পী এনে সঙ্গীতানুষ্ঠানের আয়োজন করা হতো। সেখানে অবধারিতভাবে রামালার ডাক পড়তো। মজার বিষয় হলো, আমন্ত্রিত শহুরে শিল্পীদের দু-চারটা গানের পরই দর্শক সারি থেকে সমস্বরে ‘রামালা’ ধ্বনি উঠতো। রামালা একবার স্টেজে উঠলে সেদিন অন্য শিল্পীরা ফ্লপ হতো।
সে সময়ে আমরা আজকের মতো ‘সেলিব্রেটি’ শব্দটার সাথে বহুল পরিচিত ছিলাম না, আমরা ‘তুমুল নামডাক’ শব্দটা ব্যবহার করতাম, যার সাথে আজকের ‘সুপার সেলিব্রেটি’ শব্দটাই প্রযোজ্য।
যে-কোনো গানের আসরে রামালা আমাকে সঙ্গে নিত। ওর পাশে আমাকে বসিয়ে গান গাইত। বলাই বাহুল্য, রামালার পাশে বসতে পারা আমার জন্য অজস্র সুখ ও আনন্দের ছিল, ভালো লাগতো খুব, এবং এই ভেবে গর্ব হতো যে রামালার মতো একটা মেয়ের সাথে আমার সখ্য বা ঘনিষ্ঠতা আছে। এ নিয়ে আমার অন্য বন্ধুরা ঠাট্টা-মশকরা কম করতো না; কেউ কেউ গোপনে গোপনে হিংসাও করতো, তা ওদের চোখ ও আচরণ দেখেই বোঝা যেত।
২
একদিন রামালা ক্লাসে এলো শাড়ি পরে। ছাত্ররা মুগ্ধ হলো, খুব করে রামালার দিকে তাকালো, প্রকাশ্যে বা চোরা চোখে। মেয়েরাও কম তাকালো না ওর দিকে, এবং আমাকে শুনিয়ে শুনিয়ে ওর খুব প্রশংসা করলো ওরা। মেয়েদের এরূপ তীর্যক রসালো ঠাট্টাবাক্যে আমি অবাক হলাম। তাহলে কি ওরা জানে, আমি রামালার প্রেমাসক্ত? আশ্চর্য তো! আমার কোনো আচরণে আমি নিজেও টের পাই নি রামালার প্রতি আমার কিছু দুর্বলতা আছে। যতটুকু আছে, তা যে-কোনো ছেলের যে-কোনো মেয়ের প্রতিই আছে। তাহলে? তাহলে রামালাই হয়ত সখীদের সাথে তার প্রেমের কথাটি আলোচনা করে থাকবে।
ক্লাস ছুটি হলে হইচইকরে আমরা বাড়ি ফিরছিলাম। আমার বাড়ি উত্তর দিকে, রামালারা দক্ষিণ দিকে যায়। আমি হই-হুল্লোড়ের ভিড়ে বন্ধুদের সাথে গলাগলি করে, হেলেদুলে হাঁটছি। হঠাৎ পেছন হতে লম্বা স্বরে ‘সোনারু’ বলে দুটো ডাক শোনা গেলে আমি ঘুরে তাকাই, দেখি রামালা হাত উঁচু করে ডাকতে ডাকতে আমার দিকে ছুটে আসছে। বাতাসে ওর ক’গোছা চুল মাথার দু’পাশে দুলছে। হাসিমুখে এগিয়ে আসছে আমার দিকে। আমি অবাক হই না, কারণ, রামালা আমাকে এভাবেই হঠাৎ হঠাৎ ডেকে থাকে; অবাক হলো না আমার সহপাঠীরাও; ওরা এরকম প্রায়শ দেখে থাকে, তাই ওরা যথারীতি দু’পাশে সরে গিয়ে গালিচা-অভ্যর্থনার পথের মতো মাঝখানে রামালার আসার পথ করে দিয়ে দাঁড়িয়ে পড়লো।
আমার হাত ধরে রামালা বললো, ‘যাবি? যাবি না? চল যাই।’ বলেই রামালা আমাকে হনহন করে টেনে নিয়ে চললো। আমার সহপাঠীরা এবার অবাক হয়ে আমাদের দিকে তাকিয়ে থাকলো, যেভাবে প্রতিবার ওরা অবাক হয় আর আমার চোখ বরাবর কিছু ঈর্ষার ধারালো তীর ছুঁড়ে মারতে থাকে; কারণ, আমি রামালার মতো সুন্দরী গায়িকার ভাগ্যবান পাণিগ্রাহী।
আমরা চলতে চলতে, চলতে চলতে, দ্রুত চলতে চলতে বাড়িমুখো তামাম ছাত্রছাত্রীকে পেরিয়ে কোথায় যেন চলে গেলাম! আমাকে টেনে নিয়ে আগে আগে হাঁটছে রামালা, মন্ত্রমুগ্ধের মতো, কিংবা নির্বোধ কিংবা অন্ধের মতো আমি ওর পেছনে ছুটছি। এতক্ষণ চেনা পথ ধরেই হাঁটছিলাম; সে পথ ছাড়িয়ে হঠাৎ অচেনা পথের শুরু। আমরা ছুটছি, কোথায় কোন গৃহের পানে রামালা আমাকে টেনে নিয়ে যাচ্ছি, আমি জানি না। রামালাকে সে-কথা জিজ্ঞাসা করি, সে-ফুরসৎ হয় না। বড়ো আলোখেলা রাস্তা থেকে আমরা গাছঢাকা অন্ধকার সরু একটা রাস্তায় নেমে গেছি। হ্যাঁ, অন্ধকার! আবছা অন্ধকার থেকে আমরা ঘন অন্ধকারের সুড়ঙ্গে ঢুকে পড়লাম। আমরা ছুটছি। কী নেশায়, কার হাতছানিতে ছুটছি এখনো জানি না। ছুটতে ছুটতে হঠাৎ অন্ধকার ভেদ করে সরু রাস্তা পার হয়ে সামনে আলোর প্রান্তর। এ আমরা কোথায় এলাম! আশ্চর্য সুন্দর দিগন্তবিস্তৃত মাঠ। আমরা দাঁড়ালাম। আমাকে ছেড়ে দিয়ে রামালা অবাক হয়ে সামনে দৃষ্টি মেলে তাকিয়ে আছে! কী সুন্দর হৃদয়গলানো নিসর্গ! এতবড়ো মাঠ আগে দেখি নি কোথাও। আমাদের দু’পাশে গ্রামের সারি লম্বা হয়ে বহুদূর চলে গেছে। সামনে ঘাসবিছানো মাঠ ধু-ধূ দূরান্তে আকাশের ছাউনি যেখানে মাটিতে মিশেছে, সেখানে গিয়ে ডুবে গেছে। উপরে আকাশ সাঁঝের রঙে রঙিন হয়ে উঠেছে। রামালা দু’হাত মেলে ধীর পায়ে সামনে এগিয়ে যাচ্ছে। ‘বুক ভরে যাচ্ছে ঠান্ডায়, তাই না সোনা?’ ঝিরঝিরে বাতাসে প্রাণ জুড়িয়ে যায়, রামালা ঠিকই বলেছে। ‘আয়। আয় না সোনা’। ধীর পায়ে সামনে এগিয়ে যেতে যেতে আমাকে ডাকে রামালা।
হঠাৎ ঝমঝম করে বৃষ্টি ঝরে পড়লো। আসমানে তাকিয়ে অবাক হয়ে যাই। কোথা থেকে কখন মেঘ জমলো আকাশে? আকাশ কালো হয়ে গেছে। তাইতো পথের ভেতরটা এত অন্ধকার ছিল, আমি মোটেও বুঝতে পারি নি।
দু’দিকে ডানা মেলে বৃষ্টিতে ভিজছে রামালা। ভালো লাগছে আমার। আমার অনেক ভালো লাগছে। আমিও দু’দিকে ডানা মেলে দিই। এই বৃষ্টিতে পাখিরা যেভাবে ডানা ঝাপটে উড়ে বেড়ায় আকাশে, আমারও তেমনি উড়তে সাধ হচ্ছে। আকাশ থেকে বৃষ্টির কুয়াশায় ঝাপসা হয়ে যাওয়া মাটির প্রান্তর আর বৃক্ষ-বনানি দেখতে কত সুন্দর, আমার তা দেখতে তীব্র ইচ্ছে হচ্ছে।
আমি বৃষ্টিতে ভিজছি। বৃষ্টিতে রামালা ভিজছে।
নৃত্যের ছন্দে চারদিকে পাক খাচ্ছে রামালা। ধীরে ধীরে দুলছে রামালা। ওর চুলগুলো ছড়িয়ে পড়েছে। বৃষ্টিবিধৌত চুলগুলো অনন্য সুন্দর।
আমি রামালাকে দেখি। খুব গভীরভাবে, ঘন হয়ে দেখি। রামালা আপ্লুত। আমি রামালাকে দেখি। প্রকৃতিকে দেখি। সমগ্র প্রকৃতি মূর্ত হয়েছে রামালার অবয়বে। যুবতী রামালা রমণী হয়ে উঠেছে কখন যেন; আমিও যেন থইথই যৌবনে পড়ে আছি কবে থেকে। এই যে গোধূলির আলো-আঁধারীময় বাংলা, আর স্নিগ্ধ কবিতামাখানো রামালা, ওর চুল, চুলের সিঁথি, ঠোঁটের স্মিতহাসি- একাকার হয়ে মিশে আছে। বৃষ্টিস্নাত শাড়ি-পরিহিতা রমণীর চেয়ে সুন্দরতর আর কিছু নেই। আমি রামালাকে দেখি। প্রকৃতিকে দেখি। একধ্যানে দেখি বাংলার মুখ, আর দেখি রামালাকে।
‘সোনা!’ অস্ফুট স্বরে রামালা ডাকে। আমার সামনে শান্তভাবে দাঁড়িয়ে আছে রামালা। ওর চাঞ্চল্য মুহূর্তে স্তিমিত। ওর দৃষ্টি দূর সমুদ্রের তরঙ্গতুফানে স্থির।
‘হুমম’। আমি অল্প শব্দে সারা দিই।
‘সামনে আয় তো সোনা’।
আমি এগিয়ে রামালার সামনে গিয়ে দাঁড়াই।
‘আরেকটু ঘেঁষে দাঁড়া। আমার বুক ঘেঁষে দাঁড়া।‘
আমি রামালার সামনে দাঁড়িয়ে আছি। ওর চোখে তীব্র আগুনের ফলা।
‘আমার চোখের দিকে তাকা, একদম মণি বরাবর চোখ রাখ।’ তারপর রামালা নিজেই একটু সামনে এগিয়ে আসে, একটু ঝুঁকে আমার নাকের সাথে নাক লাগিয়ে, ঠোঁটের সাথে ঠোঁট ছুঁইয়ে, বুকে বুক ঠেসে একদম আমার চোখের মণি বরাবর ওর চোখের মণি ছুঁড়ে মারলো।
হঠাৎ কী যেন ঘটতে থাকলো।
আমার মাথা গুলিয়ে যাচ্ছে। মনে হচ্ছে, সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম মগজতন্তুগুলো অতিশয় মিহিসুরে রিনরিন করে বাজছে। ঝিম ধরে আসছে পৃথিবী। সূক্ষ্ম একটা কাঁপুনি, তিরতির করে মগজ থেকে সারা শরীরে ছড়িয়ে পড়ছে। খুব জোরে সোনারুকে সাপটে ধরে আছি। ওর সর্বাঙ্গ কাঁপছে। না, সোনারু নয়, কাঁপছে রামালা। না, তাও না, সোনারু এবং রামালা – আমরা দুজনেই কাঁপছি। এভাবে কতক্ষণ কেটে যায়, টের পাই না। যখন টের পাই, তখন বুঝতে পারি, আমার খুলির ভেতর একটা মিশ্রিত মগজ কাজ করছে। অর্থাৎ, আমার মগজটা আর আমার একার মগজ নয়, এখানে রামালার মগজটাও ঢুকে পড়েছে। হঠাৎ হঠাৎ মনে হয়, আমি নিজেই রামালা।
আমিই রামালা?
‘রামালা…’। আমি ‘রামালা’ বলে চিৎকার দিয়ে উঠি। না, আমি রামালা নই, আমার শরীরের উপর থেকে রামালা আস্তে ওকে সরিয়ে নেয়। আমার সামনে রামালা দুলছে। ওকে ক্লান্ত দেখাচ্ছে। দুলতে দুলতে ঘাসের উপর বসে পড়ে সে; আমিও ওর সামনে যেয়ে বসে পড়ি। এখন কি রাত? আকাশে জোসনা? চারদিকে আলো খল খল করছে। অপরূপ নিস্তব্ধতায় আমরা ডুবে যেতে থাকি।
‘সোনা!’ নিস্তব্ধতা ভেঙে রামালা বলে, ‘আজ তোকে নিয়ে একটু খেললাম। আমি তোর মগজটা নেড়েচেড়ে উলটপালট করে দিলাম! ভালো লাগছে না তোর?’
‘সর্বনাশ! কী বলছিস এসব?’ আমি রামালার কথায় বিস্মিত হই।
‘তোর উপর একটা পরীক্ষা চালাচ্ছি।‘ আমার চোখ থেকে লেজার রশ্মির মতো খুব ধারালো একটা রশ্মি বিচ্ছুরিত হয়। এটাই সেই ধারালো ম্যাজিক সিজার, যা সবকিছু কাটবে, আবার জোড়াও লাগাবে। সেই রশ্মি দিয়ে খুব ছোট্ট একটা কণা, নিউট্রনের মতো, তোর চোখের মণিতে ঢুকিয়ে দিব।
‘তুই একটা ডাইনি তো!’ দুম করে ওর মুখের উপর বলে দিই; রামালা যেন সত্যিই একটা ডাইনি হয়ে গেল। ওর চোয়াল খুব শক্ত হলো। আগুন ঠিকরে বেরুচ্ছে চোখ থেকে। আমাকে হয়ত ভয় দেখাচ্ছে রামালা। না, আমি সহজে ভয় পাই না। কিন্তু রামালা ধীরে ধীরে নরম হতে থাকলো।
রামালা বলতে থাকে, ‘শোন সোনারু, আমি তোর ব্রেইনের ভেতর ঢুকে পড়বো। অতিক্ষুদ্র একটা দানার ভেতর আমার ব্রেইনের সবখানি মেমোরি ঢুকিয়ে নেব। তোর চোখ বরাবর একটা ফুঁ দিব, তারপর রেটিনা দিয়ে সুড়সুড় করে তোর নিউরনে ঢুকে পড়বো। তোর মগজ ঘাঁটাঘাঁটি করে উচ্ছিষ্ট অংশটা রেখে আবার আমার ব্রেইনে চলে আসবো।‘ এ বলে রামালা দুষ্টুহাসি ছড়িয়ে দিল মুখে।
আমি একটু উত্তেজিত স্বরে জিজ্ঞাসা করি, ‘আচ্ছা রামা, কেন শুধু শুধু আমাকে নিয়ে খেলছিস? জগতে কি আর কেউ ছিল না?’
রামালা হাত বাড়িয়ে আমার গাল টেনে ধরলো। বললো, ‘আগের জন্মে তুই আমাকে খুন করেছিলি। এই জন্মে আমি তোকে খুন করবো।’ বলেই রামালা খিলখিল করে হাসতে শুরু করলো, এবং একসময় অট্টহাসি দিয়ে উঠলো। ওর অট্টহাসি প্রকৃতির দেয়ালে প্রতিধ্বনিত হতে হতে বহুদূর ছড়িয়ে পড়লো।
আমি ভয় পাচ্ছি না। ভয়ের ব্যাপার ছিল কিনা, বা এখনো ভয় পাওয়া উচিত কিনা বুঝে উঠতে পারছি না। আমি যে রামালাকে ভয় পাচ্ছি না, মূল বিষয় হলো এটা। পূর্ব জন্মটন্ম নিয়ে আমার কোনো বিশ্বাস নেই। রামালা এখন অত্যধিক ঘোরের ভেতর প্রলাপ বকছে। ও আমাকে কত গভীরভাবে ভালোবেসে ফেলেছে তা এই আজগুবি প্রলাপ থেকেই বুঝতে পারছি।
তবে, ওর একটা বিষয় আমার কাছে ইন্টারেস্টিং লাগতে শুরু করলো।
এটা একটা অভিনব আইডিয়া বটে। মানুষের ব্রেইন কোনোদিন ট্রান্সপ্ল্যান্ট করা সম্ভব হবে কিনা, ভবিষ্যতের বিজ্ঞান সেটা জানবে। তবে, ব্রেইন ট্রান্সপ্ল্যান্টেশনের চাইতে এক-চিলতে মেমোরি কার্ডের ভেতর একটা মানুষের সমগ্র স্মৃতিসম্ভার, বুদ্ধিমত্তা, প্রজ্ঞা জড়ো করা সহজতর কাজ। ‘ডাইনি’ রামালা কি সে-ধরনের কিছু করতে যাচ্ছে? এতে মানবজাতির কী উপকার সাধিত হবে, ওকেই তার একটা ব্যাখ্যা দিতে হবে।
‘হ্যাঁ, সেটাই বলছি।’ ওরে সর্বনাশ! আমার মনের কথা রামালা ধরে ফেলছে দেখি!
‘হ্যাঁ, এখন তুই আলাদা করে কিছু ভাবতে পারবি না।‘ ঠান্ডা গলায় রামালা বলে উঠলো।
‘প্রথম দিকে কৃত্রিম উপায়ে বুদ্ধিমত্তা তৈরি করে একটা সূক্ষ্ম মেমোরিকার্ডে ঢোকানো হবে। এই মেমোরিকার্ডটি মাথার একপাশে চামড়ার নীচে গেঁথে দিতে হবে। সেকেন্ড জেনারেশন স্টেজে আইনস্টাইন, স্টিফেন হকিন্সসহ প্রতিভাধর জীবিত ব্যক্তিদের ডিএনএ থেকে তাদের বুদ্ধিমত্তা সংগ্রহ করে একত্র করা হবে। একত্রিত বুদ্ধিমত্তাকে কনসেন্ট্রেট করে মূল বুদ্ধিমত্তার চাইতে বহুগুণ শক্তিশালী বুদ্ধিমত্তা তৈরি করা হবে। এগুলো অনুরূপ এক-চিলতে চিপসে ঢোকানো হবে। এগুলো কপি করা যাবে। মেধাবীদেরকে আরো মেধাবী এবং অমেধাবীদেরকে মেধাবী করার কাজে এ চিপস ব্যবহৃত হবে। থার্ড জেনারেশন স্টেজে চিপসকে লিকুইড ফর্মে রূপান্তর করা হবে। ইনজেকশনের মাধ্যমে শরীরে বুদ্ধিমত্তা পুশ করা হবে। ফলে হবে কী, পৃথিবীতে স্টিফেন হকিন্সের প্রতিভার পুনরাবির্ভাব ঘটবে। আইনস্টাইন, নিউটনের পুনরাগমন ঘটবে। মানব সভ্যতা সক্রেটিস, এরিস্টটলের মতো দার্শনিকদের মেধা আবার পৃথিবীতে ফিরিয়ে আনবে। রবীন্দ্রনাথ ও নজরুলের প্রতিভার সংমিশ্রণ ঘটিয়ে এক মহামানবীয় প্রতিভা সৃষ্টি করা সম্ভব হবে। উন্নত বুদ্ধিমত্তার কল্যাণে মানবসভ্যতার দ্রুত প্রসার ঘটতে থাকবে। ফোর্থ জেনারেশন স্টেজে সংগৃহীত সমন্বিত প্রতিভার চিপসটি বায়বীয় কিংবা ‘লাইট’ ফর্মে রূপান্তর করা হবে। চোখের দৃষ্টি দিয়েই একজনের বুদ্ধিমত্তা অন্যজনের শরীরে ট্রান্সফার করা যাবে। আমরা যত্রতত্র রামালার মতো অসংখ্য সুকণ্ঠী গায়িকাকে দেখতে পাবো…’। আমার মাথা প্রচণ্ড গরম হয়ে যাচ্ছে। মাথার ভেতর এই যে ভাবনাগুলো কিলবিল করছে, এটা আমি না, রামালার ভাবনা। রামালার মগজ এখন আমার মগজে ঢুকে পড়েছে। আমার কথাটা রামালার, এবং রামালার কথাটা আমার, এবং আমাদের দুজনের কথাটাও… নাহ, আর ভাবতে পারছি না।
‘সোনা!’ রামালার কথায় আমি সম্বিৎ পাই। একটা জলবতী স্নিগ্ধ কবিতা এক অপরূপ ভঙিমায় আমার সামনে বসে আছে। ওর মুখের হাসিটিতে পৃথিবী মধুর হয়ে উঠছে।
এখন দিন, নাকি রাত, আমরা জানি না। কোথায় আছি আমরা জানি না। আমরা হাত ধরে মুখোমুখী বসে আছি। চারদিকে অন্ধকার, নাকি জোসনা, আমরা ভুলে গেছি। ভুলতে ভুলতে আমরা ঘুমিয়ে পড়লাম।
যখন ঘুম ভাঙলো, তখন আমি এবং রামালা দুজনেই ক্লাসে। একজন সাহিত্যের শিক্ষক বোর্ডে বেশকিছু অদ্ভুত আকৃতির ছবি এঁকে বলছেন, ‘এরা হলো অন্যগ্রহের মানুষ। অন্যগ্রহের মানুষ দেখতে আমাদের মতো নয়; কেউ পাথর, কেউ পাহাড়, কেউ গাছের মতো, কেউ-বা বায়বীয় বা তরল পদার্থের মতো; কেউ আবার এমন, যাদের আকৃতি আমাদের কল্পনার অতীত। এদের চলাচলও কিন্তু আমাদের মতো না; এরা কল্পনাগামী, অর্থাৎ, এরা যেখানে যাবার কথা কল্পনা করে, মুহূর্তে সেখানেই চলে যায়। এরা একই সাথে অনেক জায়গায় অবস্থান করতে পারে; যার কল্পনাশক্তি যত বেশি, সে তত বেশি জায়গায় এবং তত বেশি দূরবর্তী স্থানে যাতায়াত ও অবস্থান করতে পারে। আমাদের পৃথিবীতেও মানুষ একদিন কল্পনাগামী হবে। প্রথমে তারা বাতাস, পরে ইথারে ভ্রমণ করতে পারবে। এরপর তারা…’
রামালা হঠাৎ দাঁড়িয়ে স্যারকে থামিয়ে দিয়ে বলতে থাকলো, ‘স্যার, এ গল্পগুলো প্লিজ না করুন। ইউনিভার্সের অন্য কোথাও কোনো প্রাণের অস্তিত্ব নেই। ইউনিভার্সে পৃথিবীর মতো ৪০ বিলিয়ন গ্রহ এবং অগুনতি উপগ্রহ আছে। পৃথিবীর বয়সই ৫০০ কোটি বছর। ইউনিভার্সের বয়স প্রায় ১৪ বিলিয়ন বছর। ৫০০ কোটি বছরে যদি পৃথিবীতে প্রাণের উন্মেষ ঘটতে পারে, ১৪ বিলিয়ন বছরে অনেক আগেই ইউনিভার্সের অন্য কোথাও প্রাণীর সৃষ্টি হওয়ার কথা ছিল। বিজ্ঞানের এই চরম উৎকর্ষের যুগে আজও কোথাও প্রাণের সন্ধান পৃথিবীর মানুষ পায় নি; অন্য কোথাও প্রাণী থাকলে তাদের আমাদের চাইতেও বেশি বুদ্ধিমান হওয়ার কথা, যেহেতু ইউনিভার্সের বয়স পৃথিবীর বয়সের চাইতে অনেক বেশি। এবং আমরা তাদের খুঁজে না পেলেও অন্তত তারা এতদিন আমাদের খুঁজে বের করে ফেলতো।’ আশ্চর্য, পুরো ক্লাস হাততালি দিয়ে উঠলো, এবং স্যার অবাক হয়ে রামালার দিকে তাকিয়ে আছেন।
এবং রামালা, না, রামালা না, হ্যাঁ, রামালা আমার মগজে ঢুকে পড়ে আরেকটা প্রশ্ন ছুঁড়ে দিল, ‘স্যার, আপনি সাহিত্যের শিক্ষক হয়ে বিজ্ঞানের তত্ত্ব নিয়ে আলোচনা করছেন, এটা হাস্যকর বটে।‘
শিক্ষক আহত হলেন না, কিংবা তার কোনো ভাবান্তর হলো না। খুব স্বাভাবিকভাবে বললেন, ‘ডিয়ার সান, আমি সাহিত্যের শিক্ষক বলেই এতখানি কল্পনা করতে পেরেছি। এখন বিজ্ঞানের যদি ক্ষমতা থাকে, তাহলে আমার কল্পনাকে ছুঁয়ে দেখুক।’ রামালা চুপসে গেল, না, আমিই আর কোনো কথা বলতে পারলাম না। ক্লাসে কোনো শব্দ নেই। কেউ নেই ক্লাসে। বোর্ডের সামনে একটা ব্ল্যাক মার্কার হাতে আমার দিকে তাকিয়ে মিটিমিটি হাসছে রামালা।
৩
সকালে বারান্দায় পায়চারি করতে করতে একটা গান গাইছিলাম। ঘরের ভেতর থেকে বেরিয়ে এসে দরজার চৌকাঠে দাঁড়িয়ে সুন্দরী হেলেনা বলে উঠলো, ‘বাহ, তোমার কণ্ঠটা দারুণ তো!’ তাই তো! আমি নিজেই অবাক হচ্ছি আমার কণ্ঠ শুনে। হেলেনার কথায় আমি খুব পুলকিত হই। ওর চোখে মুগ্ধতার ঝিলিক। আমি আরো গলা ছেড়ে, আরো যত্ন করে গান গাইতে থাকি। গান গাওয়া শেষ হলে দেখি, হেলেনা আমার কাঁধের উপর মাথা নুইয়ে বুঁদ হয়ে পড়ে আছে।
‘গাও না বাবু, গাও। আরো গাও।‘
আমি একের পর এক গান গাইতে থাকি। নিজের গানে নিজেই মুগ্ধ হতে থাকি। এবং অবাক হতে থাকি- আগে তো কখনো এভাবে গাইতে পারি নি!
আমার গানে হেলেনা পাগল হয়ে গেল।
যখন তখন হেলেনা আমাকে গান গাইতে বলে।
যেখানে-সেখানে হেলেনা আমার গলায় গলায় জড়িয়ে থাকে।
আমাকে ছাড়া কিচ্ছুটুকুন বোঝে না হেলেনা। প্রেমে পাগলিনী এমন মেয়েদের কার না ভালো লাগে?
একদিন গান গাওয়ার পর আবেশে জড়িয়ে ধরে অনর্গল চুমো খেতে থাকে হেলেনা। আমি ওকে বুকে টেনে নিই। ওর চোখে চোখ রাখি। খুব গভীরভাবে ওর মণি বরাবর দৃষ্টি ছুঁড়ে দিই। তারপর ওর মগজে ঢুকে পড়ি। হ্যাঁ, আমি রামালা। হেলেনার মগজ খুবলে ছিন্নভিন্ন করে বেরিয়ে আসি।
৪
বাইরে অঝোর ধারায় বৃষ্টি ঝরছে। বারান্দায় গ্রিল ধরে সন্ধ্যারাঙা বৃষ্টি ঝরা দেখছে রামালা। হাত বাড়িয়ে বৃষ্টির ফোঁটা ছুঁইছে। পিঠের উপর একগাঁদা চুল ছড়িয়ে পড়েছে। চুলের সাথে আঁচল উড়ছে বাতাসে। রামালা আমাকে ডাকছে না ওর কাছে যেতে। ও না ডাকলে আমি কখনো কাছে যাই না।
ও প্রতি উইকএন্ডে আমাকে গান শোনাতে আসে। সারাদিন নানান জায়গায় গান নিয়ে ব্যস্ত থাকে। আজকে এই অনুষ্ঠান, কালকে ওখানে ওপেন এয়ার কনসার্ট, টিভিতে লাইভ প্রোগ্রাম! ওর ব্যস্ততার শেষ নেই। ও এখন দেশের সেরা শিল্পীদের একজন। আমাকে যদি একজন শিল্পীর নাম বলতে বলো, আমি বলবো সে রামালা। আমার ভালো লাগে রামালার গান। রামালা যখন আধো নিমীলিত চোখে গান গাইতে থাকে, তখন ওকে ধ্যানী সন্ন্যাসিনী মনে হয়। তখন সাধ হয়, ওর কোলের উপর মাথা রেখে ওর গলা ধরে ঝুলে থাকি।
রামালা আমার বাসায় খালি গলায় গান গায়। বাসায় কোনো গিটার কিংবা হার্মোনিয়াম নেই। এসব থাকলেও আমি ওর খালি গলায় গাওয়া গানই শুনতাম। এতেই ওর প্রকৃত স্বাদ পাওয়া যায়। ওর কণ্ঠে অমৃত ঝরে পড়ে, আমি তাতে গলে যাই, আর মিশে যেতে থাকি।
‘শোন!’ এটা রামালার কাছে যাবার ইঙ্গিত।
আমি রামালার পেছনে যেয়ে ওর গা ঘেঁষে দাঁড়াই। আমার দু’হাত ওর দু’দিকে প্রসারিত দু’হাতের উপর মেলে ধরি। রামালার শরীর আস্তে সামান্য ঝাঁকি দিয়ে উঠলো। ধীরে ধীরে সামনে বারান্দার গ্রিল দরজা খোলার মতো খুলে গেল, রামালা একটু ঝুঁকে পড়ে আলগোছে শূন্যে ঝাঁপ দিল। পড়তে পড়তে দু’দিকে দুটো ডানা মেলে ধরলো আকাশে। তারপর বাতাসের ঢেউয়ে ভাসতে ভাসতে বৃষ্টির পানিতে সাঁতার কাটতে কাটতে আমাকে পৃষ্ঠে সওয়ার করে আকাশে উড়তে থাকলো রামালা। হিম হয়ে আসে শরীর। আমি রামালাকে শক্ত করে জড়িয়ে ওর শরীরের ওম নিতে থাকি। কখনো উর্ধে উঠে যাই ঈগলের মতো, আবার ঢেউয়ের মতো দুল খেতে খেতে নীচে নামতে থাকি। কতদিনের বাসনা ছিল আকাশে ওড়ার, ভূ-পৃষ্ঠে কুয়াশাচ্ছন্ন বনানি দেখার, আজ আমি প্রাণ ভরে সেসব দেখছি। পাহাড়, নদী পেরিয়ে, বৃষ্টি আর আকাশের শূন্যতা কেটে রামালা আমাকে নিয়ে উড়ে চলেছে। কখনো বাতাসের বেগে, কখনো আরো দ্রুত। আমার গ্রামকে মনে পড়লো, আর এ কী অদ্ভুত! মুহূর্তেই দেখতে পেলাম, আমি আমার গ্রামের মাঠের মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছি। এই তো, এই মাঠে আমি, নূরু, জসীম- একসাথে কত খেলেছি! অমনি দেখতে পাই, ওরা আমার সামনে এসে হাজির। আমরা মাঠের মাঝখানে বসে বিকেলের নরম আলোতে আড্ডা দিচ্ছি আর চানাচুর খাচ্ছি।
‘মা!’ বলতেই নিজেকে দেখতে পাই, আমি এক ৭ বছরের খোকা। উঠোনে বাতাসে ধান ঝাড়ছে মা, আর আমরা ভাইবোনেরা ধানের খড়ে লাফালাফি করে খেলা করছি। একদিন বাবা আমাকে স্কুলে ভর্তি করে দিল। কী তুখোড় আর উদ্দাম এই দিনগুলো! ভোঁ ভোঁ দৌড়াই, সারাদিন ঘুড়ি নিয়ে মাতামাতি, গাছগাছালির ফল কুড়িয়ে বেড়াই, পাখির বাসায় হানা দিই, যখন-তখন পানিতে ঝাঁপ দিয়ে হলডুগানি খেলি। এভাবে কতদিন কেটে যায়, আমার হিসাব থাকে না। স্কুলে যাওয়ার পথেই একটা ডঙ্গুল ফলের গাছে। আমি, নুরু আর জসীম প্রতিদিন সেই গাছ থেকে ফল পাড়ি। চলে যাওয়ার সময় বাড়ির আড়াল থেকে গলা বের করে ছোট্ট চোখে একটা মেয়ে তাকিয়ে থাকে, ওর নাম হেলেনা।
‘সোনা!’ কার ডাক শুনে চোখ খুলে ঘুরে তাকাই।
চারদিকে আলোর সমুদ্র থইথই করছে। ঝাঁকে ঝাঁকে উড়ছে পরীরা। ওরা আমার পাশ দিয়ে উড়ে যায়, ওদের পাখার নরম ঝাপটায় আমার মন আন্দোলিত হয়। হেলেনা আমার দিকে তাকিয়ে আছে, খুব মিষ্টি করে হাসছে হেলেনা।
২৩ জুন ২০২০
০১ লা আগস্ট, ২০২২ দুপুর ১২:৩৩
সোনাবীজ; অথবা ধুলোবালিছাই বলেছেন: এটা হলো একটা কনসেপ্ট, এ ম্যাটার অব ফিজিনিলিটি স্টাডি। তবে আমার মনে হচ্ছে, ভবিষ্যতের বিজ্ঞান এর চাইতেও সূক্ষ্ম বিষয় নিয়ে গবেষণা করে সফলকাম হবে।
আপনার প্রশ্নটা থেকে বুঝতে পেরেছি, দীর্ঘ গল্পটা আপনি পড়েছেন। ধন্যবাদ আপনাকে এবং শুভেচ্ছা।
২| ০৩ রা আগস্ট, ২০২২ সন্ধ্যা ৭:১৭
মিরোরডডল বলেছেন:
এই লেখাটা আগে পড়েছি তবে এবার বড় করে লেখা ।
সোনারু আর রামালার বৃষ্টির গল্পটা ভালো লেগেছে ।
১২ ই আগস্ট, ২০২২ দুপুর ২:২৫
সোনাবীজ; অথবা ধুলোবালিছাই বলেছেন: নাহ, আগের মতোই আছে। পড়তে যেয়ে দু-একটা শব্দ এডিট করে থাকতে পারি, এর বেশি কিছু না।
৩| ০৭ ই আগস্ট, ২০২৪ সকাল ১০:৫২
গএঁঁআ বলেছেন: To keep the excitement high, https://bandlegame.com includes timed challenges. Players must think quickly to maximize their score before the timer runs out.
০৭ ই আগস্ট, ২০২৪ বিকাল ৪:৫৭
সোনাবীজ; অথবা ধুলোবালিছাই বলেছেন: আপনি এ পোস্টে আসলেন কীভাবে?
©somewhere in net ltd.
১| ০১ লা আগস্ট, ২০২২ সকাল ৯:৪২
শূন্য সারমর্ম বলেছেন:
বুদ্ধিমত্তার মিশ্রণ ঘটিয়ে স্টিফেন-স্টাইন প্রজাতি বানানো সম্ভব?