নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
দুঃখের কবিতাই শ্রেষ্ঠ কবিতা। ভালোবাসা হলো দুঃখ, এক ঘরে কবিতা ও নারী।
আমার ল্যাপটপ অন থাকা মানে অবিরাম গান বাজতে থাকা। গান বাজে ল্যাপটপে, গান ঝরে কণ্ঠে, একটা কনসার্টেড সুর-মূর্ছনার তালে তালে ল্যাপটপের বাটনগুলোর উপর অনবরত আমার আঙুলগুলো খেলতে থাকে।
অহনার সাথে যখন খুব বেশি বেশি কথা হতো, দীর্ঘ সময় ধরে, মাঝে মাঝে সে বলতো, তোর কাছে কে বড়ো, তোর গান, নাকি আমি?
‘তুইই বড়ো।’ আমি ইন্সট্যান্টলি বলতাম।
‘তাহলে তোর গান বন্ধ কর।’ একটুসখানি ঝিম মেরে বসে থেকে গম্ভীর স্বরে অহনা অনুজ্ঞা করতো।
কিন্তু আমি ভলিয়্যুম আরো বাড়িয়ে দিয়ে বলতাম, ‘তুই এই গানটা শোন। এমন মাধুর্যমাখা দরদিয়া গান তুই জীবনেও শুনিস নি।’ তারপর, মোবাইলটা পিসির স্পিকারের সামনে বসিয়ে রাখতাম, যতক্ষণ গানটা বাজতো। গান শেষ হলে কানের কাছে মোবাইল নিতে গিয়েই দেখতাম লাইন কেটে দিয়ে অহনা পগার পার।
এরপর অভিমান করে অহনা আর কল করতো না; যে মেয়ে প্রতিটি নিশ্বাসের সাথে মিস্ডকল দেয়, আর মিস্ডকল দিতে দিতে মোবাইলের বাটন ক্ষয় করে ফেলে, সেই মেয়েই একটানা দু-তিনদিন ধরে আর মোবাইলই অন করে না।
ওর সাথে গান আর কবিতা নিয়ে দীর্ঘ আলোচনা আর বিতণ্ডা হতো; মোবাইলেই। মোবাইল কোম্পানিগুলো প্রতি মিনিটে ২৫ পয়সা কলরেট করেছিল আমাদের কল্যাণের কথা ভেবে। হেন কোনো গান নেই যা ওর জানা নেই, কী সুর, কী তার অন্তরা। আমার পড়া হেন কোনো কবিতা নেই যা ওর আজও পড়া হয় নি; আর ও যেসব কবিতা পড়েছে আর আমি তা পড়ি নি, তার তালিকা অনেক অনেক দীর্ঘ। কথায় কথায় ও রেফারেন্স টেনে বলতো, ‘তুই কি ঐ বইটা পড়েছিস?’
‘কোনটা?’ আমি জিজ্ঞাসা করি।
‘মেমসাহেব?’ অহনা জিজ্ঞাসা করে, ‘তুই কি ‘মেমসাহেব’ পড়েছিস?’
‘না?’ আমি ঝটপট বলে দিই।
‘মেঘনাদবধ?’
‘না?’
‘বঙ্কিমচন্দ্রের সব বই পড়েছিস?’
‘না।‘
‘রবীন্দ্রনাথ? বিদ্যাসাগর? শরৎচন্দ্র?’ অহনা একটানা জিজ্ঞাসা করতে থাকে।
আমি বলি, ‘শরৎচন্দ্রের অর্ধেকের মতো পড়েছি।’
‘হুমম! এই পড়া নিয়েই তুই বই লেখা শুরু করেছিস?’ অহনার কণ্ঠে অবজ্ঞা উঠে আসে আমার প্রতি।
আমার নিজেরও সামান্য ভিত আছে, তা বোঝানোর জন্য আমি বলি, ‘আমি তো হুমায়ূন আহমেদের কোনো বই বাদ রাখি নি।’
অহনা ক্ষিপ্ত স্বরে বলে, ‘তুই একটা বাচ্চা পুলা। হুমায়ুন আজাদের বই পড়েছিস?’
‘অল্প কয়েকটা।’
তারপর অহনা আমাকে আদেশ শোনায়, ‘তুই এক কাজ কর, আগামী ১০ বছর তুই লেখালেখি বন্ধ রাখ। এই দশ বছরে এদের বইগুলো আগে পড়। পড়াশোনা না করে লিখিস বলে তোর লেখা মাকাল ফলের মতো।’
বড্ড অপমানজনক কথা। আমি ক্ষেপে গিয়ে বলি, ‘ঐ পণ্ডিতনি, তুই তো অনেক পড়েছিস, তাহলে আমার মাকাল ফলের মতো একটা ফল প্রডিউস করে দে।’
‘তখন তো তোর কপাল পুড়বে।’
এবার আমি অহনার পরীক্ষা নিতে শুরু করি, ‘আচ্ছা, আমাদের জাতীয় সঙ্গীত কার লেখা যেন?’
অহনা হেসে দিয়ে বলতো, ‘তুই কি আমার টেস্ট নিচ্ছিস?’
‘বল না, শুনি!’
‘কেন, রবীন্দ্রনাথের লেখা।’
‘তাহলে শূন্যস্থান পূরণ কর : ওমা ফাগুনে তোর আমের বনে ঘ্রাণে পাগল করে.... এর পরের লাইনটা কী?’
অহনা চুপ করে থাকে।
আমি একটু ধমকের সুরে বলি, ‘কী, পারিস না?’
‘স্যরি রে, জাতীয় সঙ্গীত আমার পুরোটা মুখস্থ নেই।’ অহনার কণ্ঠ খুব নরম হয়ে আসে, পরাজয়ে।
আমি সুযোগ পেয়ে বলি, ‘পণ্ডিতনি! খুব তো ঝাড়লি এতক্ষণ। তোর তো দেখি ‘ষোলো আনাই মিছে।’’
‘তোর কি পুরোটা মুখস্থ?’ অহনা এখন বিনয়ে অবনত।
আমি কণ্ঠে জোর এনে বলি, ‘শুধু মুখস্থই না, পুরোটা সুর করে গাইতেও পারি।’
‘আমাকে একটু শোনা না ভাই!’ আবেগে বিগলিত হয়ে অহনা আমাকে বলে।
আমি পুরোটা গাই : আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি....
অহনা খুব মুগ্ধ হয়ে শুনছে, ওর নীরবতা আমি টের পাই।
‘তুই কি এ গানটার ইতিহাস জানিস?’ আমি অহনাকে জিজ্ঞাসা করি।
‘নাহ, খুব বেশি কিছু জানি না।’ অহনা আগের চাইতেও নরম হয়ে বলে, ‘খুব অল্পই জানি এটা সম্পর্কে। এটা বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীত হয়েছে ১৯৭২ সালে। ১৯৭০ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত জহির রায়হানের ‘জীবন থেকে নেয়া’ ছবিতে এটা গেয়েছেন অজিত রায় আর সাবিনা ইয়াসমিন। এটা বঙ্গবন্ধুর অনেক প্রিয় একটা গান ছিল। বিবিসির বাংলার জরিপে শ্রোতাদের সবচাইতে ভালোলাগা ২০টি গানের তালিকায় এটা এক নাম্বারে। এইতো! আর কী জানতে চাস তুই?’
‘বাহ!’ আমিও মুগ্ধ হয়ে যাই ওর উত্তরে, ‘তুই দেখি ‘আমার সোনার বাংলা’ সম্পর্কে ভালো জ্ঞানই রাখিস।’
ছোটোবেলায় স্কুলের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে, বিশেষ করে অ্যানোয়াল স্পোর্টসের দিন জাতীয় পতাকা উত্তোলনের সময় যখন মাইকে এ গানটা বাজানো হতো, শরীরে কী একটা দোলা লেগে যেত, রক্ত গরম হয়ে ওঠা যাকে বলে। আমার কাছে এ গানের মতো মেলোডিয়াস গান খুব কমই আছে বলে মনে হয়। এ গানটার আছে একটা ম্যাজিক্যাল পাওয়ার, যা শোনামাত্র শরীরে একটা ঝড় সৃষ্টি হয়।
হঠাৎ আরেকটা প্রশ্ন করি অহনাকে। ‘বল তো, এ গানটার সুরকার কে?’
‘কেন, রবীন্দ্রনাথ? রবীন্দ্রসঙ্গীতের সুরকার কি অন্য কেউ হবে?’ অহনা খুব জোরের সাথে বলে।
‘এই তো! এখানেই কবি নীরব। এতক্ষণ তো আমাকে কম ঝাড়ি দাও নাই। এবার ঝাড়ি খাবার পালা তোর।’
নব্বইয়ের দশকে বাংলাদেশ টেলিভিশনের কোনো এক অনুষ্ঠানে আমি প্রথম জানতে পারি যে, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা ‘আমার সোনার বাংলা’ গানটির সুরকার তিনি নিজে নন, গগন হরকরা নামক এক বাউল শিল্পীর লেখা ‘আমি কোথায় পাব তারে’ নামক এক গানের সুরে রবীন্দ্রনাথ তার ‘আমার সোনার বাংলা’ গানটি রচনা করেন। আমি প্রথমে অবাক হয়েছিলাম, রবীন্দ্রনাথ কেন অন্য এক সুরকারের সুরে নিজের গান গাইবেন, তার কি সুরের অভাব ছিল? পরে জেনেছি, তিনি লালনের সুরেও অনেক গান লিখেছেন। এমনকি, ভিনদেশী ইংরেজি গানের সুরেও তিনি নিজের গান রচনা করেছেন।
এখন তো জ্ঞান খুবই হাতের নাগালে চলে এসেছে। গুগল ঘেঁটে, উইকিপিডিয়া থেকে যতটুকু স্টাডি করেছি, তার আলোকে ‘আমার সোনার বাংলা’ গান সম্পর্কে মোটামুটি ভালোই জ্ঞান হয়েছে।
গগন হরকরা বা গগন চন্দ্র দাস নামে একজন বাংলা লোকসঙ্গীতশিল্পী, সঙ্গীত রচয়িতা ও বিশিষ্ট বাউল গীতিকার ছিলেন। তিনি আনুমানিক ১৮৪৫ সালে শিলাইদহের কসবা নামক গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা-মাতা সম্বন্ধে তেমন কোন তথ্য জানা যায় না, তবে তার একটি ছেলের নাম কিরণ চন্দ্র বলে জানা যায়। গগন হরকরা প্রথমে কৃষি কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করতেন, পাশাপাশি তৎকালীন শিলাইদহের ডাকঘরের ডাক হরকরার চাকরি করতেন।
‘আমি কোথায় পাব তারে’ গগন হরকরার একটা বিখ্যাত বাউল গান। ১৮৮৯-১৯০১ সময়কালে পূর্ববঙ্গের বিভিন্ন অঞ্চলে জমিদারির কাজে ভ্রমণ ও বসবাসের সময় বাংলার লোকজ সুরের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের আত্মীয়তা ঘটে। তারই অভিপ্রকাশ তার স্বদেশী আন্দোলনের সমসাময়িক গানগুলি, বিশেষত ‘আমার সোনার বাংলা’। ঐ সময়ে রবীন্দ্রনাথের সাথে গগন হরকরার বিশেষ অন্তরঙ্গতা সৃষ্টি হয় এবং প্রায়ই দুজনে রসালাপ ও সঙ্গীত চর্চা করতেন। রবীন্দ্রনাথ তার গানের ভক্ত ছিলেনন। গগন হরকরার যথাক্রমে ‘ও মন অসাড় মায়ায় ভুলে রবে’ ও ‘আমি কোথায় পাব তারে’ গান দুটির সুর ভেঙে রবীন্দ্রনাথ ‘যে তোমায় ছাড়ে ছাড়ুক’ ও ‘আমার সোনার বাংলা’ গান দুটি রচনা করেন।
গগন হরকরা কার কাছ থেকে গানের দীক্ষা নিয়েছিলেন তা জানা সম্ভব হয় নি, তবে তিনি লালন ফকিরের গানের খুব ভক্ত ছিলেন। লালন ফকিরও গগন হরকরার গান এবং গগনের সান্নিধ্য খুব পছন্দ করতেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ‘ডাকঘর’ নাটকটি গগন হরকরার জীবন থেকে প্রভাবিত হয়ে লিখেছিলেন; নাটকের গগেন্দ্রনাথ ঠাকুর চরিত্রটি তা প্রমাণ করে।
১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে ‘আমার সোনার বাংলা’ গানটি রচিত হয়েছিল। এটি ২৫ লাইনের একটি দীর্ঘ গান। ১৯৭১ সালের ১ মার্চ গঠিত হয় স্বাধীন বাংলার কেন্দ্রীয় সংগ্রাম পরিষদ। পরে ৩ মার্চ তারিখে ঢাকা শহরের কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত পল্টন ময়দানে অনুষ্ঠিত জনসভা শেষে ঘোষিত স্বাধীনতার ইশতেহারে এই গানকে জাতীয় সঙ্গীত হিসাবে ঘোষণা করা হয়। ১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল মুজিবনগরে স্বাধীন বাংলাদেশের সরকারের শপথ অনুষ্ঠানে এই গান প্রথম জাতীয় সঙ্গীত হিসাবে গাওয়া হয়।
১৩ জানুয়ারি ১৯৭২ তারিখে বাংলাদেশের মন্ত্রীসভার প্রথম বৈঠকে এ গানটির প্রথম দশ লাইন সদ্যগঠিত গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জাতীয় সঙ্গীত হিসেবে নির্বাচিত হয়।
‘আমার সোনার বাংলা’ গানটির পাণ্ডুলিপি পাওয়া যায় নি, তাই এর সঠিক রচনাকাল জানা যায় না। সত্যেন রায়ের রচনা থেকে জানা যায়, ১৯০৫ সালের ৭ আগস্ট কলকাতার টাউন হলে আয়োজিত একটি প্রতিবাদ সভায় এই গানটি প্রথম গীত হয়েছিল। এই বছরই ৭ সেপ্টেম্বর (১৩১২ বঙ্গাব্দের ২২ ভাদ্র) ‘সঞ্জীবনী’ পত্রিকায় রবীন্দ্রনাথের স্বাক্ষরে গানটি মুদ্রিত হয়। এই বছর ‘বঙ্গদর্শন’ পত্রিকার আশ্বিন সংখ্যাতেও গানটি মুদ্রিত হয়েছিল। তবে ৭ আগস্ট উক্ত সভায় এই গানটি গীত হওয়ার কোনো প্রমাণ পাওয়া যায় না। বিশিষ্ট রবীন্দ্রজীবনীকার প্রশান্তকুমার পালের মতে, ‘আমার সোনার বাংলা’ ১৯০৫ সালের ২৫ আগস্ট তারিখে কলকাতার টাউন হলে ‘অবস্থা ও ব্যবস্থা’ প্রবন্ধ পাঠের আসরে প্রথম গীত হয়েছিল।
আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি।
চিরদিন তোমার আকাশ, তোমার বাতাস, আমার প্রাণে বাজায় বাঁশি॥
ও মা, ফাগুনে তোর আমের বনে ঘ্রাণে পাগল করে,
মরি হায়, হায় রে—
ও মা, অঘ্রানে তোর ভরা ক্ষেতে আমি কী দেখেছি মধুর হাসি॥
কী শোভা, কী ছায়া গো, কী স্নেহ, কী মায়া গো—
কী আঁচল বিছায়েছ বটের মূলে, নদীর কূলে কূলে।
মা, তোর মুখের বাণী আমার কানে লাগে সুধার মতো,
মরি হায়, হায় রে—
মা, তোর বদনখানি মলিন হলে, ও মা, আমি নয়নজলে ভাসি॥
তোমার এই খেলাঘরে শিশুকাল কাটিলে রে,
তোমারি ধুলামাটি অঙ্গে মাখি ধন্য জীবন মানি।
তুই দিন ফুরালে সন্ধ্যাকালে কী দীপ জ্বালিস ঘরে,
মরি হায়, হায় রে—
তখন খেলাধুলা সকল ফেলে, ও মা, তোমার কোলে ছুটে আসি॥
ধেনু-চরা তোমার মাঠে, পারে যাবার খেয়াঘাটে,
সারা দিন পাখি-ডাকা ছায়ায়-ঢাকা তোমার পল্লীবাটে,
তোমার ধানে-ভরা আঙিনাতে জীবনের দিন কাটে,
মরি হায়, হায় রে—
ও মা, আমার যে ভাই তারা সবাই, ও মা, তোমার রাখাল তোমার চাষি॥
ও মা, তোর চরণেতে দিলেম এই মাথা পেতে—
দে গো তোর পায়ের ধুলা, সে যে আমার মাথার মানিক হবে।
ও মা, গরিবের ধন যা আছে তাই দিব চরণতলে,
মরি হায়, হায় রে—
আমি পরের ঘরে কিনব না আর, মা, তোর ভূষণ ব'লে গলার ফাঁসি
সুযোগ বুঝে অহনার কাছে আমার এই আহরিত জ্ঞানসমগ্র প্রকাশ করি। আমি জানতাম, এতে সে নির্ঘাত কুপোকাত হবেই। ‘আমার সোনার বাংলা’, গগন হরকয়ার উপর এতসব শোনার পর সে উচ্ছ্বাসে অস্থির হয়ে বললো, ‘তুই এত্ত কিছু জানিস?’
অহনার মুগ্ধতা আমায় কী যে অনুপ্রেরণা দিত! যে জিনিসটা ওর জানা নেই, অথচ আমি জানি, তা ওকে জানিয়ে আমি দিগ্বিজয়ীর সুখ পেতাম, আর তাতে আমার প্রতি ওর মুগ্ধতা তরতর করে বেড়ে যেত। আমার ভাঙা আর কাঁচা কণ্ঠে ‘আমার সোনার বাংলা’ শুনে অহনা বললো, ‘গানটা এর আগে অ্যাসেম্বলিতে অনেক শুনেছি। রেকর্ডেও শুনেছি। কিন্তু এত ‘সুন্দর’ লাগে নি। তুই খুব চমৎকার গেয়েছিস।’
আমি অহনাকে অন্য একটা গানের কথা জিজ্ঞাসা করি, ‘ঐ গানটা শুনেছিস?’
‘কোনটা?’
‘যেটা সবসময় তোকে শোনাই?’
‘তুই তো কত গানই আমাকে শোনাস। কোনটার কথা বলবো?’
‘তুই একটা কালা।’ আমার রাগ উঠতে থাকে। কোনো কথা বা ইঙ্গিত যখন অহনা ধরতে পারে না, তখন খুব রাগ হয় আমার।
‘কেন? কেন বললি একথা?’ অহনা জানতে চায়।
‘কারণ, ইদানীং এই গানটা প্রায় রাতদিন ধরেই বাজিয়ে থাকি। এমনকি কথার ফাঁকে গুনগুন করে গেয়েও থাকি। কোনো কোনো সময় তো গলা ফাটিয়েও গেয়ে উঠি, আর এই গানটা তোর কানে ঢুকলো না?’
‘অসভ্যর মতো কথা বলছিস কেন?’ এবার অহনা রেগে যায়।
আমি স্বর নামি বলি, ‘স্যরি।’
অহনা এবার শান্ত গলায় বলে, ‘নে, গানটা আবার শোনা।’
আমি গানটা আবার শোনাই।
গান শুনে অহনা যথারীতি মুগ্ধ হয় আর অবাকও হয়। বলে, ‘এ গানটা আমি তোর কাছেই প্রথম শুনলাম। আরেকবার শোনা তো।’ আমি আরেকবার পিসিতে গানটা শোনাই, আর তৃপ্তিতে আপ্লুত হয়ে উঠি।
‘কার কণ্ঠ রে?’ অহনা জানতে চায়।
‘শিল্পীর নামটা জানা নেই।’
‘সন্দীপন?’
‘আমি তো সন্দীপনের কণ্ঠ চিনি না। ওর গান শোনা হয় নি।’
‘পবন দাশ বা পূর্ণ দাশ বাউলও হতে পারে।’
‘আমি তাঁদের গানও শুনি নি।’
‘তুই কার গান শুনেছিস?’ অহনার কণ্ঠে বিরক্তি ও ক্ষোভ।
‘এত ঝাড়ি মারিস কেন, কথায় কথায়? তুই কি ঝাড়ুদার?’ আমিও ক্ষেপে যাই।
অহনা একটু থেমে নরম হয়ে বলে, ‘গানটা আমার খুব খুব খুবই ভালো লাগলো। আরেকবার ছাড় তো।’
এভাবে অনেক অনেক বার, অনেক অনেকদিন শিল্পীর নাম না-জানা এ গানটা আমরা মুগ্ধ হয়ে শুনেছি। একদিন অহনা জিজ্ঞাসা করে, ‘তোর মনে কি খুব দুঃখ?’
‘কেন?’
‘এই গানটা যে এত শুনিস, তাই বললাম। আমার মনে হয় জীবনে কেউ তোকে ঠকিয়েছে, বা ঠকাচ্ছে। যাই হোক, মনে কোনো দুঃখ রাখবি না, বুঝলি?’
‘হুম!’
পিসিতে গানটা ছেড়ে দিই, সুরের ভুবনে হারিয়ে যেতে যেতে কাউকে-না-বলা দুঃখটা ভুলে যেতে চেষ্টা করি।
একদিন জানতে পারি, অসাধারণ এ শিল্পীর নাম স্বাগত দে। তার আরো অনেক গান আমি শুনতে থাকি। তার কণ্ঠনিঃসৃত গানগুলো গান-পাগল মানুষের হৃদয়-মনকে উন্মন ও উন্মাতাল করেছে। আর অহনা আর আমার প্রগাঢ় আবেগের সাক্ষ্য বহন করে চলেছে ‘তোরে রাং দিল কী সোনা দিল’ নামের হৃদয়ক্ষয়ী গানটি। অহনাকে আমি ভুলে যেতে চাই। অহনাকে আমি ভুলে যেতে চাই। কিন্তু ‘রাং দিল কি সোনা দিল’ আমাকে ভুলে যেতে দেয় না। তবু আমি তাকে ভুলে যেতে চাই। ভুলে যেতে যেতে একদিন এ গানটা নিজেই আমার সমস্তটকু উজাঢ় করে দিয়ে গেয়ে পৃথিবীর বাতাসে ভাসিয়ে দিলাম :
তোরে রাং দিল কি সোনা দিল, তুই পরখ কইরে দেখলি না
গুরু তোরে কী ধন দিল চিনলি না মনা
গুরু দিল খাঁটি সোনা
রাং বইলে তোর জ্ঞান হইল না, ওরে দিনকানা
ওরে উপাসনা বিনে কি তোর মিলিবে রে রুপাসোনা
গুরু তোরে কী ধন দিল চিনলি না মনা
তোরে রাং দিল কি সোনা দিল
চণ্ডীদাস আর রজকিনী
তারা প্রেমের শিরোমণি, রাং কইরাছে সোনা
তারা এক প্রেমেতে দুইজন মইলো, এমন মরে কয়জনা
গুরু তোরে কী ধন দিল চিনলি না মনা
তোরে রাং দিল কি সোনা দিল, তুই পরখ কইরে দেখলি না
গুরু তোরে কী ধন দিল চিনলি না মনা
৭ জুলাই ২০০৯
২৬ শে সেপ্টেম্বর, ২০২২ রাত ১:১২
সোনাবীজ; অথবা ধুলোবালিছাই বলেছেন: গানটি আপনি শুনেছেন দেখে খুবই আনন্দিত আমি। হ্যাঁ, আমার স্ত্রীও আজকে যখন এডিটিঙের সময় বার বার বাজাচ্ছিলাম, আপলোড করার পর স্মার্ট টিভিতে দেখছিলাম, মনোযোগ দিয়ে শুনছিলেন। আমি নিজেই কমেন্ট করলাম, গানটা কিন্তু আমি খুব ভালো গেয়েছি।
কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি জলদস্যু ভাই। শুভেচ্ছা নেবেন।
২| ২৬ শে সেপ্টেম্বর, ২০২২ সকাল ৭:১১
সোহানী বলেছেন: অনেক ভালো লাগলো কথোপকথন। গানগুলোও চমৎকার।
২৬ শে সেপ্টেম্বর, ২০২২ সকাল ১১:৪৯
সোনাবীজ; অথবা ধুলোবালিছাই বলেছেন: অনেক ধন্যবাদ আপু। শুভেচ্ছা নিন।
৩| ২৬ শে সেপ্টেম্বর, ২০২২ সকাল ৮:০৭
কামাল৮০ বলেছেন: এটি একটি প্রাচীন লোকগীতি।বিভিন্ন শিল্পীর কন্ঠে কিছু লাইন এদিক সেদিক করে গাইতে শুনেছি।আপনার কন্ঠেও বেশ ভালো লাগলো।
২৬ শে সেপ্টেম্বর, ২০২২ সকাল ১১:৫৩
সোনাবীজ; অথবা ধুলোবালিছাই বলেছেন: আমি এ গানটা প্রথম শুনি যার কণ্ঠে, সেই শিল্পীর নাম আমি জানতে পারি অনেক পরে - স্বাগত দে। এরপর বাংলাদেশের পারভেজ অথবা সফি মণ্ডলের কণ্ঠে শুনি চ্যানেল নাইন-এর কোনো এক অনুষ্ঠানে। এ গানটির গীতিকার ও সুরকার হলেন হেমাঙ্গ বিশ্বাস। উইকিপিডিয়া থেকে জানা যায়, হেমাঙ্গ বিশ্বাস (জন্ম: ১৪ ডিসেম্বর ১৯১২ - মৃত্যূ: ২২ নভেম্বর ১৯৮৭) একজন ভারতীয় গায়ক, গীতিকার, সুরকার এবং বামপন্থী রাজনৈতিক কর্মী। তিনি বাংলা ও অসমীয়া ভাষায় নিজ সৃষ্টিকর্মে সৃজন করেছেন। মূলত লোকসঙ্গীতকে কেন্দ্র করে গণসঙ্গীত সৃষ্টির ক্ষেত্রে তার অবদান উল্লেখযোগ্য, তিনি ভাটিয়ালি গানে নতুন মাত্রা সংযোজন করেছিলেন।
আমার কণ্ঠেও গানটা আপনার ভালো লেগেছে জেনে আমি সত্যিই আপ্লুত বোধ করছি কামাল ভাই। অনেক ধন্যবাদ গানটি শুনে আমাকে উৎসাহিত করার জন্য।
৪| ২৬ শে সেপ্টেম্বর, ২০২২ সকাল ১১:৪৫
জুল ভার্ন বলেছেন: চমৎকার গেয়েছেন সোনা ভাই। ভিন্নধারার কণ্ঠস্বর ভালো লাগলো। +
২৬ শে সেপ্টেম্বর, ২০২২ সকাল ১১:৫৪
সোনাবীজ; অথবা ধুলোবালিছাই বলেছেন: জুল ভার্ন ভাই বলেছেন: চমৎকার গেয়েছেন সোনা ভাই। আমি সত্যিই খুব আনন্দিত আজ। এ গানটা গেয়ে যেমন আমি তৃপ্তি পেয়েছি, এর উপর ফিডব্যাকও আমাকে তেমনি আনন্দ ও উৎসাহ দিচ্ছে। আপনাকে অনেক ধন্যবাদ প্রিয় জুল ভার্ন ভাই। শুভেচ্ছা রইল।
৫| ২৬ শে সেপ্টেম্বর, ২০২২ দুপুর ২:১৪
ভুয়া মফিজ বলেছেন: অহনাটা কে? ভাবী জানে? না জানলে ভাবীর মুবাইল নাম্বারটা দয়া কইরা যদি ইকটু দিতেন!!!
২৬ শে সেপ্টেম্বর, ২০২২ দুপুর ২:২৯
সোনাবীজ; অথবা ধুলোবালিছাই বলেছেন: ইয়ে, আই মিন, আপনি কী খেতে ভালোবাসেন? কয় প্যাকেট পাঠাইতে হবে বলেন, আর ঠিকানাটা পার্সেল করেন
৬| ২৬ শে সেপ্টেম্বর, ২০২২ বিকাল ৩:০১
নিবর্হণ নির্ঘোষ বলেছেন: এইধরনের আরেকটি গান মনে হয় আনুশেহ আনাদিলও গেয়েছিল !
২৬ শে সেপ্টেম্বর, ২০২২ বিকাল ৩:১৪
সোনাবীজ; অথবা ধুলোবালিছাই বলেছেন: আনুশেহ আনাদিলের গাওয়া এরকম গানটা রিলেট করতে পারছি না। 'তোমার মনে বসত করে কয়জনা'র কথা বলেছেন কি? ওটা জাহিদ আহমেদের লেখা ও সুর করা গান। অন্য কোনো গানের কথা বলে থাকলে আর পারলাম না।
ধন্যবাদ কমেন্টের জন্য। শুভেচ্ছা।
৭| ২৬ শে সেপ্টেম্বর, ২০২২ বিকাল ৩:১২
ভুয়া মফিজ বলেছেন: লেখক বলেছেন: ইয়ে, আই মিন, আপনি কী খেতে ভালোবাসেন? কয় প্যাকেট পাঠাইতে হবে বলেন, আর ঠিকানাটা পার্সেল করেন নাহ.........ভাবীর সাথে জরুরী আলাপটা না সারলে চলছে না। মনে রাখবেন, ঘুষদাতা এবং ঘুষখোর উভয়েই দোজখের আগুনে জ্বলিবে। আল হাদিস।
২৬ শে সেপ্টেম্বর, ২০২২ বিকাল ৩:১৬
সোনাবীজ; অথবা ধুলোবালিছাই বলেছেন: এই তো মুশকিলে ফেললেন ব্রো। ঘুষ হিসাবে না নিয়া ওটাকে সম্মানি হিসাবে নিয়েন
৮| ২৬ শে সেপ্টেম্বর, ২০২২ বিকাল ৪:৪৬
পদাতিক চৌধুরি বলেছেন: প্রিয় সোনাবীজ ভাই,
আপনি গুণীজন।অমন সুন্দর কথোপকথন করে জাতীয় সংগীতের অনেক অজানা তথ্য উপস্থাপন করলেন সঙ্গে আপনার অমন হৃদয় ছোয়ানো দরদিও গাওয়া গানে রইলো মুগ্ধতা।++
২৬ শে সেপ্টেম্বর, ২০২২ বিকাল ৫:০০
সোনাবীজ; অথবা ধুলোবালিছাই বলেছেন: প্রিয় পদাতিক ভাই, শুভেচ্ছা নিন। ধন্যবাদ সুন্দর কমেন্টের জন্য।
আপনি গুণীজন - ব্লগের এত এত গুণীজনের ভিড়ে নিজেকেও এই অভিধায় সম্বোধিত হতে দেখলে ভালো লাগার পাশাপাশি অনেক লজ্জা ও বিব্রতবোধও হয় কিন্তু। যাই হোক, আপনিও ব্লগের গুণীজনদের একজন। আপনার উদারতায় আমি মুগ্ধ হলাম।
লেখাটা শুরুতে অনেক ছোটো ছিল। পুরোনো লেখা। এডিট করতে করতে আজ এত বড়ো। আরো কিছু তথ্য যোগ কিংবা পরিমার্জিত হবে ভবিষ্যতে।
এত বড়ো পোস্ট পড়া ও আমার গান শোনার জন্য আপনাকে অনেক ধন্যবাদ প্রিয় পদাতিক ভাই।
৯| ২৬ শে সেপ্টেম্বর, ২০২২ রাত ১০:১২
Subdeb ghosh বলেছেন: অসাধারন প্রতিভা আপনার।
খুব সুন্দর কণ্ঠস্বর!
২৬ শে সেপ্টেম্বর, ২০২২ রাত ১০:৪৯
সোনাবীজ; অথবা ধুলোবালিছাই বলেছেন: Subdeb ghosh@
আপনাকে ব্লগে দেখে ভালো লাগছে। যে গুটিকতক ব্লগার সাবলীল কবিতা লেখেন, আপনি সেই স্বল্প কজনের একজন। আশা করি কবিতায় মনোযোগী হবেন এবং ব্লগে নিয়মিত লিখবেন।
অসাধারন প্রতিভা আপনার। অভাবনীয় লজ্জা পেয়েছি। লজ্জার ইমো কোনটা, সেটাই জানি না, তাহলে বুঝুন আমার প্রতিভার দৌড়
গানটা শোনার জন্য অনেক ধন্যবাদ আপনাকে। শুভেচ্ছা নিন।
©somewhere in net ltd.
১| ২৬ শে সেপ্টেম্বর, ২০২২ রাত ১:০৮
মরুভূমির জলদস্যু বলেছেন:
গানটি চমৎকার গেয়েছেন আপনি।
আপনার গাওয়া গানের তালিকা করলে এটি উপরের দিকে থাকবে।