নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

আমার চারপাশের মানুষ গুলো অনেক ভাল।

নিথর শ্রাবণ শিহাব

মাটির মানুষ ভিজলে কাদা হয় না কেন প্রশ্ন জাগে, মানুষ গড়া অন্যকিছুয় আমার শুধু এমন লাগে।

নিথর শ্রাবণ শিহাব › বিস্তারিত পোস্টঃ

তাগাদা আর তাড়না

১৫ ই সেপ্টেম্বর, ২০১৪ দুপুর ১২:০০

“যখন কিছু লেখেন না, কি করেন তখন? খুব বই পড়েন?” কৌতূহলী এক ছোট ভাইয়ের প্রশ্ন ছিল।

“উপদেশ বিলিয়ে বেড়াই। সেটা যখন কেউ শুনতে চায় না, তখন দম বন্ধ, গলা বন্ধ, প্রবন্ধ লিখি সেই উপদেশ সংক্রান্ত বিষয় নিয়ে।” উত্তর দিয়েছিলাম।

এখন আসি কি নিয়ে আজকের আলাপটা করা যায় সে প্রসঙ্গে। একঘেয়ে চাকরির বাকরির কারণে আজকাল আর পরসঙ্গে না থাকার ফলে কথা বলার যুতসই প্রসঙ্গ পাওয়া দায় হয়ে গেছে। প্রবন্ধ লেখার শুরুতেই বিষয়বস্তুর তীব্র অভাব অনুভব করি লোকালয়ে না থাকার কারণে। গুহাবাসী মানুষেরা আলোর খবর রাখলেও আলোর জগতের খবর খুব একটা রাখে না। আমার বেলাতেও তাই। অল্প বিস্তর গুহা থেকে বেরিয়ে আলোর জগতে হেঁটে আসার একটা তাড়না ভেতর থেকে মাঝে মাঝেই অনুভব করি প্রসঙ্গের অভাব বোধ করলে। তাগাদা অনুভব করি না। বা কেউ দিলেও নেই না।

কথা হচ্ছিল উপদেশ বিলানো নিয়ে। ছোট ভাইয়ের প্রশ্নটাও করা হয়েছিল একটা প্রসঙ্গের কারণে। লেখা পাচ্ছেন না তিনি আমার। সেই সময় খুব সম্ভব লেখা লেখির বড় সড় একটা খরা যাচ্ছিল আমার ওপর দিয়ে। এখনও যাচ্ছে। তো নিয়মিত লেখা না পাওয়ার কারণে খানিকটা হতাশ এবং বিরক্ত হয়েই জিজ্ঞেস করেছিল আমি লিখছি না কেন? কি করে বেড়াচ্ছি বর্তমানে বা তদানিন্তন খরা প্রিয়ডে। অনেকের হয়ে নিজের কিংবা নিজের হয়ে অনেকের উত্তর দিয়েছিলাম।

পাঠকদের নিয়ে বহু আগেই অনেক জ্ঞানী গুণীজন নানান কথা লিখে গেছেন। তাই আমার বিষয়বস্তু পাঠক নয়, লেখক। আপনি যদি লেখক হয়ে থাকেন নিশ্চিন্তে যোগ দিতে পারেন এই প্রবন্ধে। লেখক হবার বেশ কিছু মধুর যন্ত্রণা রয়েছে সেটা আপনি অনুভব করলেও হয়তো স্বীকার করবেন না। কিংবা সলজ্জ্বভরে স্বীকার করলেও যন্ত্রণা হিসেবে অনুভব করবেন না। মধুর যন্ত্রণাটা হচ্ছে আপনি যখন লিখছেন না- সেই সময় আপনাকে প্রকাশক, পাঠক কিংবা শুভানুধ্যায়ীরা আপনাকে ‘লিখছেন না কেন? কখন নতুন লেখা পাবো? লেখা লেখি ছেড়ে দিয়েছেন? তাড়াতাড়ি নতুন লেখা চাই’ টাইপের সুমিষ্ট বচনে আপনার ‘ছুটি’র সময়টা বরবাদ করে দিতে পারে। ‘লেখকের ছুটি’ নিয়ে আমি আগের লেখাতে লিখে ফেলেছি। তাই এখানে নতুন করে বিষয়টা লম্বা করতে চাচ্ছি না। তো আপনাকে যখন আপনার ‘ডিমান্ডিং’ শ্রেণি ঘন ঘন এ ধরণের কথা বলতে থাকবে, শুনতে অনেকটা তাগাদার মত শোনায়। এবং খুব শান্ত মস্তিষ্কে বলছি- এই তাগাদা আপনার লেখা লেখিকে সীলগালা করা সাগরে ছুড়ে দেয়ার মত ব্যবস্থা করে দেবে। পরীক্ষার খাতায় অমুক কবির তমুক কবিতার প্রথম দশ লাইন লিখো বললে আপনি গড়গড়িয়ে মুখস্ত সেই কবিতা না হয় লিখেও দিতে পারলেন। কিন্তু পরীক্ষার শেষ দশ মিনিটের ইনভিজিলেটরের মত যদি প্রকাশক সাহেব কিংবা পাঠকেরা তাগাদা দিতে থাকে- তাড়াতাড়ি লিখো, সময় আর মাত্র দশ মিনিট বাকি- তখন হাজার বছর ধরে’র কেন্দ্রীয় চরিত্র নিয়ে ঘষা মাজা করতে থাকা ছাত্রটিও শতবার পড়ে আসা লেখাটাও খারাপ করে লিখে আসবে। তাড়াহুড়োয় কেন্দ্রীয় চরিত্রের কেন্দ্রীয় জামে মসজিদে জানাজা পড়িয়ে দিয়ে এলেন।

এটা তো গেলে মুখস্ত বিদ্যা বা পড়ে আসা বিদ্যার কথা। দশ মিনিটের তাগাদায় মুখস্ত বিদ্যার যদি এই দশা হয়- যে লেখা পূর্বে ‘লেখা’ই হয়নি, তার দশা কি হবে? অবশ্য সেখানে দশ মিনিট না বেঁধে দিলেও সময়, দিনক্ষণ, তারিখ ভালই বেঁধে দিতে জানেন প্রকাশক আর পাঠকবৃন্দ। এবং সময় বাঁধতে গিয়ে যে লেখকের লেখনীর গলায় ফাঁসীর দড়ি বেঁধে দিয়েছেন সেটা আর লক্ষ্য করেন না। তাগাদায় পড়ে গিয়ে উলটো লেখার বিষয়বস্তুর খরায় থাকা লেখকের অবস্থা দাঁড়ায় এমন, যে খোদ ভগবান ঈশ্বর আল্লা করে করেও কোনো কিছু যদি বের করা যেত!



“এই ধরণীর ধূলি-মাখা তব অসহায় সন্তান

মাগে প্রতিকার, উত্তর দাও, আদি-পিতা ভগবান!”



নজরুল ইসলাম সাহেব তাঁর ফরিয়াদ কবিতা কাকে নিয়ে লিখেছিলেন জানি না, কিন্তু বিসমিল্লাতেই যে দু’লাইন লিখেছেন তাতে কলম হাতে ভোঁতা মুখো লেখকদের মুখচ্ছবিটাই ভেসে ওঠে চোখের সামনে। প্রকাশক, পাঠক, ভক্তকূলের অত্যাচারে এই দু লাইন গেয়ে উঠতেই পারেন আপনারা। অসুবিধা নেই। কবি তো এমনিতেই বলে গেছেন, ‘আমি এই দেশ, এই সময়ে জন্মেছি বলে যে আমি কেবল এই দেশ এবং এই সময়ের তা নয়। আমি সকল দেশের, সকল সময়ের।’ কবির কবিতাও নিশ্চয় সেই শ্রেণিতে পড়ে। লাইনগুলো সকল ভুক্তভোগীদের, সমস্ত দুনিয়ার টেবিলের সামনে বসে থাকা অসহায় লেখক সম্প্রদায়েরও তো হতে পারে!

বললেই তো আর লেখা সম্ভব না। সৈয়দ মুজতবা আলীর ‘খোশগল্প’ প্রবন্ধে তিনি স্বর্গত ক্ষিতিমোহন সেনের একটা উক্তি দিয়েছিলেন এই ‘তাগাদা’র উত্তরে। তিনি বাঙাল উচ্চারণে বলতেন, “ঘর লেপ্যা মুছ্যা, আতুড়ঘর বানাইয়া, মা ষষ্ঠীর গেছে ব্যাচ্যা চাইলেই তো আর বাচ্চ্যা পয়দা হয় না। নয় মাস দশ দিন সময় লাগে।” অর্থাৎ গল্পের সময় এলেই তবে গল্প বেরুবে। কিন্তু প্রকাশক কিংবা পাঠককে সে কথা কে বোঝাবে। তাদের চাই লেখা। ব্যবসার জন্য লেখা, পড়বার জন্য লেখা কিংবা কদাচিৎ কিনে এনে ড্রইং রুমের সেলফের শোভাবর্ধনকারী বই। প্রকাশকের বইবেচা আর পাঠকের বইকেনা বিষয়ে শেষ দিকে কিছু কথা বলে যবনিকা টেনে দেবো। আপাতত ‘তাগাদা’ নিয়ে গাদা গাদা না হোক, অল্প সল্প কিছু কথা হোক।

আমার জানা মতে প্রচুর ডিমান্ডে থাকা লেখকদের নিঃশ্বাস ফেলার ফুরসত নেই প্রকাশক বা পাঠকদের মধুর অত্যাচারে। সেটা ডিমান্ড না রিমান্ড সেটা জানা নেই- কিন্তু লেখা বের করা চাই’ই চাই তাদের। যেন অবস্থা দর্শনে মনে হয় “টাইম বোম কিধার ছুপায়া হ্যায়? নেহিতো গাড়দেঙ্গে!” এবং লেখকদের ত্রাহী ত্রাহী অবস্থা। কাচুমাচু মুখে উত্তর দেন, “দিয়ে দেবো দিয়ে দেবো! আর কটা দিন সবুর কর!”

এই তো বছর খানেক আগেন রেডিও ফূর্তির ‘হট চেয়ার’ নামক শো’তে বসানো হয়েছিল প্রখ্যাত কলামিস্ট-লেখক আনিসুল হককে। তিনি একের পর এক ভক্তদের উত্তর দিয়েই যাচ্ছেন। কিন্তু এর মাঝে ভক্তদের মাঝ থেকে ঘটনাক্রমে ফারুকি সাহেব ফোন দিয়ে বসলেন। এবং প্রথম কথা বাদে দ্বিতীয় কথাতেই ভারিক্কী চালে বলে বসলেন, “আমার থার্ড পার্সন সিঙ্গুলার নাম্বারের লেখা কবে শেষ করবেন ভাই? একটু তাড়াতাড়ি করেন না?”

আনিসুল হক সাহেব বেমক্কা এই প্রশ্নে থতমত খেয়ে খানিকটা উজির উজির গলায় ফারুকিকে উত্তর দিয়েছিলেন, “এইতো ভাই কাজ এগুচ্ছে। হলেই দিয়ে দিবো। একটু সময় দিন!”

ফারুকি সাহেব প্রকাশক নন। কিন্তু শ্রেণি বিশেষে তিনিও অনেকটা ঐ শ্রেণিতেই পড়েন। চলচ্চিত্র নির্মাতা। তাঁর ‘তাগাদা’ আর প্রকাশকদের তাগাদায় খুব একটা পার্থক্য নেই। একই।

খ্যাতিমান সাহিত্যিকদের হঠাৎ ভাঁটা পড়ার পেছনে ছোট একটা কারণ রয়েছে। লেখার মান কমে যাওয়ার পেছনেও সেই একই কারণ। ঘন ঘন তাগাদা দেয়া। তাঁদের কথা হচ্ছে ঠেলা না দিলে ইঞ্জিন স্টার্ট নেয় না। তাগাদা না দিলে লেখক লেখা দেবে না।

কিন্তু কথাটা সত্য না। বরং তাগাদা দিলেই লেখা নষ্ট হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা খুব বেশি। সেটা খ্যাতিমান সাহিত্যিক হোক কি অন লাইনের ক্ষুদ্র লেখক। লেখা বিগড়ে যেতে বাধ্য। বিশেষ করে লেখার জন্য চাপ যদি দিতে থাকে ঘন ঘন।

মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় সাহেবের প্রকাশক, নামটা ঠিক মনে নেই। তিনি এক মাসে প্রায় তিন চারটা করে চিঠি দিতেন মানিককে লেখা পাঠানোর জন্য। সেটা গল্প হোক, প্রবন্ধ হোক, ছাইপাঁশ হোক কোনো সমস্যা নেই। না পাঠালে কাগজ বেরুবে না, বিকবেও না। জবাবে মানিক ছোট উত্তর দিয়েছিলেন চিঠিতে, “লেখা চাহিয়া ঘন ঘন ‘পত্রাঘাত’ বন্ধ না করিলে কৃতজ্ঞ হইতাম!”

আমি জানি সবাই সফল নন, সবার পেছনে প্রকাশকদের খুব বেশি অল্টারনেটিভ অপশন নেই। তাই সুযোগ হাতছাড়া হবার ভয়ে থেকেও লিখতে হয়। পাছে লক্ষ্মী নারাজ হলে সব যাবে। কিন্তু নিজেকে লেখার মাঝে বেঁধে ফেলাটাও খুব খারাপ জিনিস। জীবিকার জন্য সাহিত্যকে বেছে নেবেন না। তাহলে তাগাদা খেয়ে খেয়েই বেঁচে থাকতে হবে। অভাবী লেখক মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় এক প্রকাশকের বাড়িতে ভাত খাওয়ার সময় দুঃখ করে বলেছিলেন, “দুটো ভাত কাপড়ের ব্যবস্থা না করে কেউ যেন সাহিত্যে না আসে।” তাহলেই বুঝুন। সাহিত্যকে মুক্তি দিন যাবতীয় শৃঙ্খল থেকে। নাহলে আপনার মুক্তি অনিশ্চিত হয়ে যাবে চিরতরে।

‘তাগাদা’ ব্যাপারটা নিয়ে আমার আলোচনা শেষ এখানেই।

এখন সবাই বলবেন, কেউ যদি তাগাদা নাই’ই দেয়- তাহলে লেখকেরা জীবনেও লিখবে না। তাগাদার বদলে কি দিতে হবে লেখার জন্য?

উত্তরটা খুব সহজ। তাড়না। এবং সেটা বাহির থেকে কাউকে দিতে হবে না। লেখক নিজেই নিজের ভেতর থেকে তাড়না অনুভব করবেন একটা সময় ‘ছুটি শেষ হয়েছে। কিছু লিখতে ইচ্ছে করছে’। তাগাদা যেরকম ধ্বংসাসী, তাড়না তেমনি আয়ুবর্ধক। একজন লেখক অন্যের কথায় কান দিয়ে নয়, বরং নিজের ভেতর থেকে যখন অনুভব করতে শুরু করবেন যে কিছু লিখতে ইচ্ছে হচ্ছে ধরে নেবেন ‘তাড়না’ শুরু হয়ে গেছে। এবং যে লেখা সেই তাড়নার প্রেক্ষিতে সৃষ্টি হয়, আমি বলবো এরচেয়ে বিশুদ্ধ লেখা আর হতে পারে না। বহুল প্রচলিত ফারসি এক প্রবাদ রয়েছে, “একবিন্দু শিশিরেই বন্যা হতে পারে, যদি সেটা পিঁপড়ের গর্ত হয়।” কথাটাকে লেখকদের বেলাতেও খাটানো যায় অর্থ সামান্য এদিক সেদিক করে। ক্ষুদ্র তাড়না থেকে সৃষ্টি হতে পারে বৃহৎ সাহিত্য, সেটার আকারের দিকে তাকাবার দরকার নেই। অনুপ্রেরণার দেহকায় সাইমুম ঝড়তুল্য হতে হয় না, মৃদু বাতাসের মত হলেও বেশ টের পাওয়া যায় এবং গরমে অতিষ্ট হয়ে যাওয়া জীবনে প্রশান্তি নিয়ে আসে। আর ঝড় এলে সব ওলট পালট করে দিয়ে যায়। তাগাদাকে ঝড়ের সঙ্গে তুলনা করে তাড়নাকে আমি মৃদু হাওয়া রূপেই আখ্যা দেবো।

এখন অনেকের মনেই প্রশ্ন আসতে পারে, "আমাকে কেউ তাগাদা না দিলে আমি লিখতে পারতাম না। আমাকে চাপ দেয়ার কারণেই আমার লেখার খরা দূর হয়েছিল।"

তাগাদা আর তাড়না দুটোর মাঝে পার্থক্য রয়েছে। নিজের ভেতরে নিভু নিভু ইচ্ছা না থাকলে তাগাদা কখনো উৎসাহে পরিণত হয় না। চুলার কাঠে লাল আগুন থাকলেই চোঙ্গা দিয়ে ফুঁ দিলে আগুনের শিখা বের হয়। ভেতরে আগুন না থাকলে যতই চোঙ্গা দিয়ে ফুঁ দিক না কেন, আগুনের শিখা উঠবে না। কেবল ছাই উড়বে। কেউ যদি এমনটা দাবি করে থাকেন যে কারো চাপ দেয়াতে তিনি লিখতে শুরু করেছিলেন- আমি বলবো সেটা তার নিজের আগুনের ফসল। শুভাকাঙ্ক্ষীদের ফুঁ'টা জায়গাতে পড়েছে। নাহলে হিমু চরিত্রের শেষ বইগুলোর দশা হয়ে যায় লেখকদের। মানে ছাই উড়েছে।

লেখার জন্য অনুপ্রেরণার দরকার রয়েছে। তাই বলে এটা কখনোই ধরে নেয়া উচিত নয় যে যতক্ষণ না প্রশংসার বারিধারা আপনার ওপর বর্ষণ হচ্ছে- আপনি লিখতে পারবেন না। এটা অন্যায়। আপনার লেখার জন্য নির্জনতা প্রয়োজন। প্রয়োজন অভাব অনটনবিহীন সামান্য একটা জীবন। উচ্চাশা নিয়ে সাহিত্য হয় না। তাড়নাও তখন ভেড়া তাড়ানোর মত আপনার প্রতিভাকে তাড়িয়ে নিয়ে বেড়াবে। লেখা আর সম্ভব না। কান্তি ঘোষের ভাষাতেই বলি,



“সেই নিরালা পাতায় ঘেরা বনের ধারে শীতল ছায়,

খাদ্য কিছু, পেয়ালা হাতে, ছন্দ গেঁথে দিনটা যায়।

মৌন ভাঙ্গি মোর পাশেতে গুঞ্জে তব মঞ্জু সুর-

সেই তো সখি স্বপ্ন আমার, সেই বনানী স্বর্গপুর।”





আপনাকে খুব সামান্যতেই সন্তুষ্ট থাকা শিখতে হবে। তাড়নার তো তখনই আসবে ভেতর থেকে যখন আপনি অভাব থেকে শিক্ষা নেবেন, শিক্ষা নেবেন বাস্তবতা আর ঠোকর খাওয়া সমাজের ভাঙা স্ট্র্যাকচারের ফ্র্যাকচার ধরা নিয়মের সাথে ঝুঝতে গিয়ে। আয়েশি জীবনে সাহিত্য আয়েশ করেই বেড়াবে। বাস্তব দর্শন অনেকখানি কঠিন হয়ে যায় সত্যি বলতে। তবু রবীন্দ্রনাথদের মত কিছু দানব সাহিত্যিক রয়েছে যাঁরা আমার এই কথাখানা কর্পূরের মত উড়িয়ে দেয়ার জন্য উদাহারণ রূপে নিজেদের জীবন কাহিনী রেখে গেছেন। কিন্তু মাইকেল মধুসূদনের কথাও ভুলে গেলে চলবে না। কিংবা নজরুলের ছেলের চিকিৎসার খরচ জোগাতে ট্রেনের টিকিটে আর রশিদের অপর পিঠে পেন্সিল দিয়ে লেখা সাহিত্যের কথাও মনে রাখা উচিত। বিলাসিতার উদাহারণগুলোকে ভিনেগারে ডুবিয়ে আলাদা করে রাখাই উত্তম। নাহলে সাহিত্যের সংজ্ঞা সম্পর্কে মানুষের ভ্রান্ত ধারণা সৃষ্টি হবে।

তাগাদা আর তাড়না শেষে এবারে আসি একটু ভিন্ন প্রসঙ্গে। সাহিত্যে আসার আগে যাবতীয় দায় দায়িত্ব থেকে মুক্ত হয়ে আসার কথা আমি পূর্বেই বলেছি। এখন সে সম্পর্কে আরো দুটো কথা বলি।

গেল বইমেলাতে আমার একটা বই প্রকাশের কারণে সোহ্‌রাওয়ার্দী উদ্যানে গিয়েছিলাম। স্টলের সামনে মলিন মুখে বই নাড়াচাড়া করছিলাম। দুই জন এসে বই কেনে তো দুই ঘণ্টা কোনো পাঠকের দেখা নেই। এর মাঝে আগমন আরেক শ্রদ্ধেয় বড় আপা এবং সাহিত্যিক একুয়া রেজিয়ার। তিনি এসেই হালুম করে আমার বইটা কিনে ফেললেন। তারপর বেশ খানিকক্ষণ কথা হচ্ছিল। নতুন চাকরী নিয়েছি দেখে নিয়মিত লেখালেখি করতে পারছি না দেখে আপার কাছে আফসোস করছিলাম।

তিনি সস্নেহে হেসে চমৎকার একটা কথা বলেছিলেন, “এটাই তো আসল পরীক্ষা হে বাছা! প্রোফেশন আর প্যাশনের কম্বিনেশন করতে গিয়ে হিমশিম খেতে খেতে কতটা ট্র্যাকে থাকতে পারছো- সেটাই বড় পরীক্ষা। এখানে উতরে গেলেই হল। চিন্তার কিছু নেই!”

কথাটা মনে ধরেছিল সেদিন। সত্যিকার অর্থেই একজন লেখকের অনেক কাজের মাঝেই নিজের লেখালেখি, তাড়না কিংবা অনুপ্রেরণাকে নিজ দায়িত্বেই খুঁজে নিতে হবে। বাহির থেকে কেউ এসে আপনাকে জায়গা করে দেবে না। এটা একান্তই আপনার পরীক্ষা।

তাড়না সৃষ্টি আপনা থেকেই হবে। এরজন্য অসুধ পত্রের দরকার নেই। দরকার জীবন থেকে শিক্ষা নিতে থাকা। আপনি ফিকশন লিখুন আর যাই লিখুন- আপনার চিন্তার বীজ পৃথিবীতে রয়েছে। মঙ্গলে নয়।

এখন দ্রুত কথা শেষ করা দরকার। অনেকটাই টেনে টেনে লম্বা করে ফেলছি আলোচনাটা।

আমি খুব অবাক হয়ে লক্ষ্য করছি- আমাদের বর্তমান সময়ের পাঠকেরা বইয়ের কাগজের ব্যাপারে খুবই সেন্সেটিভ। ঘটনাটা ঠিক পরিষ্কার নয় আমার কাছে। তারা বই কিনতে গেলেই প্রচ্ছদ আর বইয়ের কাগজ নিয়ে খুঁত খুঁত করতে থাকেন সারাক্ষণ। অথচ আপনাদের এই খুঁত খুঁতে স্বভাবের জন্য প্রকাশকেরাও লাই পেয়ে পেয়ে বই দাম এখন গাছে চড়াতে লেগেছেন। এক যুগ ছিল যখন বইয়ের পৃষ্ঠাকে পাঁচ ছয় দিয়ে ভাগ করেও যা আসতো- বইয়ের দাম তার চেয়েও শ খানেক কম হতো। আর এখন এসেছে অফসেটের জামানা, বোধহয় প্রকাশক এবং সন্দিহান লেখকও চান পাছে বিক্রি না হলে যেন রদ্দিওয়ালার দোকানে ঠোঙ্গা বানানোর কাজে যেন ঠিক টেকসই জিনিস হিসেবে চালিয়ে দেয়া যায় তাদের বই, কোনো ঝামেলা যেন না হয়! বইয়ের পৃষ্ঠার দেড়ুগুণ থাকে বইয়ের দাম। দাম শুনে মোটামুটি কিসমিসের মত মুখ শুঁকিয়ে ফেরত চলে আসতে হয় বইকেনা পাঠকদের। আপনার দুই ঢালে আবদ্ধ কিছু কালির প্রয়োজন, দুই ঢালে আবদ্ধ স্বাস্থ্যবান কাগজ নয়। নাহলে বাংলাবাজার অথবা আন্দরকিল্লা রয়েছে। রিম শুদ্ধ কিনতে পাওয়া যায়। কিনে এনে বাসায় সাজিয়ে রেখে দেবেন।

আমার আফসোস লাগে যে আমার সামনেই এক পরিচিত ছোট ভাই এবং লেখক গল্প সংকলনে নিজের গল্প দেখে যতটা না খুশি হয়েছে, তার চেয়ে মুখ কালো বেশি করেছে এই বলে, “ভাই, প্রচ্ছদটা কিছু হয়েছে? আপনিই বলেন? আর কাগজ দেখেছেন? দুই টাকা দামের জিনিস!”

আমি অবাক হলেও কিছু বলতে যাইনি। অসুখ পায়ে হয়েছে, হাতে ব্যান্ডেজ লাগিয়ে লাভ নেই। প্রকাশকদের গালমন্দ করে লাভ কি?

কাগজের মিডিয়ামটা বলাই বাহুল্য- চিরসবুজ এবং জীবন ঘেষা একটা মিডিয়াম। এর বিকল্প সৃষ্টি করতে পারেন, কিন্তু আবেদনটা সেই আগের জায়গাতেই থেকে যাবে। যদিও এখনা আমাদের বইকেনার সৌখিনতাটা ষঢ়ঋতুর ঋতু বৈচিত্র্যের মত উদয় হয় ফেব্রুয়ারি মাস এলে। মাস গেলে আবার গায়েব হয়ে যায়। অপেক্ষা চলে পরের বছরের। বাকি বছরটা যে বই কেনা অঘোষিত ভাবে নিষিদ্ধ হয়ে গেছে, সেটা বোধকরি প্রকাশক, লেখক, বা পাঠককে কানের কাছে এসে ভেঁপু বাজিয়ে শোনাতে হবে না! সিজনাল ফলফ্রুটকে যেখানে বহু কায়দা কসরত করে বিজ্ঞানীরা বারোমাসি ফল বানিয়ে দিচ্ছেন, সেখানে আমরাই বারোমাসি বইকেনা কালচারটাকে সিজনাল ফল বানিয়ে দিতে বসেছি।

এখন এসেছে পিডিএফ’এর যুগ। ঘরে বসেই বই পড়ার জন্য বইয়ের কপি ডাউনলোড করে লেড অথবা কিন্ডলের স্ক্রিনে পড়ছে অনেকেই। বইকেনা সম্বন্ধীয় প্রবন্ধে সৈয়দ মুজবতা আলী আফসোস করে আরব্য রজনীর হেকিম দুবানের কথা বলেছিলেন। রাজাকে বিষওয়ালা বই পড়িয়েছিলেন মৃত্যুর সময়। জোড়া লেগে থাকা পাতা ছোটাতে রাজা বার বার জিভে আঙুল দিয়ে পাতা ওল্টাতে গিয়ে পাতায় থাকা মারাত্মক বিষ খেয়ে নিচ্ছিলেন নিজের অজান্তেই। এবং শেষ পর্যন্ত মৃত্যুর মুখে ঢলে পড়েন। মুজতবা আলী বলছেন বাঙালি পাঠকদের বই না কেনার পেছনে এই বিষের ব্যাপারটা দায়ি। সবাই ভাবছে বইয়ের পাতায় বিষ থাকে। তাই বই কেনাই বাদ দিয়ে দিয়েছে।

আজ বেঁচে থাকলে তিনি পিডিএফ নিয়ে ডুবে যাওয়া এই তরুন সম্প্রদায়কে দেখে নতুন করে বলে উঠতেন নিশ্চয়, “বাঃ বাঃ এ দেখি সেয়ানা আছে! বিষের ভয়ে বই কেনা ছাড়লেও বই পড়া ছাড়েনি! দিব্যি পিডিএফ নামিয়ে গিলে নিচ্ছে!”

দুঃখের বিষয় হল কাগজের চিরন্তন আবেদনে মানুষকে ফিরতেই হচ্ছে ঘুরে ফিরে। ছোট বড় স্ক্রিনের অক্ষরে সাহিত্যের সেই স্বাদ আস্বাদন করতে ব্যর্থ বলেই বছর বছর বইমেলাতে খেটে খুটে হলেও ব্লগ কিংবা নেটে লিখতে থাকা নবীন প্রবীণ লেখকেরা বই বের করছেন। কারণ তাঁরা জানেন গন্তব্য একটাই।

অথচ কতটা ঘুরে ঘুরেই কিনা আমরা গন্তব্য যাচ্ছি। সিজনার ফল বানিয়ে দেয়া বইকেনার চর্চাটাকে বারোমাসি করে তোলা হোক, এই প্রার্থনাই রইল অন্তর থেকে।

লেখা শেষ করার মুহূর্তে সকল লেখকদের জন্য রবীন্দ্রনাথের “যাবার দিন” কবিতাটি রইলো। বোধকরি সবাই বুঝতে পারবেন কী করতে আপনাদের সকলকে অনুরোধ জানিয়েছি আমি কবিতাটা উল্লেখ করে-



“যাবার দিনে এই কথাটি বলে যেন যাই-

যা দেখেছি, যা পেয়েছি, তুলনা তার নাই।

এই জ্যোতিসমুদ্র মাঝে, যে শতদল পদ্ম রাজে

তারি মধু পান করেছি, ধন্য আমি তাই।

যাবার দিনে এই কথাটি জানিয়ে যেন যাই।।



বিশ্বরূপের খেলাঘরে কতই গেলেম খেলে,

অপরূপকে দেখে গেলেম দুটি নয়ন মেলে।

পরশ যাঁরে যায় না করা, সকল দেহে দিলেন ধরা,

এইখানে শেষ করেন যদি শেষ করে দিন তাই-

যাবার বেলা এই কথাটি জানিয়ে যেন যাই।।”





(সমাপ্ত)

মন্তব্য ৭ টি রেটিং +২/-০

মন্তব্য (৭) মন্তব্য লিখুন

১| ১৫ ই সেপ্টেম্বর, ২০১৪ দুপুর ১:৩৯

মামুন ইসলাম বলেছেন: যাবার দিনে এই কথাটি বলে যেন যাই-
যা দেখেছি, যা পেয়েছি, তুলনা তার নাই।
এই জ্যোতিসমুদ্র মাঝে, যে শতদল পদ্ম রাজে
তারি মধু পান করেছি, ধন্য আমি তাই।
যাবার দিনে এই কথাটি জানিয়ে যেন যাই।।

বিশ্বরূপের খেলাঘরে কতই গেলেম খেলে,
অপরূপকে দেখে গেলেম দুটি নয়ন মেলে।
পরশ যাঁরে যায় না করা, সকল দেহে দিলেন ধরা,
এইখানে শেষ করেন যদি শেষ করে দিন তাই-
যাবার বেলা এই কথাটি জানিয়ে যেন যাই।।”


দারুন বলেছেন ও লেখেছেন ভাই ++++++

১৬ ই সেপ্টেম্বর, ২০১৪ দুপুর ১:৪৮

নিথর শ্রাবণ শিহাব বলেছেন: অনেক ধন্যবাদ আপনাকে ভাই :)

২| ১৫ ই সেপ্টেম্বর, ২০১৪ দুপুর ২:১৭

নুর ইসলাম রফিক বলেছেন: সেই নিরালা পাতায় ঘেরা বনের ধারে শীতল ছায়,
খাদ্য কিছু, পেয়ালা হাতে, ছন্দ গেঁথে দিনটা যায়।
মৌন ভাঙ্গি মোর পাশেতে গুঞ্জে তব মঞ্জু সুর-
সেই তো সখি স্বপ্ন আমার, সেই বনানী স্বর্গপুর।”

৩| ১৫ ই সেপ্টেম্বর, ২০১৪ বিকাল ৩:১৬

প্রোফেসর শঙ্কু বলেছেন: চমৎকার! চমৎকার বলেছেন।

প্রিয়তে রেখে দিলাম সুন্দর লেখাটি।

১৬ ই সেপ্টেম্বর, ২০১৪ দুপুর ১:৪৯

নিথর শ্রাবণ শিহাব বলেছেন: অনেক ধন্যবাদ আপনাকে ভাই :)

৪| ২৯ শে সেপ্টেম্বর, ২০১৪ রাত ২:১৮

মাহমুদ০০৭ বলেছেন: অসাধারণ ! অসাধারণ লিখেছেন বস ।
শিক্ষণীয় ও বাস্তবতাময় সত্য কথন ।
প্রিয়তে। এমন লেখা আরো চাই ।
( তাগাদা না দিয়া পারলাম না :P :Pন্যাড়া যেভাবে বেলতলায় যায় আর কি B-)

ভাল থাকবেন ভাই ।

২৯ শে সেপ্টেম্বর, ২০১৪ রাত ৮:৪৫

নিথর শ্রাবণ শিহাব বলেছেন: হা হা হা! ধন্যবাদ ভাই :)

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.