নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

শুণ্যতার নিচে পিয়ানো শুনি...

রাজসোহান

প্রিয় অন্ধকার, আমার পুরোনো বন্ধু তুমি...

রাজসোহান › বিস্তারিত পোস্টঃ

ব্লগার মৃত্যুর উপাখ্যানঃ ক্রমাগত হত্যার সেরেনাদে

০৬ ই মার্চ, ২০২০ দুপুর ২:১৯



লিপ ইয়ার, বইমেলার শেষদিন। গড়ের মাঠ পকেট নিয়ে হাঁটছিলাম ধূলিময় শেষবিকেলে। এরমাঝে মেসেঞ্জারে কথা হচ্ছিলো বন্ধুর সাথে। স্টলগুলোতে থেমে বই হাতে নিয়ে উলটে পালটে দেখছি, আর কিনতে না পারার দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে রেখে দিচ্ছি। এভাবে হাঁটতে হাঁটতে দাঁড়াই সংবেদ প্রকাশনীর সামনে। সেখানে প্রথমে চোখ যায় "নৃবিজ্ঞান পাঠপরিচয়" বইটার দিকে। ভূমিকা পড়ে মনে হয়েছে দারুণ একটা বই। তারপর স্বভাবমতো রেখে দিয়ে পাশেই থাকা আরেকটি বই হাতে তুলে নিই।

নাম "ক্রমাগত হত্যার সেরেনাদে"। লেখক অদিতি ফাল্গুনী। সেরেনাদে অর্থ দাঁড়ায় সান্ধ্যসঙ্গীত। অর্থ্যাৎ লেখক বলছেন হত্যার সান্ধ্যসঙ্গীত। বেশ প্রতীকি নাম বোঝা যাচ্ছে। পাতা উলটে এবং পৃষ্ঠা সংখ্যা দেখে বুঝলাম এটা একটা উপন্যাস। মলাট উলটে পেলাম ফ্ল্যাপে লেখা ভূমিকা। লিখে দিয়েছেন অধ্যাপক অজয় রায় স্যার। ভূমিকার সারাংশ এই, "লেখক উপন্যাসে বিরল ধৈর্য্য ও একাগ্রতায় এদেশে সাম্প্রতিক সময়ে নিহত প্রায় সব মুক্তচিন্তকদের কথা তুলে ধরেছেন। তাঁদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে শোক-সন্তপ্ত পরিবার-পরিজনের সাথে কথা বলে দীর্ঘ আলাপচারিতার মাধ্যমে তথ্যাদি সংগ্রহ করে সেসব তথ্য যথাযথভাবে 'ফিকশনালাইজ' করেছেন।"

ভূমিকা পড়ে আর কিছু না ভেবে মেসেঞ্জারে কথা বলতে থাকা বন্ধুকে বইয়ের কাভার আর ফ্ল্যাপের লেখা ছবি তুলে পাঠিয়ে দিয়ে বললাম, "কিনে দে, এখনই"। কিছুটা ডেস্পারেট ছিলাম বলাই যায়। বন্ধু কিছু জিজ্ঞাসা না করে বিকাশে টাকা পাঠিয়ে দিলো, আমিও বই কিনে ফেললাম। এভাবে আমার হাতে এলো "ক্রমাগত হত্যার সেরেনাদে" যেটি আসলে ফিকশন উপন্যাস হলেও ইতিহাসকে আশ্রয় করে লেখা একটা বড়সর ক্যানভাস।

উপন্যাসের শুরুটাই যথেষ্ট আগ্রহোদ্দীপক, সক্রেটিসের অন্তর্ধান। মৃত্যুর ঠিক আগ মুহুর্তের প্রস্তুতি এবং মৃত্যুর পুঙ্খানুপুঙ্খ দৃশ্যাবলী। বিষের পেয়ালা হাতে নিয়ে সত্যিই কি সক্রেটিস কেঁপে ওঠেননি? মৃত্যুর সময় তার সহযোদ্ধারা পাশেই ছিলো, চোখের সামনে ধীরে ধীরে সক্রেটিসকে স্তিমিত হয়ে দেখলেন সবাই, এমন করুণ দৃশ্যের চিত্রাঙ্কনে লেখকের কল্পনাশক্তির প্রশংসা করতেই হয়।

উপন্যাসটির টাইমলাইন এগিয়েছে অতীত এবং বর্তমান দুটো একসাথে। বর্তমান আবার খুব বেশি বর্তমান নয়, বর্তমানও অনেকটা ১৫/২০ বছরের অতীতই বলা যায়। একেবারেই যেসব অতীতকে টেনে এনেছেন ইতিহাসের আশ্রয় হিসেবে সেগুলোতে কোন রাখঢাক নেই, আর বর্তমানের অংশ হিসেবে যাদেরকে ফিকশন করতে চেয়েছেন সেখানে শুধু চরিত্রগুলোর নামই বদলেছে। বাদবাকী সবই নিরেট সত্যের মতো তুলে ধরেছেন। ভয়ভীতি অথবা কিছুটা রয়েসয়ে বলার কোন ব্যাপারই নেই পুরো উপন্যাসে।

সাহসী ফিকশন বলতেই হচ্ছে। কারণ এই দমবন্ধ সময়ে এসে লেখক খুব চাতুরতার সাথে মেটফোর ব্যবহার করে ইতিহাসের এমন অনেক চরিত্রকে এনেছেন, যাদেরকে নিয়ে হয়তো কোন কথাই বলা যায় না। দূর মরুভূমিতে সহস্রাধিক বছরের পুরোনো এমন অনেক ঘটনা নির্মোহ ভঙ্গীতে লিখেছেন, যেগুলো অন্ধ বিশ্বাসে আক্রান্ত একটি সম্প্রদায় মানতেই চাইবে না।

যেহেতু সত্যনির্ভর, তাই পুরো উপন্যাস আপনাকে একটু পরপরই প্রস্তুত হতে হবে মৃত্যুর জন্য। অতীত-বর্তমান ইতিহাসের সব চরিত্রই একে একে মারা গেছেন/যাচ্ছেন। কেন? শুধু মানবতার কথা বলে যাওয়ার জন্য। অন্ধ বিশ্বাস আর ধর্মের ভয়াল থাবা থেকে সমাজকে মুক্তির কথা বলাই ছিলো তাদের অপরাধ।

উপন্যাসের ব্যপ্তি ইতিহাসের বিভিন্ন খণ্ড খণ্ড সময় নিয়ে। উপন্যাসের শুরু হয়েছিলো সক্রেটিসের গ্রীস থেকে। এরপর ইতিহাসের টানেই কখনও যেতে হয়েছে মরুভূমিতে জন্ম যে ধর্মের, তার অস্থির সময়ে। কখনও ফিরে আসতে হয়েছে শ্রীচৈতন্যের নিরুদ্দেশ হওয়ার ফলে তৎকালীন বাংলার রাজতন্ত্রে বিশ্বাসঘাতকতার প্রভাব। উপন্যাসে এসেছে ব্রিটিশ আমলে ভারতজুড়ে বর্ণপ্রথায় জর্জরিত দলিত সম্প্রদায়ের কথা। মীরাবাঈয়ের সাথে তৎকালীন মৌলবাদীদের সঙ্ঘাত। দেশভাগের পর দাঙ্গার ভয়াবহতা, ২০০১ সালের নির্বাচনের পর হিন্দুদের ওপর আগ্রাসী নির্যাতন আর লাশের মিছিলে বয়ে যাওয়া রক্তও উঠে এসেছে।

উপন্যাসে অধ্যাপক অজয় রায় স্যারের মুক্তিযুদ্ধে থাকাকালীন দৃশ্যাবলীও এসেছে বেদনার মতো। উগ্র মৌলবাদের হামলায় আহত অধ্যাপক হুমায়ুন আজাদ থেকে শুরু করে ২০১৩ সালে আক্রান্ত আসিফ মহিউদ্দীন, একই সালে ফেব্রুয়ারীতে উত্তাল শাহবাগ আন্দোলন চলাকালীন রাতের আঁধারে নিহত রাজীব হায়দার, ২০১৫ সালে মৌলবাদীদের ক্রমাগত চড়াও হয়ে আক্রমণে একে একে চলে যাওয়া অভিজিৎ রায়, অনন্ত বিজয় দাশ, ওয়াশিকুর বাবু, নীলাদ্র নীল, আরেফিন দীপন সহ প্রমুখ প্রত্যেককেই নিপুণ টাইমলাইনে গাঁথা হয়েছে। বাদ যায়নি সম্প্রতি ঘটে যাওয়া হোলি আর্টিজানও! সাজানো হয়েছে মৃত্যুর পর সেই মৃত্যুশোক কাটিয়ে ওঠার পারিবারিক সংগ্রাম। আমরা বাইরে থেকে মৃত্যুতে কী ক্ষতি হয়ে গেলো সেই আফসোসই কাটিয়ে উঠতে পারি না। কিন্তু মৃত্যু যখন একটা মানুষকে পরিবার থেকে ছিনিয়ে নিয়ে যায় সেই ক্ষত বোঝার সাধ্য আমাদের নেই।

লেখক অদিতি ফাল্গুনীর কাছে আমি বা আমরা কৃতজ্ঞ। এমন পরিশ্রমসাধ্য একটি অসাধারণ কাজ সম্পাদন করার জন্য। উনি এগিয়ে না আসলে ব্লগারদের মৃত্যুর উপাখ্যান নিয়ে এরকম কোন কাজ হয়তো হতোই না। এটি যতোটা না ফিকশন তারচেয়ে বেশি এই অঞ্চলের মুক্তমনাদের নিয়ে ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ একটা দলিল। যেন রক্তাক্ত এক ডায়েরি, মানবতার গান গাওয়ার অপরাধে যাদেরকে বরণ করতে হয়েছে মৃত্যু। যে বইয়ের নাম "ক্রমাগত হত্যার সেরেনাদে"।

প্রথম প্রকাশিত ব্যক্তিগত ব্লগে

মন্তব্য ৮ টি রেটিং +১/-০

মন্তব্য (৮) মন্তব্য লিখুন

১| ০৬ ই মার্চ, ২০২০ বিকাল ৩:৫০

হাসান কালবৈশাখী বলেছেন: - ভাল লাগলো।

০৬ ই মার্চ, ২০২০ সন্ধ্যা ৭:৪৬

রাজসোহান বলেছেন: বইটি দালিলিক ভাবে অমূল্য।

২| ০৬ ই মার্চ, ২০২০ বিকাল ৫:০১

নেওয়াজ আলি বলেছেন: অনন্যসাধারণ লেখা।

০৯ ই মার্চ, ২০২০ রাত ৯:৪১

রাজসোহান বলেছেন: ধন্যবাদ।

৩| ০৬ ই মার্চ, ২০২০ রাত ৮:৪৩

গিয়াস উদ্দিন লিটন বলেছেন: বইটি পড়ার আগ্রহ হচ্ছে।

০৯ ই মার্চ, ২০২০ রাত ৯:৪১

রাজসোহান বলেছেন: কিনে ফেলুন। :)

৪| ০৬ ই মার্চ, ২০২০ রাত ১০:০৮

রাজীব নুর বলেছেন: রিভিউ ভালো লাগলো।

০৯ ই মার্চ, ২০২০ রাত ৯:৪১

রাজসোহান বলেছেন: ধন্যবাদ রাজীব ভাই।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.